ধর্ম ডেস্ক : স্ত্রীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) হলেন সর্বোত্তম মানুষ। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চাইতে উত্তম…।’
প্রিয় নবি (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন কর।’ (সূরা নিসা, ৪ : ১৯)। স্ত্রীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) হলেন সর্বোত্তম মানুষ। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চাইতে উত্তম…।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৩৮৯৫)।
স্ত্রীদের তিনি প্রেম-ভালোবাস ও মমতার আচরণে আগলে রাখতেন। তাদের সঙ্গে সুন্দর আচার-ব্যবহার ছিল তার পারিবারিক জীবনের অন্যতম ভূষণ। স্ত্রীদের থেকে প্রাপ্ত অসংলগ্ন ও অসংগতিপূর্ণ আচরণগুলোতে তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন। তাদের ছোটখাটো ভুলগুলোকেও তিনি এড়িয়ে যেতেন। দাম্পত্য জীবনের প্রকৃত সুখ বলতে যা আমরা বুঝি তার সবই ছিল রাসূল (সা.)-এর পরিবারে। নিম্নে তার দাম্পত্য জীবনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
স্ত্রীদের সঙ্গে সময় কাটান: একান্ত সময় কাটান স্ত্রীদের খুবই উপভোগ্য বিষয়। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এমন দিন খুব কমই যেত, যেদিন তিনি আমাদের সবার কাছে আসতেন না। সব স্ত্রীর সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ হতেন। তবে সহবাস করতেন না। অতঃপর যার কাছে রাতযাপনের পালা হতো, তিনি সেখানে রাতযাপন করতেন।’ (আবু দাউদ : ২১৩৫)। স্বামীকে অবশ্যই একটা সময় নির্দিষ্ট করতে হবে স্ত্রীর জন্য। প্রতিদিন সকালে রাসূল (সা.) একে একে সবকজন স্ত্রীর কাছে যেতেন। তাদের সালাম করতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন। এরপর যেদিন যার পালা হতো তার কাছেই চলে যেতেন। অন্য এক হাদিসে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আসরের পর রাসূল (সা.) স্ত্রীদের কাছে আসতেন। সবার সঙ্গে দেখা করতেন। এরপর একজনের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতেন।’ (বুখারি : ৫২১৬)।
অগাধ ভালোবাসা: স্ত্রীদের প্রতি রাসূল (সা.)-এর আচরণ ছিল সীমাহীন ভালোবাসাপূর্ণ। স্ত্রীর জীবদ্দশায় যেমন তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন তেমনি তার মৃত্যুর পর তার প্রতি মনের ভালোবাসা বজায় রাখতেন। খাদিজা (রা.) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার অন্তরে তার ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসলিম : ২৪৩৫)। আলোচনা এলেই রাসূল (সা.) তার প্রশংসা করতেন। তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
আয়েশা (রা.) কে তিনি অত্যন্ত মহব্বত করতেন। তার এ অনুরাগের কথা তিনি গোপন রাখতেন না। আমর বিন আস (রা.) একবার রাসূল (সা.)কে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? রাসূল (সা.) উত্তর দিলেন, ‘আয়েশা।’ আমর (রা.) এরপর জানতে চাইলেন, পুরুষদের মধ্যে কে? রাসূল উত্তর দিলেন, ‘আয়েশার বাবা।’ (সহিহ বুখারি : ৩৬৬২)।
পানাহার: পানপাত্রের যে অংশে মুখ লাগিয়ে আয়েশা (রা.) পানি পান করতেন ঠিই সেই একই অংশে মুখ লাগিয়ে বিশ্বনবি (সা.) পানি পান করতেন। তার পান করা অবশিষ্ট পানিও তিনি পান করতেন। যদিও তিনি ওই সময় ঋতুবতী অবস্থায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) তাঁকে গোশতযুক্ত হাড় খেয়ে দিতেন। বিশ্বনবি (সা.) ঠিক সেই একই জায়গায় মুখ লাগিয়ে গোশত খেতেন যেখানে মুখ লাগিয়ে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) খেয়েছেন।
ঘুম: আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি ঋতুবতী অবস্থায় থাকলেও নবিজি (সা.) আমার কোলে ঠেস দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।’ (বুখারি : ৩৬৭২)। একবার এক সফরে আয়েশা (রা.)-এর হার হারিয়ে গেল। ফলে কাফেলাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থামতে হলো, যেখানে পানি ছিল না। তখন আবু বকর (রা.) মেয়েকে তিরস্কার করে বললেন, তোমার কারণে পুরো কাফেলা কষ্টে পড়ে গেল। এ সময় তাকে তিরস্কার স্বরূপ আবু বকর (রা.) আঙুল দিয়ে কোমরে ধাক্কা দিতে লাগলেন। আয়েশা (রা.) বলেন, তখন আমার ঊরুর ওপর রাসূল (সা.) মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন। রাসূল (সা.) আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমি একটুও নড়িনি।’ (বুখারি : ৪৬০৭)।
মধুর নামে সম্বোধন: রাসূল (সা.) আয়েশা (রা.)কে হুমায়রা নামেও ডাকতেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘কিছু হাবশি বালক মসজিদে খেলাধুলা করছিল। রাসূল (সা.) আমাকে ডেকে বললেন, হুমায়রা, তুমি কি তাদের খেলাধুলা দেখতে চাও?…’ (আস-সুনানুল কুবরা : ৮৯৫১)। এমনকি তিনি আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)কে উম্মে আব্দুল্লাহ উপনামেও ডাকতেন। যদিও তার কখনো সন্তান হয়নি। আদর-সোহাগ ও ভালোবাসা প্রকাশে রাসূল (সা.) স্ত্রীকে এভাবে সম্বোধন করতেন। আর স্ত্রীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর নামগুলো নির্বাচন করতেন।
অনুভূতির প্রতি সম্মান: তিনি (সা.) বুঝতেন কখন তাঁর স্ত্রী তাঁর ওপর সন্তুষ্ট আর কখন অসন্তুষ্ট। মহানবি (সা.) আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)কে বললেন, আয়েশা, তুমি কখন আমার ওপর খুশি থাক আর কখন রাগান্বিত হও, তা আমি বুঝতে পারি। আমি বললাম, আপনি কী করে তা বুঝতে সক্ষম হন? তখন তিনি বললেন, তুমি আমার ওপর প্রসন্ন থাকলে বলো, না! মুহাম্মাদের রবের কসম। আর যখন তুমি রেগে থাক তখন বলো, না! ইবরাহিমের রবের কসম। শুনে আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! কেবল আমি আপনার নামটাই মুখে আনি না।’ (বুখারি : ৫২২৮)। প্রত্যেক পুরুষেরই উচিত নিজ স্ত্রীর রাগ-অভিমানের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তার অনুভূতির প্রতি সচেতন থাকা,।
ধৈর্যধারণ: ‘কোনো একবার আবু বকর (রা.) রাসূল (সা.)-এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ওই সময় তিনি আয়েশা (রা.)কে জোর গলায় রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে কথা বলতে শুনলেন। অনুমতি পেয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। এরপর তিনি আয়েশা (রা.)কে ‘হে উম্মে রুমানের মেয়ে বলে সম্বোধন করলেন। আর তাকে ধরে বললেন, ‘তুমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলছ!’ ঠিক ওই সময় নবিজি বাবা ও মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আবু বকরকে থামালেন। আবু বকর (রা.) বের হয়ে গেলে রাসূল (সা.) আয়েশা (রা.)কে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বললেন, ‘দেখলে কীভাবে তোমাকে ওই লোকের হাত থেকে বাঁচালাম?’ এর কিছুক্ষণ পর আবু বকর (রা.) আবারও প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ভেতরে এসে তাদের দুজনকেই হাসতে দেখলেন। আর তাদের বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যুদ্ধের সময় আপনারা যেভাবে আমাকে দলে নিয়েছিলেন, সন্ধির সময়ও সেভাবে দলে নিন।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৯২৭)। নারীদের সঙ্গে সব সময় ইতিবাচক মনোভাব ও আচরণ বজায় রাখা একজন দায়িত্বশীল স্বামীর পরিচয়। তাদের ওপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করা ঘৃণিত কাজ হিসাবে বিবেচিত।
বিনোদন: আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার আমি রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে সফরে বের হলাম। তখনো আমি কিশোরী। শারীরিকভাবে হালকা ছিলাম। শরীরে তেমন মেদ জমেনি। রাসূল (সা.) সাহাবিদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে তারা এগিয়ে গেল। এরপর রাসূল (সা.) আমাকে বললেন, চলো, দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমরা প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি তাকে হারিয়ে দিলাম। তিনি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলেন। (এরপর অনেক সময় কেটে গেল) আমার শরীর মোটা হতে লাগল। দেহে মেদ জমল। ততদিনে আগের প্রতিযোগিতার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কোনো এক সফরে রাসূল (সা.) সাহাবিদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। রাসূল (সা.)-এর আদেশে তারা এগিয়ে গেল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, চলো, দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমি এবারও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম। এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে দিয়ে বিজয়ী হলেন। হাসতে লাগলেন। বললেন, এ বিজয় সেই বিজয়ের বদলা।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৫৭৪৫;)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।