ধর্ম ডেস্ক : সানআর পশ্চিমে ২০০ কিলোমিটার অদূরে ইব জেলার জিবলা শহর। তার ছোট একটি টিলায় নির্মিত হয়েছে রানি আরওয়া জামে মসজিদ, যা ইয়েমেনের ইসলামি নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রায় নয় শতাব্দীর অধিককাল ধরে মসজিদটি এ অঞ্চলের মহামনীষীদের জীবন্ত সাক্ষী, যা ইয়েমেনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছে।
রানি আরওয়া বিনতে আহমদ সুলাইহি (৪৪০-৫৩২ হিজরি) এর নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। তিনি ছিলেন সুলাইহি রাজত্বের প্রসিদ্ধ বাদশাহ। সুলাইহিরা ইয়েমেনে ৪২৯-৫৬৯ হিজরি সময়কালে রাজত্ব পরিচালনা করেন। তাদের ছিল মিসরের ফাতেমি রাজত্বের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। রানি আরওয়া তার স্বামী বাদশাহ আহমদ বিন আলী সুলাইহির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ৪৭৭ হিজরিতে ইয়েমেনের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি সুলাইহিদের প্রথম রাজধানী সানআ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে যান এবং তাদের নির্মিত জিবলা শহরকে তার শাসনকার্যের রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করেন।
সুলাইহি যুগের বিশ্লেষক ঐতিহাসিক সাইফ হামাদি আল-জাজিরাকে বলেন, দুটি কারণে রাজধানীকে জিবলা শহরে স্থানান্তর করা হয়। ক. ভৌগোলিক কারণ : চারদিকে গোলাকার পাহাড়ের সারি, যা শহরের জন্য প্রাকৃতিক দুর্গের রূপ ধারণ করেছিল। খ. রাজনৈতিক কারণ : সানআয় তখন বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। অন্যদিকে জিবলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর লোকদের সব ধর্মমতের সঙ্গেই ধর্মীয় সম্প্রীতি ছিল অনেক বেশি। তার মধ্যে সুলাইহিদের ধর্মবিশ্বাস ইসমাইলি মতবাদের প্রতিও তাদের সম্প্রীতি বজায় ছিল। তিনি আরও বলেন, শাসনকালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত সানআ তাদের রাজত্বের অধীনেই ছিল।
মসজিদের ইতিবৃত্ত : জিবলায় পৌঁছে রানি দারুল ইজ্জ নামক একটি রাজকীয় ভবনে অবস্থান করেন। তার সঙ্গেই সংযুক্ত করা হয় ছোট একটি মসজিদ। দিন দিন মুসল্লি সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে রানি ভবনটি ভেঙে মসজিদ সম্প্রসারণ ও পার্শ্ববর্তী টিলায় নতুন ভবন নির্মাণের ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি নিজে মসজিদ নির্মাণের তদারকি করেন। তা নির্মাণের জন্য অভিজ্ঞ মিস্ত্রি তলব করেন। অতঃপর লম্বালম্বিতে চারটি ভবন ও মধ্যখানে একটি উন্মুক্ত আঙিনা বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন।
উত্তর দিকের ভবন : এটাই মসজিদের বড় অংশ। এটাকে নামাজের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
পূর্ব ও পশ্চিম দিকের ভবন : এ দুটিকে মসজিদ সংলগ্ন ক্লাসরুম বানানো হয়।
দক্ষিণ পার্শ্বের ভবন : এটা ছাদবিশিষ্ট একটি ভবন। তার দক্ষিণ দুই কোণে দুটি লম্বা মিনার নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া নামাজের স্থানের পশ্চিম দিকে একটি ঘর বাড়ানো হয়। সেটাকে কোরআন রাখার জায়গা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতিতে পরিচিতিলাভকারী রানির যুগ থেকেই মসজিদটি বিভিন্ন ঘরানার আলেম ও ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তাতে আগমনকারী ছাত্র ও আলেমদের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তিও তিনি মসজিদের জন্য ওয়াক্ফ করে যান। পরবর্তী সময়ে কয়েক যুগ পর্যন্ত ইয়েমেনে তা জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচার-প্রসারের কিছুকাল পর তার সরব অবস্থা দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
রানির অসিয়ত অনুযায়ী নামাজের স্থানের পশ্চিম-উত্তর কোণে তাকে দাফন করা হয়। তার কবরের ওপর একটি সুসজ্জিত কাঠের সিন্দুক রয়েছে। কবরের ওপর রয়েছে চারকোণ বিশিষ্ট বিভিন্ন সজ্জায় সুসজ্জিত একটি কামরা। পুরো মসজিদটি, বিশেষভাবে এ কবরটি জিয়ারতের জন্য আরব, আযম ও ইয়েমেনের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকরা আসেন। কিন্তু সম্প্রতি ইসমাইলি মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিন্দুস্তানের বাহরাহ সম্প্রদায়ের কিছু লোকই এখানে জিয়ারতের জন্য আসে।
বিরল পা-ুলিপি
মসজিদের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মুজিব মুজাহিদের বর্ণনা মতে, নামাজের ঘর সংশ্লিষ্ট কামরায় হাতের লেখা দুই শতাধিক কোরআন শরিফ রয়েছে। তার মধ্যে কিছু স্বর্ণের কালি দিয়ে লেখা; এগুলো রানির সময়কাল পঞ্চম শতাব্দীর। এ বিরল মুসহাফগুলোকে বদ্ধ কাচের তাকে রাখা হয়েছে। দর্শনার্থী ব্যতীত তা খোলার অনুমতি নেই।
আলজাজিরার সাক্ষাৎকালে মুজাহিদ বলেন, এ প্রতœতাত্ত্বিক মুসহাফগুলো হাতে বাঁধাই করা। দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পরও আধুুনিককালের কোনো মেরামত তাতে স্পর্শ করেনি। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ইয়েমেনে মসজিদ ও প্রতœতাত্ত্বিক লাইব্রেরিগুলোতে পা-ুলিপি চুরির যে ঘটনা ঘটছে, এ মুসহাফগুলো সে চুরির কবলে পড়েনি। মসজিদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুজাহিদ বলেন, মসজিদটির অনেক ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে। যার ফলে ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তার পক্ষে নিয়মিত দেখাশোনা ও বিভিন্ন মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু মসজিদের বাহ্যিক অবস্থা মুজাহিদের কথার বিপরীত দিকটাই প্রমাণিত করছে। মনে হচ্ছে, মসজিদটি বিরাট অবহেলার শিকার। তার দেওয়াল ও বর্ধিতাংশে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। মসজিদের প্রতিবেশী যুবক নাসির জাররাফি আলজাজিরাকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি এ-ও ইঙ্গিত করেন, মসজিদটিতে বাহ্যত কোনো ফাটল দেখা যাওয়া থেকেও অবহেলার বিষয়টি গুরুতর।
তার বর্ণনা মতে, বৃষ্টির পানি মসজিদের মূল অংশে পৌঁছে যায়। তাছাড়া আশপাশে লক্ষণীয় হারে ভবন বৃদ্ধি পাওয়ায় এগুলো মসজিদের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি মসজিদের ওয়াক্ফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধানকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন ইবরাহীম, আলজাজিরা আরবি থেকে অনুবাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।