প্রতি বছর রমজানের শেষে ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব থেকে যখন আসে, তখন তা শুধু সৌদির নাগরিকদের জন্যই নয়, বরং বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জন্য হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ইসলামি ক্যালেন্ডার চাঁদভিত্তিক হওয়ায়, নতুন মাস শাওয়াল শুরুর ঘোষণা দিয়েই ঈদের তারিখ নির্ধারিত হয়। আর এই ঘোষণা আসে চাঁদ দেখার মাধ্যমে, যা সৌদি আরবের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারিত হয়।
এই প্রতিবেদনটিতে আমরা জানব কিভাবে সৌদি আরব ঈদের তারিখ ঘোষণা করে, ২০২৫ সালের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা কী বলছে, এবং এ ঘোষণার বৈশ্বিক প্রভাব কতটা বিস্তৃত। সেইসাথে আলোচনা করব এর ধর্মীয়, সামাজিক ও আবেগঘন দিকগুলো নিয়েও।
সৌদি আরব ইসলামের দুই পবিত্র স্থান—মক্কা ও মদিনার আবাসস্থল, এবং সেখানকার ধর্মীয় সিদ্ধান্ত বিশ্বের বহু মুসলমান অনুসরণ করেন। প্রতি বছর রমজান মাসের শেষে ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব যখন করে, তখন সেটি রীতিমতো একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্টে পরিণত হয়।
ইসলামী হিজরি ক্যালেন্ডারে মাস শুরু হয় নতুন চাঁদ দেখার মাধ্যমে। সৌদি আরবে এটি নির্ধারণ করতে ব্যবহার করা হয় আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন টেলিস্কোপ, ডিজিটাল ক্যামেরা, এমনকি স্যাটেলাইট পর্যন্ত। একই সঙ্গে স্থানীয় মানুষকেও চাঁদ দেখার আহ্বান জানানো হয়।
২০২৫ সালের জন্য সৌদি আরব ঘোষণা করবে রমজান মাসের ২৯ তারিখ সূর্যাস্তের পর, মক্কা সময় সন্ধ্যা ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা)। সেদিন চাঁদ দেখা গেলে পরদিনই ঈদ হবে, নাহলে রমজান ৩০ দিনে পূর্ণ হবে।
ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব কেবল সৌদির অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক দেশ—বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসী মুসলিমরাও এই ঘোষণা অনুযায়ী ঈদ পালন করেন।
যেসব দেশে স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখা কঠিন, তারা সৌদি ঘোষণাকে অনুসরণ করে। এমনকি অনেক সময় পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশও সৌদি ঘোষণার উপর নির্ভর করে। তবে কিছু দেশ যেমন ভারত, বাংলাদেশ স্থানীয় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ঈদের তারিখ ঘোষণা করে।
এই কারণে একই ইসলামি উপলক্ষে কখনো কখনো দুই দেশের মধ্যে একদিনের পার্থক্য দেখা যায়। তবুও, সৌদির সিদ্ধান্ত অনেক মুসলিম দেশের জন্য একটি মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে।
আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ২৯ মার্চ তারিখে চাঁদ দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা ওইদিন চাঁদ সূর্যাস্তের আগেই অস্ত যাবে, ফলে খালি চোখে তো নয়ই, এমনকি টেলিস্কোপেও তা দেখা যাবে না।
এর মানে দাঁড়ায়, যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে রমজান ৩০ দিন পূর্ণ হবে এবং ঈদ উদযাপিত হবে ৩১ মার্চ, ২০২৫ (সোমবার)।
তবে সৌদি আরবের কিছু জায়গা থেকে যদি চাঁদের দৃশ্যমানতার রিপোর্ট আসে, তাহলে ঈদের তারিখ একদিন আগেও হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রতিবছর রমজানের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় সৌদি আরবের বিশেষ চাঁদ দেখার কমিটিগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। এদের সঙ্গে থাকেন জ্যোতির্বিদ, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ এবং আধুনিক প্রযুক্তি। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকেও চাঁদ দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
সৌদির সুদায়ার এবং তুমাইর অঞ্চল সবচেয়ে বিখ্যাত চাঁদ দেখার জায়গা। যেখান থেকে প্রায়ই ঈদের চাঁদের খবর পাওয়া যায়। ঘোষণা আসার পর মুহূর্তেই তা পৌঁছে যায় টেলিভিশন, রেডিও ও সামাজিক মাধ্যমে।
বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় যখন ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব থেকে আসে, তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মধ্যে ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যায়।
ঈদের ঘোষণা মুসলিমদের জন্য শুধু একটি তারিখ নয়—এটি একটি আবেগঘন মুহূর্ত। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর এই ঘোষণাই সূচনা করে আনন্দ, প্রার্থনা, উপহার বিনিময় ও পারিবারিক মিলনের।
বিশেষ করে প্রবাসীরা, যারা পরিবার থেকে দূরে থাকেন, তাদের জন্য ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব হয়ে ওঠে এক আবেগপূর্ণ খবর। অনেকেই মোবাইল ফোনে প্রিয়জনদের সঙ্গে এই মুহূর্তে যোগাযোগ করেন, ভিডিও কল করেন, কাঁদেন ও হাসেন একসঙ্গে।
সৌদি আরব ঘোষণা করার পরপরই ইউএই, কাতার, বাহরাইন, কুয়েতসহ বেশিরভাগ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ একই দিন ঈদ ঘোষণা করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের নিজস্ব চাঁদ দেখার কমিটির সিদ্ধান্ত নিলেও, সৌদির ঘোষণাকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়।
ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক ইসলামিক সেন্টার সৌদির ঘোষণার উপর ভিত্তি করে ঈদের নামাজের সময় নির্ধারণ করে। ফলে তাদের ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কমিউনিটিতে পৌঁছে যায় ঈদের খবর।
একবার ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব থেকে এলে, তখন থেকেই শুরু হয় ঈদের প্রস্তুতির ব্যস্ততা। মসজিদগুলো তৈরি হয় ঈদের নামাজের জন্য, রান্নাঘরগুলোতে শুরু হয় বিশেষ খাবারের প্রস্তুতি, এবং পরিবারে শুরু হয় উপহার ও পোশাক বিনিময়ের প্রস্তুতি।
যে সমস্ত মানুষ গরীব ও দুস্থ, তাদের জন্য জাকাতুল ফিতর বিতরণ করা হয় ঈদের নামাজের আগেই। মক্কা ও মদিনায় লক্ষাধিক মানুষ একত্রিত হন ঈদের নামাজে, যা এক অনন্য অনুভব।
ঈদের তারিখ ঘোষণা সৌদি আরব প্রতি বছর মুসলিম বিশ্বকে এক সূত্রে বাঁধে। এটি কেবল একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটি আবেগঘন, আত্মিক, এবং সার্বজনীন উৎসবের সূচনা।
২০২৫ সালে চাঁদের দৃশ্যমানতা না থাকার সম্ভাবনা বেশি হলেও, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে সৌদির পর্যবেক্ষণের উপর। আর একবার যখন চাঁদ দেখা যাবে, তখনই শুরু হবে ঈদের খুশির ঝড়—প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি হৃদয়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।