সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প-র্ন তারকাখ্যাতি পাওয়া এক যুগলের বিরুদ্ধে ‘দ্য ডিসেন্ট’ নামের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দেশের প্রথম সারির প্রায় সব গণমাধ্যমই নড়েচড়ে বসে। কেউ কেউ ‘দ্য ডিসেন্ট’-এর সেই প্রতিবেদনকে উৎস হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করলেও অনেকেই উৎসের নাম উল্লেখ না করেই নিজেদের নামে প্রতিবেদন চালিয়ে দিয়েছেন।

এরপর প্রশাসনের অভিযানে ওই যুগলকে গ্রেফতার করা হলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিছু কিছু গণমাধ্যমকর্মীর আচরণ দেখে মনে হয়েছে, যেন তারা ‘ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছেন’। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে একযোগে যুগলের নাম, ছবি, ঠিকানা এমনকি পরিবারের সদস্যদের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একই চিত্র। যেখানেই চোখ রাখা যায়, দেখা যাচ্ছে ওই যুগলের ছবি, ভিডিও বা সম্পর্কিত সংবাদে প্লাবিত ফিড। কমেন্ট বক্সে চলছে তাদের ভিডিও লিঙ্ক ও ব্যক্তিগত তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান। যেন এক ধরনের ‘ডিজিটাল হুমড়ি’ খেয়ে পড়েছে পুরো সমাজ।
প্রশ্ন উঠছে-যেসব গণমাধ্যমকর্মীরা এই যুগলের ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি প্রকাশ করছেন, তারা কি অজান্তেই তাদের আরও প্রচার দিচ্ছেন না? অপরাধ বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংবাদ প্রচার নিশ্চয়ই গণমাধ্যমের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তবে সেটির সীমারেখা কোথায়?
আইন ও সাংবাদিকতার নীতি কী বলে?
বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং ফৌজদারি বিধি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অভিযুক্ত বা গ্রেফতার হলেই তার ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি প্রকাশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা নেই। বিশেষ করে যদি মামলাটি এখনো আদালতে নিষ্পত্তি না হয়, বা বিচারাধীন থাকে—তাহলে অভিযুক্তের মর্যাদা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা আইনি দায়িত্ব।
এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধিতেও স্পষ্টভাবে বলা আছে- “কোনো ব্যক্তির সুনাম, সামাজিক অবস্থান বা পারিবারিক মর্যাদা বিনষ্ট করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশে সাংবাদিককে সংযত ও দায়িত্বশীল হতে হবে।”
অর্থাৎ, অভিযুক্তের ছবি বা পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যদি না সেটি জনস্বার্থে অপরিহার্য হয়।
নৈতিক প্রশ্ন ও সামাজিক প্রভাব:
এই ঘটনাটি গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিকতা কেবল ‘কে আগে সংবাদ প্রকাশ করবে’ সেই প্রতিযোগিতা নয়, বরং ‘কে বেশি দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ পরিবেশন করবে’ সেটিই আসল প্রশ্ন।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ভিউ, ক্লিক ও লাইক-শেয়ারের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে অনেকেই অনিচ্ছাকৃতভাবে অপরাধীদেরও তারকায় পরিণত করে ফেলছেন। একসময় যাদের বিরুদ্ধে জনরোষ ছিল, তাদের ভিডিও ও নামই পরিণত হচ্ছে কৌতূহলের জ্বালানিতে। যা সমাজে বিকৃত মনোভাবের জন্ম দিতে পারে।
শেষ কথা:
অপরাধীকে প্রকাশ করা জরুরি, কিন্তু তার প্রচার নয়। সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য ‘বিচার নয়, তথ্যপ্রকাশ’। কিন্তু যখন তথ্যপ্রকাশই এক ধরনের বিনোদনে রূপ নেয়, তখন গণমাধ্যমের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
‘দ্য ডিসেন্ট’-এর প্রতিবেদন হয়তো সমাজের এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করেছে, কিন্তু সেই অন্ধকারকে আলো দেখানোর বদলে যদি আমরা শুধু তাকে প্রদর্শনীর বস্তু বানিয়ে ফেলি তাহলে সেটি কেবল সাংবাদিকতার নয়, সমাজেরও ব্যর্থতা।
লেখক- সাইফুল ইসলাম, গণমাধ্যমকর্মী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।