বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: পুরোনো মোবাইল ফোন মেরামতের জন্য ডিসপ্লে, ক্যামেরা, মাদারবোর্ড, কেসিং, ব্যাটারিসহ নানারকম যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। তাই মেরামতের নামে চীন থেকে আমদানি করা হয় নিম্নমানের এসব উপাদান। এর পর সেগুলো সংযোজন করে তৈরি হয় নতুন মোবাইল ফোন। নকিয়া ও স্যামসাংয়ের লোগোযুক্ত ফোনগুলো দেখতে হুবহু আসল ফোনের মতো। কিন্তু সরঞ্জামগুলো নকল হওয়ায় দুই-তিন মাসেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্রেতা। সেই সঙ্গে মারাত্মক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছেন তারা। দৈনিক সমকালের প্রতিবেদক ইন্দ্রজিৎ সরকার-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
সম্প্রতি নকল মোবাইল ফোন উৎপাদনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে একটি চক্রকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানতে পারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, নকল ফোনে ভুয়া ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (আইএমইআই) নম্বর ব্যবহার করা হয়। এতে এগুলোর অবস্থান শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে অপরাধীরা বিভিন্ন অপকর্ম সংঘটনে এসব ফোন ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে নকল মোবাইল ফোন ব্যবহারের আটটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও জানিয়েছেন তারা।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, নকল ফোন প্রস্তুতকারক চক্রের মূল উদ্দেশ্য প্রতারণার মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা। কিছুটা কম দামে পাওয়ায় তারা এসব ফোন কিনে ঠকছেন। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই।
ডিবি কর্মকর্তারা জানান, নকল মোবাইল ফোন ব্যবহারের বেশ কিছু ঝুঁকি বা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। সেগুলো হলো- ফোনে থাকা তথ্য-ছবি বেহাত হওয়া বা নিরাপত্তা ঝুঁকি, ম্যালওয়ার আক্রমণের আশঙ্কা, র্যানসমওয়ার ভাইরাস আক্রমণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নষ্ট হওয়া, সঠিক সময়ে আপডেট না হওয়ায় ফোন অচল হওয়া, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি, নেটওয়ার্ক ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় কলড্রপ, নিম্নমানের যন্ত্রাংশের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরিবেশের ক্ষতি এবং নিম্নমানের চার্জার ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যাটারির কারণে বিস্ম্ফোরণের শঙ্কা।
আসল ফোন চেনার জন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছে ডিবি। সেগুলো হলো- ইংরেজিতে কেওয়াইডি স্পেস ১৫ ডিজিটের আইএমইআই নম্বর লিখে ১৬০০২ নম্বরে পাঠালে আসল ফোনের তথ্য মিলবে। বাহ্যিকভাবে যাচাইয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাবে- নকল ফোনের বাটনগুলো সাধারণত এলোমেলো সাজানো থাকে, লেখার ফ্রন্টগুলো তুলনামূলক ছোট, ডিসপ্লে ঝকঝকে পরিস্কার হয় না, ক্যামেরার ছবি ভালো হয় না, নেটওয়ার্ক থাকে দুর্বল, ব্যাটারিতে ভুয়া তথ্য সংবলিত স্টিকার থাকে। তাছাড়া আসল ফোন ২-৩ বছর ব্যবহার করা গেলেও নকল ফোন মাত্র ৩-৪ মাস চলে।
ডিবি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে নকিয়ার অনুমোদিত প্রস্তুতকারক ও পরিবেশক ইউনিয়ন টেক পার্ক লিমিটেডের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন জানতে পারেন, মোতালেব প্লাজার বিভিন্ন দোকানে নকিয়ার সিলযুক্ত নকল ফোন বিক্রি হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা পেয়ে তিনি শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলাটির ছায়াতদন্ত করে ডিবি সাইবার পুলিশ। এক পর্যায়ে গত ৯ অক্টোবর রাজধানীর হাতিরপুল থেকে বিপুল পরিমাণ নকল মোবাইল ফোনসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণি পাস সাধারণ মেকানিকরাই নানারকম যন্ত্রাংশ সংযোজন করে বানায় নতুন ফোন।
ডিবির তদন্ত সংশ্নিষ্টরা জানান, নকল ফোন তৈরির ক্ষেত্রে তিনটি ধাপে কাজ করে অপরাধীরা। প্রথমে অবৈধ প্রক্রিয়ায় মোবাইল ফোনের নিম্নমানের যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়। এর পর এক শ্রেণির দালালের মাধ্যমে সেগুলো দ্বিতীয় ধাপের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে তারা। এই ধাপে ব্যবসায়ীরা যন্ত্রাংশগুলো নিজস্ব কারিগর দিয়ে সংযোজন করে ভুয়া আইএমইআই নম্বর বসিয়ে নকল ফোন তৈরি করে। বিভিন্ন প্রেস থেকে নকল ফোনে ব্যবহূত লোগো, স্টিকার ও মোড়ক ছাপিয়ে নেওয়া হয়। তৃতীয় ধাপের ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় এসব ফোন পাইকারি দামে কিনে সাধারণ ক্রেতার কাছে আসল ফোন হিসেবে বিক্রি করেন।
ইউনিয়ন লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (বিজনেস অপারেশন) আজমল হাসান বলেন, নকল ও নিম্নমানের ফোনের মাধ্যমে একদিকে গ্রাহক প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। রপ্তানির ক্ষেত্রেও নানারকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।