১৬৫৩ সালে ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স সূর্যের দূরত্ব মাপেন শুক্র গ্রহের দশা কাজে লাগিয়ে। কৌশলটা অ্যারিস্টার্কাসের মতোই। চাঁদের বদলে শুক্র—এই যা। অ্যারিস্টার্কাসের চেয়ে এ পরিমাপ বেশি নির্ভুল ছিল। কারণ, তত দিনে টেলিস্কোপের আবিষ্কার আকাশ পর্যবেক্ষণ সহজ করে দিয়েছে। তবে তাঁর এ পদ্ধতিতে শুক্রের আকার অনুমান করে নিতে হয়েছিল। অনুমান পরে সঠিক প্রমাণিত হলেও পদ্ধতিটাকে বৈজ্ঞানিক বলা যায় না। এ কারণে তাঁকে এ কাজের জন্য কৃতিত্বও দেওয়া হয় না।
১৬৭২ সালে জোভান্নি ক্যাসিনি (প্রচলিত উচ্চারণ, জিওভান্নি ক্যাসিনি) প্যারালাক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব মাপেন। প্যারালাক্সের জন্য আলাদা অবস্থান থেকে পরিমাপ নিতে হয়। বন্ধু জঁ রিচেকে তাই পাঠিয়ে দিলেন ফ্রেঞ্চ গায়ানার কেইয়েন শহরে। নিজে রইলেন প্যারিসে।
দুজনে একই সময়ে দূরবর্তী পটভূমি তারার সাপেক্ষে মঙ্গলের অবস্থান দেখলেন। দুই শহরের দূরত্ব জানা। হিসাব কষে বের করে ফেললেন মঙ্গলের দূরত্ব। তত দিনে সূর্য ও বিভিন্ন গ্রহের আপেক্ষিক দূরত্বের অনুপাত জানা হয়ে গিয়েছিল। সূর্যের দূরত্ব বের করতে তাই পৃথিবী থেকে যেকোনো একটি গ্রহের দূরত্ব বের করলেই হতো। সেটাই করে ফেলেন ক্যাসিনি। তাঁর মাপা সূর্যের দূরত্ব ছিল ১৩.৮ কোটি কিলোমিটার (প্রকৃত মান প্রায় ১৫ কোটি)।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, চাঁদের ক্ষেত্রে করা গেলে সূর্যের ক্ষেত্রে কেন প্যারালাক্স পদ্ধতি সরাসরি ব্যবহার করা হয়নি? প্যারালাক্স দিয়ে সূর্যের দূরত্ব মাপা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথমত, সূর্য দেখতে বৈশিষ্ট্যহীন। তার ওপর অতি ঔজ্জ্বল্য এর আশপাশে ও পেছনে থাকা তারাদের উধাও করে দেয়। পটভূমির এ তারাগুলো দেখা না গেলে প্যারালাক্সের কোণের পরিবর্তন মাপা যায় না। কোণের পরিবর্তন বুঝতে পটভূমি থাকা চাই।
তবে গ্রহদের অতিক্রমণ কাজে লাগিয়েও সূর্যের প্যারালাক্স বের করা যায়। অতিক্রমণের সময় পৃথিবী থেকে দেখা যায়, গ্রহগুলো নক্ষত্রের (এ ক্ষেত্রে সূর্য) সামনে চলে এসেছে। সূর্যের গায়ে দেখা যায় কালো বিন্দুর মতো। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এ অতিক্রমণ দেখতে হবে আলাদাভাবে। কোথাও দেখা যাবে ছোট বিন্দু, কোথাও-বা বড়। জেমস গ্রেগরি বুধ গ্রহের অতিক্রমণের মাধ্যমে প্যারালাক্স বের করার কথা ভাবেন। তবে এডমন্ড হ্যালি দেখালেন, শুক্র গ্রহ দিয়ে কাজটা আরও নির্ভুলভাবে হবে।
কিন্তু শুক্র গ্রহের অতিক্রমণ অনেক দুর্লভ ঘটনা। জীবনে একবার পাওয়ার মতো। যদিও অতিক্রমণ জোড়ায় জোড়ায় ঘটে। মানে, ১০০ বছরের বেশি সময় পর দুবার ঘটে। কাছাকাছি দুই অতিক্রমণের মধ্যে সময়ের পার্থক্য ১০ বছরের কম। হ্যালি বুঝতে পারলেন, এ পদ্ধতিতে দূরত্বটা বের করা যাবে। তবে এ–ও বুঝলেন, পরবর্তী অতিক্রমণ পর্যন্ত নিজে বেঁচে থাকবেন না। (সেটাই হয়েছিল। পরবর্তী অতিক্রমণ হয় ১৭৬১ সালে।
তাঁর মৃত্যু হয় ১৭৪২ সালে।) তাই ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য একদম নিখুঁত নির্দেশনা লিখে গেলেন। বলে গেলেন পর্যবেক্ষণের খুঁটিনাটি কৌশল। ফলাফল কাঙ্ক্ষিত মান পর্যন্ত নির্ভুল করতে অতিক্রমণের সময়টা কয়েক সেকেন্ড এদিক-সেদিকও হতে পারবে না। পর্যবেক্ষণের ভিন্ন ভিন্ন জায়গার দূরত্ব হতে হবে বিশাল। মেঘ যাতে পরীক্ষাটা নষ্ট করে দিতে না পারে, সে জন্য সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিকল্প স্থান থেকে কাজটা করতে হবে। এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে কয়েক বছর লেগে যেত।
এত সব বাধার মুখেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের জ্যোতির্বিদেরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। ১৭৬১ সালের অতিক্রমণ ঘিরে সাজালেন পরিকল্পনা। কিন্তু এর মধ্যেই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। বিখ্যাত সেভেন ইয়ারস ওয়ার। সমুদ্রপথে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব হয়ে গেল। কিন্তু অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানল সব। সব জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ সম্ভব হলো না। কোথাও বাধা হলো মেঘ, কোথাও-বা যুদ্ধজাহাজ। তবু কিছু পর্যবেক্ষণ হলো। ৮ বছর পর ১৭৬৯ সালে হলো আরেকটি অতিক্রমণ। দুই অতিক্রমণের উপাত্ত মিলিয়ে ভালো রসদের জোগান মিলল।
সব উপাত্ত মিলিয়ে সূর্যের দূরত্ব বের করলেন ফরাসি জ্যোতির্বিদ জিরোম লালাঁন্ড। মান পেলেন ১৫.৩ কোটি কিলোমিটার, যা প্রকৃত মানের ৩ শতাংশ এদিক-ওদিক মাত্র। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের কথা ভাবলেই মনে রাখতে হবে, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর (বা অন্য গ্রহের) কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। দূরত্ব তাই বাড়ে-কমে। আমরা সাধারণত যে দূরত্বের কথা বলি, তা গড় দূরত্ব৷ ফলে এক বছরে এমনিতেও গড় মানের ৩ শতাংশ এদিক-সেদিক ওঠানামা হয়। গড় দূরত্বটাই বর্তমানে এক এইউ (AU) বা সৌরজাগতিক একক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বর্তমান মান ১৪.৯ কোটি কিলোমিটারের মতো।
সমস্যাটার আরও সহজ সমাধান আছে সূর্যের দূরত্বের মধ্যেই। পৃথিবী এক বছরে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে। কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। তার মানে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরতে গিয়ে নিজের অবস্থান থেকে ২ এইউ পর্যন্ত সরে আসে। কক্ষপথের দুই বিপরীত অবস্থান থেকে কোনো তারাকে দেখলেই প্যারালাক্স কোণের ভালো মান পাওয়া যাবে। একবার ভাবুন, পৃথিবীর দুই পাশ থেকে দেখার তুলনায় কত বিশাল দূরত্বের ব্যবধান থেকে দেখা সম্ভব হচ্ছে! পৃথিবীর ব্যাস মাত্র ১২ হাজার ৭৪২ কিলোমিটার। আর সেখানে কক্ষপথের বিপরীত বিন্দুর সর্বোচ্চ দূরত্ব প্রায় ১৫.২ কোটি কিলোমিটার।
প্যারালাক্স থেকে প্রাপ্ত কোণের বিপরীত সংখ্যাই দূরত্ব। মানে কোণ দিয়ে ১-কে ভাগ দিতে হবে। কোণের একক হবে আর্কসেকেন্ড। এক ডিগ্রিকে ৬০ ভাগ করলে হয় ১ আর্কমিনিট। ৬০ দিয়ে আবারও ভাগ করলে হয় আর্কসেকেন্ড। এবার একটা সরল হিসাব করি। সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা সেন্টাউরি। এর প্যারালাক্স ০.৭৬৮ আর্কসেকেন্ড। তাহলে এর দূরত্ব ১/০.৭৬৮ = ১.৩ পারসেক। দূরত্বের এই এককই জ্যোতির্বিদেরা ব্যবহার করেন। একে আলোকবর্ষ বানাতে ৩.২৬ দিয়ে গুণ করুন। পাওয়া যাবে ৪.২৪ আলোকবর্ষ।
দূরের নক্ষত্রের ক্ষেত্রে প্যারালাক্সের মান অনেক ছোট হয়ে আসে। যন্ত্রের আধুনিকায়ন সেই ক্ষুদ্র দূরত্বকেও নিয়ে আসে হাতের নাগালে। এই যেমন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এর ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা থ্রি ৪০ মাইক্রো আর্কসেকেন্ড কোণও মাপতে পারে। পরিমাণটা ১ ডিগ্রির ৩৬০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। দূরত্ব মাপা যায় ১৬ হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত। এভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে মহাবিশ্বের ধাঁধা সমাধান করতে সাহায্য করে যায় মানুষকে। আরও বড় দূরত্ব মাপারও কায়দা আছে। সে গল্প তোলা থাকল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।