নোবেল পুরস্কারকে বিবেচনা করা হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসেবে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯০১ সাল থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত ৯৭৫ জন মানুষকে এ পুরস্কারের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে। এর মাঝে একাধিকবার নোবেল পেয়েছেন চার বিজ্ঞানী। বিরল সম্মাননা পাওয়া এই কৃতি বিজ্ঞানীরা হলেন—ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার, লাইনাস পাউলিং, জন বারডিন এবং মেরি কুরি।
মেরি কুরি
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুবার নোবেলে ভূষিত হন পোলিশ বিজ্ঞানী মেরি স্ক্লোদোস্কা কুরি। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে তিনি এ পুরস্কার পান। মেরি কুরির এই অর্জনের কথা কমবেশি সবাই জানেন। অজানা বিষয় হচ্ছে, মেরি কুরি তাঁর প্রথম নোবেল পুরস্কারের মনোনয়নে প্রাথমিকভাবে বাদ পড়েছিলেন।
১৯০৩ সালে নোবেল কমিটি শুধু হেনরি বেকরেল এবং পিয়ের কুরিকে প্রাথমিকভাবে নোবেলের জন্য মনোনীত করে। মনোনয়নের কথা জানার পর বেশ ক্ষুদ্ধ হন গণিতবিদ গোস্তা মিট্যাগ-লেফলার। তাঁর পরামর্শে পিয়ের কুরি নোবেল কমিটিকে এক চিঠিতে জানান মেরির অবদানের কথা। রেডিয়ামের পারমাণবিক ভর বের করেছিলেন এই নারী। পিয়ের সাফ জানিয়ে দেন, পুরস্কারটা তিনি মেরির সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান।
এরপর নোবেল কমিটি মেরি কুরিকেও পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে এই তিন বিজ্ঞানীকে যৌথভাবে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবেই আয়োজকেরা কুরি দম্পতির পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম আবিষ্কারের উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন। তাঁদের ধারণা ছিল, এ বিষয়টি পরবর্তীতে আবারও পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে।
তাঁদের সেই ধারণা সত্যি হতে মাত্র ৫ বছর সময় লেগেছিল। ১৯১১ সালের ১০ ডিসেম্বর মেরি কুরিকে দ্বিতীয়বারের মতো নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়। এবারে আর পদার্থবিজ্ঞানে নয়। রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য রসায়নে এককভাবে নোবেল পুরস্কারের পান তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯০৬ সালে এক দুর্ঘটনায় পিয়ের কুরির মৃত্যু হয়। তাই দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারের অংশীদার হতে পারেননি তিনি।
লাইনাস পাউলিং
রসায়ন ও শান্তিতে নোবেল পান লাইনাস কার্ল পাউলিং (প্রচলিত উচ্চরণ, লিনাস)। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি, যিনি দুটো নোবেলই পেয়েছিলেন এককভাবে। রাসায়নিক বন্ধনের প্রকৃতি বা অরবিটাল সংকরণ তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান এই মেধাবী বিজ্ঞানী। এর ৮ বছর পরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ১৯৬২ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পান।
পাউলিং বিংশ শতাব্দির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব। রসায়নে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। এছাড়া হাইড্রোজেন বন্ধন, প্রোটিনের ভাঁজ এবং রক্তের হিমোগ্লোবিনের গঠন ও কাজ নিয়ে গবেষণা করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার বিধ্বংসী ক্ষমতা দেখে বিশ্ববাসী। পাউলিং বুঝতে পারেন, মানব সভ্যতার ইতি টানার জন্য একটি পারমাণবিক যুদ্ধই যথেষ্ঠ। এর ভয়াবহতা আঁচ করে কাজে নেমে পড়েন। গবেষণার মাধ্যমে দেখান শুধু ধ্বংসযজ্ঞই নয়, পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে লাখ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে।
পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার জন্য বিশ্ব দরবারে আবেদন করেন তিনি। ৪৯টি দেশের ৮ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানীর সাক্ষর সংগ্রহ করেন। অবশেষে ১৯৬৩ সালে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষেধাজ্ঞা চুক্তিতে একমত হয়।
জন বারডিন
আজকের পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় এসেছে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মতো ইলেকট্রনিকস যন্ত্রের কল্যাণে। এসবের পেছনে জন বারডিনের অবদান অপরিসীম। ট্রানজিস্টর আবিষ্কার করে তিনি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ধারণাই পাল্টে দেন। কয়েক টন ওজনের কম্পিউটার হাতের মুঠোয় এসেছে এই ট্রানজিস্টরের কারণে। জন বারডিন ইতিহাসে একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি পদার্থবিজ্ঞানে দুটি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
তড়িৎ প্রকৌশলী (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার) জন বারডিন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন পদার্থবিজ্ঞানে। সেখানেই তিনি সেমিকন্ডাক্টরের পারমাণবিক কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবে গবেষণার সুযোগ পান।
সেখানে ওয়াল্টার ব্রাটেনের সঙ্গে মিলে আবিষ্কার করেন ট্রানজিস্টর। বর্তমানে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচনা করা যায় এই ট্রানজিস্টরকে। এ আবিষ্কারের ফলে ১৯৫৬ সালে উইলিয়াম বি শকলির সঙ্গে যুগ্মভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জন বারডিন।
এরপর অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাক্টর নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। বর্তমানে সুপারকন্ডাক্টিভিটির যে তত্ত্ব, সেই বিসিএস তত্ত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জন বারডিন। তত্ত্বটির এমন নামকরণ করা হয়েছে তাঁর দুই সহ-গবেষক লিওন এন কুপার ও জন রবার্ট শ্রিফারের সঙ্গে তাঁর নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে—বারডিন-কুপার-শ্রিফার তত্ত্ব বা বিসিএস তত্ত্ব। এই তত্ত্ব প্রদানের জন্য ১৯৭২ সালে এই দুই সহ-গবেষকের সঙ্গে যৌথভাবে আবারও পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান বারডিন।
ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার
রসায়নে দুটি নোবেল পুরস্কার পাওয়া একমাত্র ব্যাক্তি ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার। ইংরেজ এই প্রাণরসায়নবিদ প্রোটিনের গঠন, বিশেষ করে ইনসুলিনের গঠন আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৮ সালে এককভাবে নোবেল পুরস্কার পান। মানবদেহে গ্লুকোজ বিপাক নিয়ন্ত্রণের মূল হরমোন ইনসুলিন। তাঁর কল্যাণে কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগী বেঁচে যান অকাল মৃত্যুর হাত থেকে।
পরে ১৯৮০ সালে আবারও নোবেল পান ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার। নিউক্লিক অ্যাসিডের ক্ষারের বিন্যাস আবিষ্কারের জন্য ওয়াল্টার গিলবার্টের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারের অর্ধাংশ পান তিনি। নিউক্লিক অ্যাসিডের প্রাণরসায়ন নিয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য পল বার্গকে সেবার নোবেল পুরস্কারের বাকি অর্ধেক দেওয়া হয়।
অ্যাডেনিন (A), সাইটোসিন (C), গুয়ানিন (G) এবং ইউরাসিল (U)—নিউক্লিক অ্যাসিডের এই চারটি ক্ষার আবিষ্কার করেন ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার। এই চার মেধাবী বিজ্ঞানী ছাড়াও একাধিক নোবেল জিতে নিয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রথমটি রেড ক্রস। আন্তর্জাতিক সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানের ঝুলিতে এখন পর্যন্ত উঠেছে ৩টি নোবেল পুরস্কার। ১৯১৭, ১৯৪৪ এবং ১৯৬৩ সালে শান্তিতে এই পুরস্কার অর্জন করে রেডক্রস। দ্বিতীয়টি জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা বা ইউএনএইচসিআর (UNHCR)। বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখার জন্য ১৯৫৪ এবং ১৯৮১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করে সংস্থাটি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।