মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণের ৮০৬ টন চাল গায়েব!

চাল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরাতে ভারতকে আইএমএফের বার্তা

চাল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরাতে ভারতকে আইএমএফের বার্তাজুমবাংলা ডেস্ক : মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণকার্য উপ-বরাদ্দ খাতের ৮০২ মেট্রিক টন চাল নানা কায়দার অনিয়মের মাধ্যমে গায়েব হয়ে গেছে ।

কালবেলায় প্রকাশিত সানাউল হক সানীর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, তবে খাতা-কলমে দেখানো হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের খাদ্য সহায়তা (জেনারেল রিলিফ বা জিআর)। আবার সক্রিয় অনেক প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়েই তাদের নামে ব্যয় দেখিয়ে করা হয়েছে আত্মসাৎ। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে ১০-১২ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে হজম করে ফেলা হয়েছে তাদের নামে বরাদ্দ ১ বা ২ মেট্রিক টন চাল।

আর এসব তালিকা তৈরি এবং চাল গায়েবে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তারা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা এই অনিয়মে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওই এলাকার মানুষের।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সদর উপজেলায় ৬২টি প্রতিষ্ঠানকে ১২৪ মেট্রিক টন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৮৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭২ মেট্রিক টন, কুলাউড়া উপজেলায় ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৬ মেট্রিক টন, কমলগঞ্জ উপজেলায় ১২৩টি প্রতিষ্ঠানকে ২৪৪ মেট্রিক টন, রাজনগর উপজেলায় ৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১১০ মেট্রিক টন এবং জুড়ী উপজেলায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে ১০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে চাল বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ২ মেট্রিক টন চালের বিপরীতে কাউকে দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা। কাউকে ২০, ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবার অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান তালিকায় নাম দেখিয়ে পুরো চালই মেরে দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার জানেই না, তাদের নামে চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। যদিও এসব চাল বিতরণ শেষ করার কথা ছিল গত জুনের মধ্যে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জিআর চাল বিতরণে পুরো মৌলভীবাজারের চিত্র কাছাকাছি হলেও শ্রীমঙ্গল এবং কমলগঞ্জে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান।

সূত্র বলছে, ২০০৯ সাল থেকে কমলগঞ্জ এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন আছাদুজ্জামান। প্রতি তিন বছর পরপর বদলির বিধান থাকলেও তিনি প্রায় পনেরো বছর ধরে এ দুই উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝেমধ্যে কয়েক মাসের জন্য চাকরির বিধান রক্ষার্থে অন্য কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন।

শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চলতি বছরের জুনে ৮৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২ মেট্রিক টন চালের বিপরীতে শ্রীমঙ্গল শহর-শহরতলি এবং উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার, ২০ হাজার আবার ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ ২ টন চালের বর্তমান বাজারমূল্য ১ লাখ ২ হাজার টাকা বলে প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়।

এ ছাড়া বরাদ্দের তালিকায় এমনসব প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে, যেগুলোর কোনো অস্বিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ শাহীবাগ আলআকসা জামে মসজিদ ও হেফজখানা, দক্ষিণ মুসলিমবাগ নূরে মদিনা জামে মসজিদ ও হেফজখানা, বিরাইমপুর নূরানী মাদ্রাসা ও এতিমখানা, দক্ষিণ মুসলিমবাগ হেফজখানা, মারকাজুল উলুম হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, নূরে মদিনা হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, জামেয়াতুন সুন্নাহ ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও হেফজখানা, নুরুল কোরআন হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ সরকারি তালিকায় এসব প্রতিষ্ঠানের নামে চাল বিতরণে দেখানো হয়েছে।

এ নিয়ে কথা হয় শ্রীমঙ্গল শহরতলির সিন্দুরখান রোডের পশ্চিমভাগ বায়তুন নূর জামে মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ মির্জা শামিমের সঙ্গে। বরাদ্দের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুন মাসে আমাদের মসজিদে উপজেলা থেকে ১০ হাজার টাকা অনুদান পাই। সরকারিভাবে ২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ ছিল, এটা জানতাম না।’

বনবাড়ী নূরে মদিনা জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মসজিদে শহরের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে উপজেলা থেকে ১০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। ২ মেট্রিক টন চাল যে বরাদ্দ ছিল, এটা আমরা জানি না।’

রামনগর কাকিয়ারপুল এলাকার ছওতুল হেরা নুরানি মাদ্রাসার পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমার এক বন্ধুর বাবার মাধ্যমে উপজেলা থেকে ১০ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছি। কত চাল বরাদ্দ ছিল তা জানতাম না।’

আল আমিন মাদ্রাসা ও এতিমখানার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল কাশেম বলেন, ‘মাদ্রাসার নামে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।’

পূর্ব সিরাজনগর হাফিজিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা নুর উদ্দিন বলেন, ‘উপজেলা থেকে ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। ২ টন চাল বরাদ্দ ছিল জানতাম না।’

বিরাহিমপুর নূরানী ও হাফেজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার মাদ্রাসার নাম থাকলেও আমি কোনো অনুদান পাইনি।’

দক্ষিণ মুসলিমবাগ আল মদিনা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মসজিদের নামে যে ২ টন চাল বরাদ্দ ছিল জানতাম না। গত জুনে উপজেলা থেকে আমরা কোনো অনুদান পাইনি।’

একইভাবে কোনো চাল পাননি বলে জানিয়েছেন রামনগর আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আবুল কালাম। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ২ টন করে চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে নথিপত্রে দেখানো হয়েছে।

কুলাউড়া উপজেলার দিলদারপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী বলেন, ‘৪৫ হাজার টাকা পেয়েছি।’

শ্রীশ্রী দুর্গা মন্দিরের সভাপতি নিত্য গোপাল চৌধুরী বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা পেয়েছি।’

সদর উপজেলার পূর্ব খলিলপুর জামে মসজিদের সভাপতি হাজি আনর মিয়া বলেন, ‘বক্কর মেম্বারের মাধ্যমে উপজেলা থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি।’

জুড়ী উপজেলায় জামেয়া ইসলামিয়ার মোহতামিম মাওলানা তাফাজ্জুল হক বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা পেয়েছি।’

রাজনগর উপজেলার বিচনকির্তী কিবরিয়া জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি সুলেমান মিয়া বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পাইনি। তবে আমাদের মসজিদের নামে ১ টন চাল বরাদ্দ হয়েছে বলে শুনেছি।’

জুড়ী এবং কুলাউড়া উপজেলার আরও অন্তত বিশজনের অভিযোগ রয়েছে, তারা বরাদ্দকৃত চাল পাননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজারের সবগুলো উপজেলায়ই চাল বরাদ্দে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। পুরো জেলার অন্তত শতাধিক প্রতিষ্ঠানপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। তারা বলছেন, চাল পাননি। কেউ হয়তো ১০-২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তবে সেটা উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা হিসেবে।

এদিকে চাল বরাদ্দে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে হাফেজ মাওলানা ফখরুল ইসলাম নামে একজন অভিযোগে বলেন, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান জানে না, তাদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জিআর বরাদ্দ ছিল। একটি চক্র বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দের বিপরীতে ১০-২০ হাজার টাকা দেওয়ার অনেকগুলো রসিদ সংগ্রহ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে উপজেলা থেকে প্রাপ্ত অনুদান হিসেবে টাকা দেওয়া হয়। সেখানে জিআর বরাদ্দের কথা উল্লেখ নেই। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে টাকা দেওয়ার কোনো বিধান নেই।

এসব বিষয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং কমলগঞ্জের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা এমন অভিযোগ শুনেছি। তাই সরেজমিন তদারক করছি। সব অভিযোগের সত্যতা নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, অভিযোগ এসেছে সেসব ক্ষেত্রে টাইপিং মিসটেক হতে পারে। অনেকগুলোর ক্ষেত্রে নামের ভিন্নতা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে কমিটি টাকা তুলে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান হয়তো জানেন না। এরই মধ্যে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেছি, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সেটি প্রদান করা হবে।’

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. ঊর্মি বিনতে সালাম বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। অভিযোগ এসেছে। প্রকৃত ঘটনা কী হয়েছে তা তদন্তের পর বলা যাবে।’

দেশে খাদ্যের কোনো অভাব নেই : খাদ্যমন্ত্রী