বিনোদন ডেস্ক : পকেটে মাত্র ৫০০০ রুপি নিয়ে বলিউডের মোহময়-চাকচিক্যের দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন মরক্কান-কানাডিয়ান অভিনেত্রী নোরা ফাতেহি। অরেঞ্জ মডেল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে যখন মডেল হয়ে ভারতে আসেন, তখন তার সাপ্তাহিক বেতন ছিল ৩০০০ রূপি। কিন্তু ‘দিলবার’ গানে বলিউডে বাজিমাত করা সেই নোরা আজ প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক, বর্তমানে বলিউডের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে তার নাম।
২০১৪ সালে ‘রোর: টাইগারস অব সুন্দরবন’ দিয়ে বলিউডে যাত্রা শুরু করা নোরা এবছর জায়গা করে নিয়েছেন ফিফা ২০২২ বিশ্বকাপের থিম সং ‘লাইট দ্য স্কাই’-এ। এছাড়া, কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে জনপ্রিয় গান ‘মানিকে মাগে হিথে’র বলিউডি সংস্করণ, যেখানে নিজের নৃত্যশৈলী দেখিয়েছেন নোরা। সব মিলিয়ে ২০২২ সালটাকে ‘একাদশে বৃহস্পতি’ হিসেবে মানতেই পারেন এই আরব অভিনেত্রী! কিন্তু একটি রক্ষণশীল মরক্কান পরিবার থেকে উঠে আসা নোরা ফাতেহির পক্ষে বলিউডের মতো তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটি ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। একাধিকবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের সংগ্রামের কথা জানিয়েছেন নোরা ফাতেহি।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী অভিনেত্রী নোরা ফাতেহি বলিউডে সাড়া ফেলেছেন মূলত তার ‘বেলি ডান্স’ প্রতিভা দিয়ে। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিকে যেখানে খুবই সংকীর্ণ বলে সমালোচনা করা হয় এবং ধারণা করা হয় এখানে স্বজনপ্রীতি সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়, সেখানে নোরা ফাতেহির এই উত্থান অনেকটা স্বপ্নের মতোই।
বলিউড ক্যারিয়ার
৫ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা দীর্ঘাঙ্গী, নোরা ফাতেহির নামের আরবি উচ্চারণ ‘নূরা’, যার অর্থ ‘আলো’… সত্যিকার অর্থেই বলিউডে এসে নিজের প্রতিভার আলো ছড়িয়েছেন নোরা। বলিউডে অভিষেকের আগে নোরা ফাতেহি ‘বিগ বস ৯’ এবং ২০১৬ সালে ‘ঝলক দিখলা যা’র মতো শো-তে অংশগ্রহণ করেছেন। ভাগ্যের চাকা তার ক্ষেত্রে এমনভাবে ঘুরে গেছে যে আজ নোরা নিজেই ‘ঝলক দিখলা যা’র একজন বিচারক!
২০১৪ সালে বলিউডে অভিষেকের পর নোরা একে একে কাজ করেছেন বেশকিছু হিন্দি ও তেলেগু সিনেমাতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সত্যমেভ জয়তে ২, স্ট্রিট ডান্সার, ভারত, স্ত্রী, টেম্পার, ওপিরি ইত্যাদি। তবে অভিনয় প্রতিভার চাইতে নাচ দিয়েই বরং খ্যাতি পেয়েছেন নোরা।
গ্রাজিয়া ইন্ডিয়া’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই অভিনেত্রী জানান, ছোটবেলা থেকেই নিজেই প্রতিভা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন তিনি। তার ভাষ্যে- “আমি নাচতে চাইতাম, গান গাইতে চাইতাম, পারফর্ম করতে চাইতাম এবং এর জন্য সবসময় সুযোগ খুঁজতাম। আমি ভাগ্যবান যে আমার এজেন্ট আমাকে কমার্শিয়াল মডেলিং এর জন্য ভারত কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেসকে বেছে নিতে বলেছিল। শেষ পর্যন্ত বলিউডকেই আমার কাছে সুবিধাজনক মনে হয়েছে। আমার স্বপ্ন পূরণ করতে এবং প্রতিভাগুলো বিকশিত করতে একটা বড় প্ল্যাটফর্ম দরকার ছিল। আমি খুব খুশি যে আমি নিজের সাহস ও যোগ্যতা দিয়ে এটা করতে পেরেছি, বলিউডে আসার সিদ্ধান্তটা সবচেয়ে সেরা ছিল।”
নাচের প্রতি ভালোবাসা
আইটেম গানের জন্য নোরার বিশেষ খ্যাতি থাকলেও, নোরা অন্য সব ক্ষেত্রেও অভিনয় করে যেতে চান। তামিল সিনেমা ‘টেম্পার’-এ ‘ইত্তাজ রেচ্চিপোদাম’ নামের আইটেম গানে তিনি প্রথম পারফর্ম করেন। বলিউডে নোরার প্রথম আইটেম গান ‘দিলবার দিলবার’ মুক্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউটিউবে ২০ মিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করে। এরপরে কুসু, কুসু, নাচ মেরি রানী, সাকি সাকি, গারমি, জালিমা কোকাকোলা এবং সর্বশেষ মানিকে মাগে হিথে, সবকটি গানই ছিল সুপারহিট!
নোরা ফাতেহি জানান, নাচ তার কাছে এমন একটি ভালোবাসা যা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ বুঝতে পারে। নাচের মাধ্যমে তিনি মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে ভালোবাসেন। আফ্রিকান-আরব জাতিগোষ্ঠীর সাথে সংযোগ থাকার এবং ভারতে দীর্ঘদিন বসবাস করার ফলে বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখতে পেয়েছেন নোরা। অভিনেত্রী জানিয়েছেন, এটি তার পেশাগত জীবনে উপকার করেছে। এই যেমন- ‘দিলবার’ গানটি করার সময় তিনি অ্যারাবিক বেলি ডান্স এবং আরবীয় ফ্যাশনের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পেরেছেন। ‘ডান্স উইথ নোরা’ নামের একটি আলাদা উদ্যোগও পরিচালনা করছেন তিনি।
সংগ্রামের গল্প
তরুণ বয়স থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে নোরা ফাতেহিকে। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে কলেজে ড্রপআউট হয়ে যান নোরা, এরপরে আর সেই সীমানায় পা বাড়াননি। বরং নিজের শিল্পী প্রতিভা দিয়ে নিজেকে বৈশ্বিক তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
গতবছর ‘স্টার ভার্সাস ফুড- সিজন ২’ এ এসে নোরা জানিয়েছিলেন, কানাডায় থাকার সময় ১৬-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ওয়েট্রেস হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোতে এই বয়সের সবাই নিজের খরচ নিজেই যোগানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তখন অন্য কোনো চাকরিও পাননি নোরা।
ওই অনুষ্ঠানে নোরা বলেন, “ওয়েট্রেসের চাকরি খুব সহজ কিছু না। ভালো যোগাযোগ দক্ষতা থাকতে হয়, দ্রুত কাজ করতে হয়, স্মৃতিশক্তিও ভালো হতে হয়। কখনো কখনো ক্রেতারা খারাপ আচরণ করলেও তার সাথে মানিয়ে নিতে হতো।”
কিছুদিন আগেই ইউটিউবার আনাস বুখাশের শো-তে হাজির হয়েছিলেন নোরা। ভারতে আসার পর নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে অভিনেত্রী বলেন, “তখন বিষয়টা নিয়ে খুব উত্তেজিত ছিলাম, অনেক সাদাসিধেও ছিলাম। ভারতে আসার পর যেমনটা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই হয়নি। ভেবেছিলাম আমাকে লিমুজিনে করে কেউ নিতে আসবে, একটা স্যুট বানাতে দেয়া হবে, অডিশনে যাবো সেই লিমুজিনে চড়ে… কিন্তু নাহ, এসব কিছুই হয়নি। তখনই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় থাপ্পড়টা খেয়েছিলাম! মানুষের কটূক্তি, প্রত্যাখ্যান, কি বীভৎস সময়ই না পার করেছি আমি!
নোরা আরও জানান, তিনি যেসব জায়গায় অডিশন দিতে গিয়েছিলেন, সেসব পরিচালকরা জানতেন যে তিনি ভারতীয় নন। তা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে ঠাট্টা করার জন্য তাকে হিন্দি লাইন বলতে বলতেন। অভিনেত্রী বলেন, “আমি হিন্দি বলতে না পারলে তারা একে অপরকে হাই-ফাইভ দিত, হাসাহাসি করতো।”
তবে বারবার প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়েও থেমে যাননি নোরা। সব প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে, আর সে কারণেই ফিফা বিশ্বকাপের থিম সং এর মতো অত্যন্ত সম্মানজনক একটি প্রজেক্টে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন ও প্রিয় যা কিছু
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ কয়েকবছর হয়ে গেলেও নোরা ফাতেহির পরিবার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। নোরার জন্ম ১৯৯২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কানাডায়। ওমর ফাতেহি নামে তার এক ভাই রয়েছে বলে জানা গেছে।
অভিনেত্রী নোরা ফাতেহি বেশ ভোজনরসিক এবং বিভিন্ন শো-তে এসেও একথা জানিয়েছেন তিনি। তবে ভোজনরসিক হয়েও কিভাবে ফিটনেস ধরে রাখেন সে সম্পর্কে নোরা বলেন, “আমি যে সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছি, সেখানে চিকন হওয়াকে ভালো চোখে দেখা হয় না। আমরা স্বাস্থ্যবান থাকতেই পছন্দ করি। আমিও সবসময় মোটাসোটা থাকতেই ভালোবাসি, তাই সবসময়ই কিছু না কিছু খাওয়ার মধ্যে থাকি।” খাবারের মধ্যে নোরার সবচেয়ে প্রিয় পদ ইতালিয়ান খাবার স্প্যাগেটি বোলোনিয়ে।
নোরার প্রিয় র্যা পার বাদশাহ ও নিক্কি মিনাজ এবং প্রিয় বই ডেবোরাহ এলিসের ‘দ্য ব্রেডউইনার’। মরক্কান-কানাডিয়ান অভিনেত্রীকে প্রায়ই দেখা যায় দুবাইয়ে অবকাশযাপন করছেন, কারণ এটিই ‘সাকি সাকি’ তারকার প্রিয় গন্তব্য। অভিনেত্রীর ব্যাপারে আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, তিনি কথা বলতে পারেন হিন্দি, ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এই চারটি ভাষায়।
ফিফা বিশ্বকাপের থিম সং প্রকাশের পর রীতিমতো প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন নোরা। এছাড়া, সম্প্রতি তাকে ‘ডান্স দিওয়ানে জুনিয়রস’ শো-তে নীতু কাপুর ও মারজি পেস্তোনির সাথে বিচারকের আসনে দেখা গেছে। সিদ্ধার্থ মালহোত্রা ও অজয় দেবগনের সাথে তার আসন্ন চলচ্চিত্র ‘থ্যাংক গড’ মুক্তি পাবে আগামী ২৫ অক্টোবর।
সূত্র: পিংকভিলা, গ্রাজিয়া ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্তান টাইমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।