সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাবার তৈরি করে উদ্ভিদ। প্রাণিকোষে প্রাকৃতিকভাবে সালোকসংশ্লেষণ হয় না। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে প্রাণিকোষে সালোকসংশ্লেষণ করেছেন! জীববিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ আবিষ্কার বদলে দিতে পারে চিকিৎসাসেবাসহ অনেক কিছুর খোলনলচে।
প্রথমবারের মতো সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম প্রাণিকোষ তৈরি করেছেন জাপানের একদল বিজ্ঞানী। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাকিহিরো মাতসুনাগার নের্তৃত্বে সম্প্রতি গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এটিকে একুশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জীববিজ্ঞানের সীমারেখাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে এ গবেষণা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁদের এ গবেষণা কাজে লাগবে চিকিৎসাসেবা ও গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে প্রাণিজ আমিষ (যেমন খাবার মাংস) উৎপাদনে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে প্রসিডিংস অব দ্য জাপান একাডেমি জার্নালে।
সালোকসংশ্লেষণ উদ্ভিদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গাছপালা ছাড়াও শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এ ক্ষমতা দেখা যায়। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এগুলোর দেহকোষে সূর্যের আলো, পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে কোষের মধ্যে অক্সিজেন এবং শর্করা বা চিনি (সুগার) তৈরি হয়। এর মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তি যোগায়। প্রক্রিয়াটি আরেকটু ভেঙে বলা যাক।
উদ্ভিদ (বলার সুবিধার্থে এ লেখায় আমরা ‘গাছ’ বলব) ক্লোরোফিলের মাধ্যমে সূর্যের আলো শোষণ করে। ক্লোরোফিল একধরনের সবুজ রঞ্জক কণা। গাছের পাতায় ক্লোরোপ্লাস্ট নামে একধরনের অঙ্গাণু থাকে, এই কণা থাকে সেখানে। সবুজ উদ্ভিদ সূর্যের আলোর শক্তি ব্যবহার করে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং মাটি থেকে পানি টেনে নেয়। এগুলো ব্যবহার করে ক্লোরোপ্লাস্টে তৈরি করে গ্লুকোজ। এই গ্লুকোজ একধরনের চিনি বা শর্করা। এটিই উদ্ভিদকোষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ থেকেই গাছ পুষ্টি ও শক্তি পায়, যে কথা আগেই বলেছি।
এ প্রক্রিয়া চলাকালে বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে তৈরি হয় অক্সিজেন। গাছ খাদ্য তৈরির সময় এসব অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র অণুজীব—সবারই বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন আবশ্যক। তাই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া কেবল গাছের খাদ্যই তৈরি করে না, বরং গোটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখে। পৃথিবীতে প্রাণের টিকের থাকার পেছনে সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব বোঝা যায় এ থেকে।
বিজ্ঞানী মাতসুনাগার ভাষ্যে উঠে এসেছে বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে মানুষসহ যত ধরনের প্রাণ আছে, সবকিছুর বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে এই সালোকসংশ্লেষণের কল্যাণে। অন্যদিকে প্রাণিকোষ অক্সিজেন গ্রহণ করে, খাবার ভেঙ্গে চিনি বা শর্করায় পরিণত করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। এটা সালোকসংশ্লেষণের পুরো বিপরীত প্রক্রিয়া।’
প্রাণিকোষে যদি সালোকসংশ্লেষণ ঘটানো সম্ভব হয়, তাহলে এই চিত্র পাল্টে যাবে। সে ক্ষেত্রে এমন প্রাণিকোষ তৈরি করা যাবে, যা কম অক্সিজেন গ্রহণ ও স্বল্প কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে সক্ষম। শুধু তা-ই নয়, প্রাণিকোষকে সে ক্ষেত্রে ছোট্ট অক্সিজেন ফ্যাক্টরিও বানানো যাবে, এমনটাই আশা গবেষকদের।
সালোকসংশ্লেষণক্ষম এমন প্রাণিকোষ তৈরির চেষ্টা চলছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। ৭০-এর দশক থেকে এ নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। মাতসুনাগার ভাষ্যে, ‘আমরা যদি প্রাণিকোষে সালোকসংশ্লেষণের সুবিধা পাই, তাহলে অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ কমানো যাবে। কমানো যাবে শর্করা বা চিনি গ্রহণের পরিমাণ। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণও কমানো যাবে সে ক্ষেত্রে।’ এ ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হলো, প্রাণিকোষকে ক্লোরোপ্লাস্ট অঙ্গাণু ধারণের উপযোগী করে তোলা।
প্রাণিকোষ স্বাভাবিকভাবে ক্লোরোপ্লাস্টকে ধ্বংস করে দেয়। কারণ একে বহিরাগত ক্ষতিকর অঙ্গাণু, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত করে দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা। প্রায় এক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে প্রাণিকোষকে ক্লোরোপ্লাস্ট ধারণের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রতিবারই বিফল হন তাঁরা। ফলে একসময় এ নিয়ে গবেষণাই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন, প্রাণিকোষ কখনোই ক্লোরোপ্লাস্ট ধারণের উপযোগী হবে না, নিজের ভেতর জায়গা দেবে না এ অঙ্গাণুকে।
কিন্তু অধ্যাপক মাতসুনাগা ও তাঁর দল হাল ছাড়েননি। যুগান্তকারী এ আবিষ্কার করার জন্য তাঁরা দুটি পদক্ষেপ নেন। প্রথমত, তাঁরা এমন ক্লোরোপ্লাস্ট খুঁজে ফেরেন, যেটা প্রাণিকোষের উষ্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারবে। প্রাণিদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রায় বেশির ভাগ উদ্ভিদের ক্লোরোপ্লাস্ট টিকতে পারে না।
উপযুক্ত ক্লোরোপ্লাস্ট খুঁজে পাওয়ার পর শুরু হয় আসল চ্যালেঞ্জ। প্রাণিকোষকে বশ মানানোর চেষ্টা করেন তাঁরা, যেন ক্লোরোপ্লাস্টকে ক্ষতিকর মনে করে আক্রমণ না করে। মাতসুনাগা বলেন, ‘ক্লোরোপ্লাস্টকে খাবার হিসেবে কোষে প্রবেশ করালে সেটা দুদিন অক্ষত থাকে। এই সময়ের মধ্যে সালোকসংশ্লেষণের প্রাথমিক বিক্রিয়া শনাক্ত করা সম্ভব।’
মাতসুনাগা ও তাঁর দল কোষের মধ্যে জোর করে ক্লোরোপ্লাস্ট ঢোকানোর বদলে একে খাবার হিসেবে কোষের কাছে উপস্থাপন করেন। ফলে কোষের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটানো সম্ভব হয়, ক্লোরোপ্লাস্টও টিকে থাকে।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল দেখে অবাক হয়ে যান গবেষকেরা। প্রাণিকোষ শুধু ক্লোরোপ্লাস্টকে মেনেই নেয়নি, বৃদ্ধিও হচ্ছিল কোষগুলোর। অর্থাৎ ক্লোরোপ্লাস্ট কোষটিকে কার্যকরভাবে শক্তি যোগান দিয়ে যাচ্ছিল। ‘আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, কারণ আমরা এমন কাজ করে ফেলেছি, যা গত ৫০ বছরে কেউ করতে পারেননি। প্রায় সব জীববিজ্ঞানী হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ বলেন অধ্যাপক মাতসুনাগা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।