বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : সাম্প্রতিক সময়ে যেন হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও লিংকড ইনে নতুন চাকরি খোঁজার পোস্ট দিতে শুরু করেছেন টুইটার, মেটা, কয়েনবেস, স্ন্যাপ থেকে শুরু করে সব বড় টেক কোম্পানির কর্মীরা।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের চাকরিতে ছাঁটাই সংক্রান্ত ওয়েবসাইট লেইঅফস জানিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী টেক সেক্টর থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। কর্মী ছাঁটাই করতে শুরু করেছে গুগল, ফেসবুক অ্যামাজনের মতন বিগটেক হিসেবে পরিচিত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রশ্ন উঠছে কেন একযোগে এভাবে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে এসব তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরিণামদর্শিতা
হঠাৎ করে এই ছাঁটাই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি নির্ধারকদের অপরিণামদর্শিতাকেই দুষছেন বিশ্লেষকরা। কোভিডের সময় হোম অফিসের চর্চা বেড়ে যাওয়ায় লকডাউনের সময় শিল্প ও বাণিজ্যের বিভিন্ন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। তাদের রাজস্বও বেড়ে গিয়েছিল বিপুল।
ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় এ সময় বিবেচনা না করেই কর্মী নিয়োগ দিতে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও এর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ফলাফল আঁচ করতে পারেনি তারা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও ব্যাপক হারে কর্মী নিয়োগ দিতে প্রতিষ্ঠানগুলো। যেমন চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে শুধু মেটাই নিয়োগ দেয় ১৫ হাজার কর্মীকে।
লেগেছে ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কাও
ইউক্রেন যুদ্ধের পর যতই দিন গড়াতে থাকে ততই পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। পরিষ্কার হতে থাকে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব। মন্থর হয়ে পড়তে শুরু করে শিল্প অর্থনীতির চাকা। অপরদিকে কোভিড পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বের হয়ে আসতে শুরু করে হোম অফিসের সংস্কৃতি থেকে। দুই কারণেই চাপে পড়ে যায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। একদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাভাবের কারণে রাজস্ব হারাতে শুরু করে তারা। অপরদিকে এই কমতে থাকা রাজস্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোভিডের সময় নিয়োগ করা জনবল।
একটা পর্যায়ে এসে এসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও ততদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে তারা বেছে নেন সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিকেই। আর তা হলো কর্মী ছাঁটাই।
বিষয়টি পরিষ্কার হয় মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গের বক্তব্যেও। তিনি বলেন, আমি ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি যেভাবে ভেবেছিলাম সবকিছু সেভাবে চলেনি।
কমে গেছে বিজ্ঞাপনের আয়
অনলাইনে বিজ্ঞাপন দীর্ঘদিন ধরেই অনেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ে এই খাতেও। পাশাপাশি নিজেদের ডিভাইস থেকে গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে বিক্রি করা কঠিন করে তোলে অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কমিয়ে আনছে তাদের অনলাইন বিজ্ঞাপনের বাজেট।
ছাঁটাই হচ্ছেন অপ্রয়োজনীয় কর্মীরা
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাবধানে পা ফেলতে চাইছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক এ ব্যাপারে বলেন, যদিও তারা এখনও কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন, তবে তা শুধুমাত্র একান্ত প্রয়োজন সাপেক্ষে।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে কোভিডের সময় তৈরি হওয়া কমফোর্ট জোনে আর নেই বিগ টেক কোম্পানিগুলো। ফলে টিকে থাকতে অপরিহার্য নয় এমন কর্মীদের বিদায় করতে চাচ্ছে তারা।
বিষয়টি প্রতিফলিত হয় অ্যামাজনের মুখপাত্র কেলি নানটেল এর বক্তব্যেও। তিনি বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের অনেক বিভাগকে সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। এর মানে হচ্ছে অনেক পদেরই আর কোনো প্রয়োজন নেই।
বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের চাপ
এদিকে রাজস্ব কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের ওপর চাপ বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। শেয়ারের দর পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। গুগল ও ইউটিউবের প্যারেন্ট অর্গানাইজেশন অ্যালফাবেটের কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে বিখ্যাত ব্রিটিশ হেজ ফান্ড ম্যানেজার ও বিনিয়োগকারী স্যার ক্রিস্টোফার অ্যান্থনি হন অবিলম্বে অপ্রয়োজনীয় কর্মী ছাঁটাইয়ের আহ্বান জানান।
উচ্চভিলাষী প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে বিগ টেক কোম্পানিগুলোর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিংবা চালকবিহীন গাড়ির মতন উচ্চভিলাষী প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যতও। কারণ স্বল্পমেয়াদে এসব প্রকল্প থেকে সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আপাতত। অ্যালফাবেটের চালকবিহীন গাড়ি কোম্পানি ওয়েমোর মতো লোকসানি প্রজেক্ট এর খরচ কমানোর দাবি উঠছে বিনিয়োগকারীদের ভেতর থেকেই।
তবে এই ছাঁটাইয়ের পরও বিগ টেক কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যত অন্ধকার দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের মতে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে কিছুটা ঝড় ঝাপটা আসলেও তা সামলে নিতে পারবে বিগ টেক হিসেবে পরিচিত বিশ্বের বড় বড় এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ অ্যামাজন দশ হাজার কর্মী ছাঁটাই করলেও তা তাদের মোট কর্মী সংখ্যার মাত্র তিন শতাংশ। পাশাপাশি প্রযুক্তির জগতে নতুন নতুন টেক স্টার্টআপের জন্ম নেয়ার সম্ভাবনাও তৈরি করেছে এই কর্মী ছাঁটাই। বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারানো মেধাবী প্রযুক্তিবিদরা হয়তো নতুন কোনো চাকরিতে যোগ না দিয়ে নিজেই খুলে বসতে পারেন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। কে জানে হয়তো গুগল ফেসবুক কিংবা টুইটারের মতো নতুন কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হবে ছাঁটাই হওয়া কোনো কর্মীর হাত ধরেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।