জুমবাংলা ডেস্ক : ইসমাইল হোসেন সম্রাট। রাজধানীর ক্লাবগুলোতে যাতায়াতকারীদের কাছে তিনি ক্যাসিনো সম্রাট হিসেবে পরিচিত। যুবলীগের রাজনীতি করলেও তার নেশা ও পেশা জুয়া খেলা। জুয়ার ব্যবসা করে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তিনি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুর যেতেন, জুয়া খেলতে। তার জুয়ার আসর থেকে কেউ-ই জিতে আসতে পারে না। মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, পল্টন এলকাসহ অন্তত ১০ টি ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
যুবলীগ নেতা সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদাবাজিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যাকাত ও দানের টাকা দিতেন আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে। সেখান থেকেও চাঁদা নিতেন সম্রাট। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ার সুবাধে তার ছিল বিশাল বাহিনী। তিনি কাকরাইলের অফিসে অবস্থান করলেও কয়েকশ’ নেতাকর্মী সব সময় তাকে ঘিরে রাখত। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটকল দিতেন শতাধিক নেতাকর্মী। অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়েই এই বাহিনী পালতেন সম্রাট।
সম্রাটের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯০ সালে। সেই সময়কার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তখন সারাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সম্রাট রমনা অঞ্চলে আন্দোলনের সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন। এ কারণে তখন নি র্যাতনসহ জেলও খাটতে হয় তাকে। এরপর থেকেই ‘সম্রাট’ খ্যাতি পান সাহসী সম্রাট হিসেবে।
যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর জন্ম ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন সম্রাট।
সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন। সম্রাট থাকতেন মহাখালীর বাসায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত কয়েক দিন ধরে তিনি বাসায় ছিলেন না।
সম্রাট ১৯৯১ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতি করাবস্থায় এরশাদ সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। সে আমলে সম্রাটের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ১/১১-এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সময় সম্রাট যুবলীগের প্রথমসারির নেতা ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হতে থাকেন সম্রাট। দলীয়ভাবে পদোন্নতিও হয় তার। আওয়ামী লীগের বড় বড় অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।
যুবলীগের সবশেষ কাউন্সিলে তিনি যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন। আগের কমিটিতে তিনি ছিলেন একই ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক। দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মিল্কীর হ ত্যাকাণ্ডের পর সম্রাটের আর পিছু তাকাতে হয়নি। মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলকায় অপরাধ জগতের একক আধিপত্য তৈরি করেন সম্রাট। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দুই সহচর হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ (কাউন্সিলর) ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগের অপর প্রভাবশালী নেতা জিকে শামীমও সম্রাটকে অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন। সাঈদকে কাউন্সিলর বানান সম্রাটই। পরে তাকে দিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা দেখভাল করাতেন সম্রাট।
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ছিলেন ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। ঢাকায় দলীয় সমাবেশগুলো সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন তিনি। টাকা ও জনবল সরবরাহের কাজ করতেন সম্রাট। এসবের মাধ্যমে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ওমর ফারুক চেৌধুরী সম্রাটকে যুবলীগের শ্রেষ্ঠ সংগঠক ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি ক্যাসিনো চালানো, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ সব অভিযোগের তীর এখন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি রাজধানীর মতিঝিলসহ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার সরকারি দফতর, ক্লাবসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি যুবলীগের কয়েকজন নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী সম্রাটের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অ স্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অ স্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অ স্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেণ, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরও দমন করা হবে।
এর পরই শুদ্ধি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতার করা হয় একে একে খালিদ, শামীমসহ যুবলীগ নেতাদের।
১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইয়াংমেনস স্পোটিং ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। চার মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ব্যবসায় খালেদের ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত সম্রাট।
এর দুদিন পর গ্রেফতার করা হয় টেন্ডার কিং হিসেবে পরিচিত আরেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে। তিনিও চাঁদাবাজির টাকার ভাগ দিতেন সম্রাটকে।
খালিদ ও শামীম দুজনেই জিজ্ঞাসাবাদে তার অপকর্মের ভাগীদার হিসেবে সম্রাটের নাম উল্লেখ করেন। এরপর থেকে গা ঢাকা দেন সম্রাট। আড়ালে থেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে ধর্না দেন তাকে যেন গ্রেফতার না করা হয়। তিনি শেষ সুযোগ হিসেবে দেশ ছাড়ার সুযোগ চাইছিলেন। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার এড়াতে পারেননি।
রোববার ভোর ৫টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাটকে গ্রেফতার করে র্যাব। এসময় সম্রাটের আরেক সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকেও গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব জানায়, ফেনী ভ্রমণের সময় সম্রাটের সফরসঙ্গী হিসেবে থাকেন আরমান। তিনিও ফেনী থেকে উঠে এসেছেন। সম্রাটের আর্থিক লেনদেনগুলো করে থাকেন আরমান। ঠিকাদার হিসেবেও আরমানের পরিচিতি রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্পে ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিতে সম্রাট তাকে সহযোগিতা করেন বলেও জানা গেছে।
সম্রাট যখন জুয়া খেলতে সিঙ্গাপুর যেতেন তখন তার সঙ্গী হতেন আরমান ও কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়াংমেনস ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইয়াংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্রাটের শিষ্য খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন।
সম্রাটের ক্যাসিনোর দেখাশোনা করতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তারা এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম–জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর মমিনুল সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। সূত্র : যুগান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।