বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে থাকা গুগলে চাকরি পাওয়াটা সবার কাছে স্বপ্নের মতো। শুধুমাত্র শিক্ষানবীশদেরই বেতন বছরে প্রায় ৮০ হাজার ডলারের মত। ছয় অঙ্কের বেতন দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদেরকে, যে সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার ডলারের সমান। গত কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশিরাও এই বিশাল প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠানটিতে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। মেধার ভিত্তিতে যথেষ্ট যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে তারা উতড়ে যাচ্ছে গুগলের পরীক্ষায়। শামিল হতে পারছে চূড়ান্তভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় চার হাজার জনশক্তির মধ্যে, যাদেরকে প্রতিবছর খুঁজে বের করা হয় প্রায় ২৫ লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে। চলুন, জেনে নেওয়া যাক- কীভাবে তারা এই সৌভাগ্যের অধিকারী হচ্ছে। খবর ইউএনবি’র।
গুগলে চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা
প্রোগ্রামিং-এর দক্ষতা
প্রযুক্তিগত দক্ষতার ভেতর শীর্ষস্থানীয় হচ্ছে প্রোগ্রামিং ভাষা জানা। গুগলের মত টেক জায়ান্টরা জাভা অথবা পিএইচপি, সিপ্লাসপ্লাস, পাইথন-এর মত ভাষাগুলোর সঙ্গে জাভাস্ক্রিপ্ট বা গো ল্যাঙ-এর সন্নিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে দরকার হয় ডেটা স্ট্রাকচার ও ইলেক্ট্রিক্যালের ব্যবহারিক জ্ঞান। ওয়েব সকেট বা ওয়েব এসেমব্লি’র ব্যাপারে প্রয়োজন হবে যথেষ্ট অনুশীলনের অভিজ্ঞতা।
এক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি তা হলো, শুধু শিখলেই হবে না, সময়ের সঙ্গে সফটওয়্যারগুলোর সর্বশেষ হালনাগাদকৃত সংস্করণের সঙ্গেও অভ্যস্ত থাকতে হবে। কেননা এই বৃহৎকার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদাই নতুন প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গুগলের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি কাজ হলো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে। তাই এখানে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোডিং তথা প্রোগ্রামিং জানা বাধ্যতামূলক।
অপারেটিং সিস্টেম
কম্পিউটার থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের প্রতিটি ডিজিটাল ডিভাইসের ইন্টারফেস পরিচালিত হয় ভিন্ন ভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম দ্বারা। বহুল পরিচিত অপারেটিং সিস্টেমগুলোর মধ্যে আছে স্মার্টফোনে চলা গুগলের অ্যান্ড্রয়েড, পিসিতে চলা মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ। অ্যাপলের ডিভাইসগুলোর জন্য তাদের আছে আইওএস। গুগলের কাজ যেহেতু মানুষের হাতে হাতে ঘুরে ফেরা এই ডিভাইসগুলো নিয়ে, তাই অপারেটিং সিস্টেমগুলোর কনফিগার করা নিয়ে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
অ্যালগরিদম এবং ডেটা সোর্স
প্রতিটি সফটওয়্যারের কার্যপ্রণালীর পেছনে কাজ করে অ্যালগরিদম। যেমন- স্টক, কিউই সহ কুইকসার্ট, ব্যাগ, হিপসর্ট এবং মার্জসর্ট। এগুলো কীভাবে সাজাতে হয়, কীভাবে কাজ করতে ডেটা সোর্স নিয়ে, এ সবকিছুর ব্যবহারিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
কম্পাইলার্স গঠন শেখা
কম্পিউটারের ভাষাকে ব্যবহারকারিদের বোধগম্যতার জন্য প্রয়োজন হয় ভাষাগুলোকে কম্পাইল করার। এখানেই উচ্চমানের ভাষা ডিজাইন করার কথা আসে। যেমন- এইচএইচভিএম বা পিএইচপি এবং বাইনারি কম্পাইলের ব্যাপারে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার। যন্ত্রের ভাষাটি যত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সহজ হয়ে উঠবে, ইঞ্জিনিয়ারের দক্ষতাও সে সঙ্গে প্রমাণিত হয়। এর জন্য ভাষাগুলোর পদ্ধতিগত গঠনের নিমিত্তে কম্পাইলারের অবকাঠামো সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
গাণিতিক বিদ্যা
যারা স্কুল-কলেজে গাণিতিক হিসাব-নিকাশে পটু তাদের জন্য সুসংবাদ। গাণিতিক গবেষণায়; সোজা কথায় যারা খুব নিক্ষুতভাবে অঙ্ক কষতে পারেন তাদের দক্ষতাকে গুগল সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। যারা ইতোমধ্যে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছেন এবং গাণিতিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করেছেন, তাদের গুগলের চাকরির জন্য প্রাথমিক অভিজ্ঞতা নেয়া হয়ে গেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা
প্রযুক্তি উন্নয়নের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র এখন রোবোটিক্সের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই টেক জায়ান্টদেরও সার্বক্ষণিক দৃষ্টিপাত এইএআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের ওপর। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও বেশ কয়েক বছর ধরে রোবোটিক্সের প্রতি শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে আসছে। শুধু প্রাথমিক ধারণা নয়, গুগলের চাকরিপ্রার্থীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের জ্ঞানও থাকা বাঞ্ছনীয়।
সাইবার সিকিউরিটি
শুধু অতিবেগুনী রশ্মি নয়, পুরো পৃথিবী এখন আরও একটি বলয় দিয়ে ঘেরা। আর তার নাম হচ্ছে সাইবার অ্যাক্টিভিটি। প্রতিমুহূর্তে ইমেইল, ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট এবং ব্যাংক একাউন্ট-এর মত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গোপন তথ্যাবলী হ্যাক হচ্ছে। এই বিড়ম্বনাটি সৃষ্টি করেছে সাইবার নিরাপত্তার চাহিদা। এক মালিকানা থেকে বহুজাতি মাল্টিপার্পাস প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ ব্যয় করছে সাইবার সিকিউরিটির পেছনে।
শুধু গুগল-ই নয়; সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্টদের চাহিদা এখন সারা বিশ্ব জুড়ে। এছাড়া অতি দ্রুত পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে মুদ্রাহীন ডিজিটাল লেনদেনের দিকে। এরকম ব্যবস্থায় সাইবার সিকিউরিটির কোনো বিকল্প নেই।
টিমওয়ার্ক
সফট স্কিলের মধ্যে গুগলের চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি চাওয়া হচ্ছে সেটি হলো- দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার দক্ষতা। এটি অনেক ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি মানসিকতার সঙ্গে জড়িত থাকে, কেননা অনেক প্রযুক্তিবিদই একা কাজ করতে পছন্দ করেন।
কিন্তু গুগল এই অনুশীলনকে নিরুৎসাহিত করে। কারণ একজনের মস্তিষ্ক একটি প্রোজেক্টের জন্য সমুদয় ধারণা সরবরাহ করতে সক্ষম নয়। সেখানে যদি দুই বা ততোধিক মস্তিষ্ক যুক্ত হয় তখন শুধু লক্ষ্য অর্জনের ধারণাই পাওয়া যায় না, কাজটি দ্রুত গতিতে কম সময়ে সমাধানও করা যায়। গুগল কোয়ালিটির পাশাপাশি কোয়ান্টিটিও নিশ্চিত করতে চায়। আর তাই তারা আশা করে একাধিক মস্তিষ্কের সম্মিলিত প্রচেষ্টার।
দ্রুত শেখার সক্ষমতা
একজন মানুষ সব বিষয়ে জানবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অজানা সেই কাজটি চালানোর জন্য সঠিক জ্ঞান অর্জন একটি কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা। আর এটি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় গুগলের সাক্ষাৎকারের সময়। অতিরিক্ত ঝামেলায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুঝে শুনে কাজ করাটা একজন ব্যক্তি মানসিক দক্ষতার পরিচয় দেয়।
দ্রুত শিখে নেয়ার সঙ্গে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টিকে একত্রে বলা যেতে পারে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা। এটি শুধু মানুষ নিয়ে কারবার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই প্রয়োজন নয়, একটি সফটওয়্যারের হাজার পৃষ্ঠার কোডিং ঝামেলা শামলানোর জন্যও খাপ খাইয়ে নেয়াটা দরকার।
গুগলে চাকরির জন্য আবেদন প্রক্রিয়া
গুগলের বিভিন্ন পদে নতুন লোক নেয়াটা বলা যায় নিয়মিতই ঘটতে থাকে। এই নিয়োগের জন্য পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন ধাপে অনুষ্ঠিত অনলাইন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের পর সামনাসামনি ইন্টারভিউ হয় আর এভাবেই কাঙ্ক্ষিত কর্মীটির যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ইন্টার্নশিপ এবং সরাসরি চাকরি দুইভাবে গুগল লোক নিয়ে থাকে। এই সময় গুগলে চাকরির আবেদন করার জন্য নিম্নোক্ত উপায়গুলো অনুসরণ করতে হবে।
গুগল ক্যারিয়ার ওয়েবসাইট
গুগল ক্যারিয়ার ওয়েবসাইটে গেলে বর্তমান সময়ে আবেদনের জন্য উন্মুক্ত থাকা চাকরির তথ্য পাওয়া যাবে।
চাকরির আবেদন ফর্ম পূরন
প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চাকরির জন্য আলাদা আবেদনের স্ক্রিণ আসবে। সেই স্ক্রিণে যেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত, শিক্ষাগত যোগ্যতা, এবং অভিজ্ঞতার তথ্য দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করা যাবে। এক্ষেত্রে চাকরির বিবরণ ভালো করে পড়ে নিজের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়াটা জরুরি।
রেজুমি/সিভি আপলোড
যে কোন চাকরির জন্য রেজুমি বা সিভির গুরুত্ব অপরিসীম। গুগলের জন্য যথেষ্ট সময় নিয়ে একটি অসাধারণ সিভি তৈরি করতে হবে। সিভিতে থাকা প্রতিটি শব্দ গুগলের নির্বাচিত চাকরিটির সঙ্গে সামঞ্জস্য হওয়া আবশ্যক। সিভি চূড়ান্ত করে পিডিএফ ফরমেটে এখানে আপলোড করে দেয়া যেতে পারে।
গুগলে চাকরির ইন্টারভিউ পদ্ধতি
অনলাইন ফর্মে প্রদত্ত পূর্ণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই ইন্টারভিউয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সাক্ষাতকার গুগলে চাকরির আবেদনের সর্বশেষ ধাপ হলেও এই সাক্ষাতকার কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। অনলাইন ইন্টারভিউয়ের ধাপসংখ্যা সাধারণত পাঁচ রাউন্ড।
এখানে প্রধানত দুটি জিনিস মূল্যায়ন করা হয়। এক- যে কাজের জন্য আবেদন করা হচ্ছে সেই কাজে প্রার্থীর জ্ঞান কতটুকু এবং দুই- প্রার্থীর সফট স্কিলগুলো কতটুকু নির্ভরযোগ্য। যুক্তিবিদ্যার এই অংশটিতে প্রশ্নগুলো ধাঁধাঁর মত মনে হতে পারে। আর প্রথম অংশে প্রার্থীর প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবহারিক জ্ঞানসমূহ যাচাই করা হয়। প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত প্রায় ক্ষেত্রে ইন্টারভিউতেই নেয়া হয়।
পরিশেষে
সবশেষে বলা যায়, গুগলে চাকরি পাওয়ার উপরোক্ত উপায়গুলো অনুসরণের ক্ষেত্রে অনেকেরই মনে হতে পারে যে গুগলে চাকরি হয়ত অনেক উঁচুমানের সার্টিফিকেট দাবি করে। কিন্তু আসল ব্যাপারটি তা নয়, বরঞ্চ এখানে প্রার্থীর পারদর্শিতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এমনও দেখা গেছে যে জিপিএ-৫ না পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী গুগলে চাকরি পেয়েছে। এমনকি তথাকথিত স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াও অনেক আন্ডারগ্রাজুয়েটদের চাকরি হয়ে গেছে। মোদ্দা কথা হলো- উপরোক্ত দক্ষতা যদি কোন স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া কোন শিক্ষার্থীরও থেকে থাকে, সে গুগলে কাজ করার সুযোগ পাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।