শীতকালে প্রায় সবাই ব্যবহার করেন পেট্রোলিয়াম জেলি। স্বাভাবিক। এ সময় ঠোঁট, মুখ, পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বক ফেটে যায়। এ যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতেই সাধারণত ব্যবহার করা হয় পেট্রোলিয়াম জেলি। আসলে শীতের সময় বাতাসের আর্দ্রতা কমে যায়। শুষ্ক বাতাসে ত্বক আর্দ্রতা হারায় দ্রুত। পেট্রোলিয়াম জেলি আসলে ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে। এভাবে এটি ত্বককে ফেটে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।
দেশের প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায় পেট্রোলিয়াম জেলি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কারখানায় এটি তৈরি করে বাজারজাত করে। ভাবতে পারেন, কারখানায় সম্ভবত কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয় এটি। আসল ঘটনা তা নয়। পেট্রোলিয়াম জেলির যাত্রা আরও দীর্ঘ। জ্বালানি তেল বা গ্যাসোলিনের সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে মাটির নিজে চাপা পড়া প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহ থেকে কালক্রমে তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি। সেখান থেকে নানা ধাপ পেরিয়ে কীভাবে পেট্রোলিয়াম জেলি আমাদের হাতে আসে?
এ জেলির মূল উপদান খনিজ মোম ও তেল। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উপজাত হিসেবে এগুলো তৈরি হয়। প্যারাফিন মোম বা মাইক্রোক্রিস্টালাইন মোমের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয় পেট্রোলিয়াম জেলি উৎপাদনে। এর আরেকটি উপদান হলো উচ্চ মানসম্পন্ন ক্ষারীয় তেল (Base Oil)। সেটা খনিজ বা কৃত্রিম তেল হতে পারে। খনিজ তেলের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ তেল বা ভেজিটেবল অয়েলও ব্যবহার করা হয় অনেক সময়। তবে খনিজ তেল এ ক্ষেত্রে বেশি স্থিতিশীল। এর জারণ ও রেন্সিডিটি (খাবার তেল বা চর্বি ভেঙে গিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টির প্রক্রিয়া) প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ফলে এরা উদ্ভিজ্জ তেলের মতো অ্যালার্জি সৃষ্টি করে না।
ক্ষারীয় তেল ও প্যারাফিন মোম তৈরির জন্য প্রথমে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিশেষ ট্যাংকের মধ্যে রেখে উত্তপ্ত করা হয়। এখানে পাতন প্রক্রিয়ায় তেলের বিভিন্ন হালকা উপাদান, যেমন গ্যাসোলিন, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদি আলাদা করা হয়। এরপর যা অবশিষ্ট থাকে, তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় আরেকটি বায়ুনিরোধক ট্যাংকে। এখানে চাপ কমিয়ে অপরিশোধিত তেলের অবশিষ্টাংশ বের করা হয়। উৎপাদ হিসেবে পাওয়া যায় লুব্রিকেন্ট তৈরির কাঁচামাল।
ট্যাংকের নিচে পড়ে থাকা বাকি অংশ এবার ডিঅ্যাসফল্টিং ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ইউনিটের মূল কাজ অপরিশোধিত তেল থেকে অ্যাসফল্ট বা একই ধরনের উপাদানগুলো আলাদা করে ফেলা (ঠিক ধরেছেন, সড়কে যে অ্যাসফল্টের আবরণ দেওয়া হয়, এটা তা-ই)। এখান থেকে দুটি জিনিস পাওয়া যায়—বিটুমিন ও ডিঅ্যাসফল্টেট (বা অ্যাসফল্টহীন) তেল। এখানেই শেষ নয়। আরও দুই ধাপে এই তেল পরিশোধন করে পাওয়া যায় ক্ষারীয় তেল ও মোম। এই মোম পেট্রোলিয়াম জেলি তৈরির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলতে পারেন, জেলির প্রধান কাঁচামাল।
পরের ধাপে বিভিন্ন অনুপাতে মোম, তেল ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হয় পেট্রোলিয়াম জেলি। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়াম জেলি তৈরির জন্য উদ্ভিজ্জ তেল, খনিজ উপাদান ও ক্ষারীয় উপাদান যোগ করা হয়।
যেসব পেট্রোলিয়াম জেলিতে মোমের পরিমাণ বেশি থাকে, সেগুলোর গলনাঙ্ক বেশি। বর্তমানে আমরা যে চ্যাপস্টিক ব্যবহার করি, সেটা সাধারণ পেট্রোলিয়াম জেলির মতো সহজে গলে না। কিন্তু লিপজেল সাধারণ তাপমাত্রায় অর্ধতরল অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম জেলি হলেও এর গলনাঙ্ক অনেক কম। কারণ, এতে তেলের পরিমাণ বেশি। এভাবেই প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রকম পেট্রোলিয়াম জেলি তৈরি করা হয়।
এরপর প্লাস্টিক বা স্টেইনলেস স্টিলের মোড়কে পেট্রোলিয়াম জেলি আসে দোকানে। সেখান থেকে আসে আমাদের হাতে।আজ যে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করছেন, তা নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমাদের হাতে এসেছে। এর সঙ্গে মিশে আছে লাখ লাখ বছরের পুরাতন প্রাণী বা উদ্ভিদের পরমাণু। ভাবতেই অবাক লাগে, তাই না?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।