২০০৯ সালের কথা। ফিয়োনা ব্রুম নামের এক নারী একটা ওয়েবসাইটে নিজের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেন। তিনি গিয়েছিলেন একটা কনফারেন্সে। সেখানে তিনি বহু মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার এই সাবেক প্রেসিডেন্টের মৃত্যু নিয়ে আলাপ করেছেন। দুঃখ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কারো কারো মতে, জেলে তাঁর মৃত্যু ছিল ট্রাজেডি।
এরকম বহু মানুষ দীর্ঘদিন ভেবেছেন, নেলসন মেন্ডেলার মৃত্যু হয়েছে জেলে, ১৯৮০ সালে। আসলে তা নয়। ম্যান্ডেলা জেল থেকে মুক্ত হয়েছেন, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কিছু কাল। ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে তিনি যে তখনো বেঁচে, সেটা যে অনেকে জানেন না—এই বিষয়টিকেই ফিয়োনা ব্রুম আখ্যায়িত করেন ‘ম্যান্ডেলা এফেক্ট’ নামে।
তিনি ওয়েবসাইট প্রকাশের পর আরও বহু মানুষ জানান, তাঁদেরও ধারণা ছিল, নেলসন ম্যান্ডেলা বেঁচে নেই। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নিজেদের স্মৃতির বিস্তারিত বিবরণও দিয়েছেন অনেকে। সমন্বিত স্মৃতি বিভ্রমের এই ঘটনা আজ ‘ম্যান্ডেলা এফেক্ট’ নামেই পরিচিত।
শুধু একটা ঘটনা থেকে এরকম নামকরণ হয়নি। এমন উদাহরণ রয়েছে আরও অনেক। এমনই একটি ঘটনা রয়েছে জনপ্রিয় মুভি সিরিজ স্টার ওয়ার্স: এপিসোড ফাইভকে (V) কেন্দ্র করে। মুভিতে, অনেকের মতে, ডার্থ ভেডার নামের চরিত্রটি বলে, ‘লুক, আই এম ইওর ফাদার।’ আসলে তা নয়, উক্তিটি হলো, ‘নো, আই এম ইওর ফাদার।’ অথচ বহু মানুষ মনে করেন, প্রথম উক্তিটিই তাঁরা শুনেছেন বা দেখেছেন।
একইরকম ঘটনা রয়েছে জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ লুনি টুনসকে (LOONEY TUNES) ঘিরে। অনেকের ধারণা, এর ইংরেজি নামটি হলো LOONEY TOONS। আসলে নামের বানান হলো LOONEY TUNES। এমন আরেকটি ঘটনা হলো, মনোপলি খেলার বাক্সে মি. মনোপলি একটি এক কাচের চশমা বা মনোকল পরে আছেন বলে স্মৃতিতে রয়েছে অনেকেরই, যদিও আসলে তাঁর চোখে কোনো চশমা নেই। এরকম ঘটনা রয়েছে আরও বহু। পরের উদাহরণগুলো ছোট ছোট ঘটনা মনে হতে পারে, কিন্তু মূল বিষয়টি চিন্তা (বা দুশ্চিন্তা) উদ্রেককারী বটে। বিষয়টি হলো, বহু মানুষের একসঙ্গে এমন ভুল স্মৃতি তৈরি হয় কীভাবে?
একটা ব্যাখ্যা হলো ফলস মেমোরি বা মিথ্যে স্মৃতি। বিষয়টা কী, তা বোঝার জন্য একটা উদারহণ দেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের (জাতির জনক) একজন আলেক্সান্ডার হ্যামিলটন। কিন্তু তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। অথচ দেশটির অনেক নাগরিক তাঁকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেই মনে করে।
নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর ব্যাখ্যা হলো, মস্তিষ্কের যে অংশে আলেক্সান্ডার হ্যামিলটনের নামটি সংরক্ষিত, একই জায়গায় সংরক্ষিত প্রেসিডেন্টদের স্মৃতিও। ফলে মানুষ যখন হ্যামিলটনের নাম মনে করে, তখন আশপাশের যে নিউরনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, সেগুলো থেকে উঠে আসে প্রেসিডেন্টদের স্মৃতিও। এভাবে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, গড়ে উঠতে পারে মিথ্যে বা ভুল স্মৃতি। ব্যাখ্যাটা অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট, তবে মূল বিষয়টা এরকমই।
আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, মস্তিষ্ক স্মৃতির ফাঁকা স্থান পূর্ণ করে। স্বপ্নের উদাহরণ দেওয়া যায়। আমরা খুব অল্প সময় স্বপ্ন দেখি; অনেক ঘটনাই আমরা পরিপূর্ণভাবে দেখি না বা ঘুম ভাঙার পরে মনে থাকে না। তবু ঘুম ভাঙলে আমরা মাঝেমধ্যে একটা স্বপ্নিল স্মৃতি মনে করি—মনে হয় যেন এই এই ঘটনা ঘটেছে।
আসলে, স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, এ ক্ষেত্রে স্বপ্নে বিচ্ছিন্ন কিছু জিনিস দেখলে মস্তিষ্ক ঘুম ভাঙার পর ফাঁকা জায়গাগুলো সিমিলার বা একই রকম স্মৃতি দিয়ে পূর্ণ করে দেয়। এভাবেও বিভ্রান্তিকর স্মৃতি তৈরি হতে পারে—যেখানে বাস্তবে একটি ঘটনার কিছু অংশ আপনি জানেন, বাকিটা মস্তিষ্ক কাছাকাছি স্মৃতির তথ্য থেকে তৈরি করে নেয়।
আবার জনপ্রিয় ধারার মুভি বা বইপত্র কিংবা ঘটনার ক্ষেত্রে অনেক সময় মানুষ সাজেশন বা প্রস্তাব দেয়। যেমন সপ্তাহ দুয়েক আগে আপনি হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছেন, সেখানে একটা গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাড়িটির রং হয়তো ছিল সাদা। আপনার এক বন্ধু সঙ্গে ছিল। দুসপ্তাহ পর আড্ডায় এই গল্প বলার সময় সে হয়তো আপনাকে বলল, ‘সেদিন যে গাড়ি দুর্ঘটনাটা ঘটল, মনে আছে তোর?
সবুজ রঙের একটা টয়োটা গাড়ি ছুটে এসে…’—এভাবে আপনার স্মৃতিতে বসে যেতে পারে গাড়িটির রং হতে পারে সবুজ। বাস্তবে হয়তো বছরখানেক পর আপনি টয়োটা নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে দেখলেন, সবুজ রঙের টয়োটা গাড়িই নেই! ইন্টারনেটের কল্যাণে, জনপ্রিয় মিম দেখতে দেখতে বা পোস্ট পড়ে, রিল দেখে এ ধরনের সমন্বিত ভুল স্মৃতি বা বিভ্রম হতে পারে। নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে এ জন্যই হবে।
কাজেই এ ঘটনাকে ঠিক ব্যাখ্যার অতীত বলা যায় না, তবে ম্যান্ডেলা এফেক্টের সত্যিকার সুনিশ্চিত ব্যাখ্যা সেভাবে দাঁড় করানো যায়নি এখনো। মূল কারণটি তথ্যের অভাব। হয়তো আরও অনেকের এ ধরনের সমন্বিত স্মৃতিবিভ্রমের তথ্য পাওয়া গেলে, এ নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা এর কারণটি ব্যাখ্যা করতে পারবেন নিশ্চিতভাবে। তবে এটি যে বিভ্রান্তি—স্মৃতির হেঁয়ালি, এটুকু বলা যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।