মো. আবু বক্কর সিদ্দিক : হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির পিতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বাঙালির জাতীয় জীবনে বয়ে আনুক আনন্দের বার্তা। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যতা মুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণ-বৈষম্যহীন যে রাষ্ট্রটির জয়যাত্রা সূচনা করে গেছেন, তারই সুযোগ্য কন্যা মানবতার মা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা আজ উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বর্তমান সরকারের সাফল্য ও অগ্রযাত্রার উন্নতম ক্ষেত্র হলো শিক্ষা খাত। শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়নে এ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো সর্বমহলে প্রশংসিত। শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নত অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক কর্মচারীদের উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিও-করণ, বিনামূল্যে শতভাগ বই বিতরণ ইত্যাদি কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিশেষ অবদান হলো ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা- ২০১৮’ অনুমোদন। এতে করে একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বহু বছরের শিক্ষক-কর্মচারীর সংকট নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিকে একাধিক নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেরও একটা পথ উন্মুক্ত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এটি খুব ইতিবাচক ব্যাপার হলেও কিছু ক্ষেত্রে এই নীতিমালাটি জটিলতারও সৃষ্টি করেছে। সৃষ্ট জটিলতাগুলোর মধ্যে মাদ্রাসায় গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে পূর্বের নীতিমালায় থাকা সমমান যোগ্যতা বাতিল অন্যতম। পূর্ব নীতিমালা অর্থাৎ ২০১০ সালের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় গ্রন্থাগারিক নিয়োগে যোগ্যতা ছিল গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং সহকারী গ্রন্থাগারিক পদের যোগ্যতা ছিল স্নাতক ডিগ্রি এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। যাতে সকল কোর্সধারীদের জন্য সমমানের ভিত্তিতে নিয়োগের নিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু ২০১৮-এর নীতিমালায় মাদ্রাসার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারিক পদটির জন্য যোগ্যতা রাখা হয় কামিল বা আরবি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা আর সহকারী গ্রন্থাগারিকের জন্য যোগ্যতা রাখা হয় ফাজিল বা আরবি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। যার দ্বারা সমমান যোগ্যতা বাতিল করে জেনারেল শিক্ষিত ডিগ্রিধারীদের উক্ত পদদ্বয়ে নিয়োগের সুযোগ বাতিল করে তা শুধু মাদ্রাসা শিক্ষিতদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এই নীতিমালাটির ফলে রাতারাতি হাজার হাজার যোগ্য শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে তৈরি হয় বৈষম্যের দেয়াল।
বৈষম্যের বিপক্ষে এবং সমমানের পক্ষে কিছু কথা:
গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক পদ দুটি টেকনিক্যাল পদ অর্থাৎ এগুলো কারিগরি শ্রেণির আওতাভুক্ত। কারিগরি পদগুলোতে চাকরির প্রধান শর্তই হলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্জিত সনদ। গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক পদ দুইটি হলো নন-টিচিং বা স্টাফ পদ। আর স্টাফ পদগুলোর শিক্ষাগত যোগ্যতা সব সময় সমমান হয়।
সুতরাং নীতিমালাটিতে উক্ত পদ দুটির নিয়োগ যোগ্যতার যে বৈষম্য করা হয়েছে তা সর্বজন স্বীকৃত। এটি উদ্দেশ্য প্রণদিতভাবে একটি বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দিতে করা হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা বা উক্ত বিষয়ে অনার্স কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে সবার শিক্ষাগত যোগ্যতায় সমমান চাওয়া হয়। আর কোর্সটিতে সবাইকে একই বিষয়ে, একই পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হয়। একই প্রশ্ন পত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সনদপত্রও সবার জন্য সমান, তাহলে নিয়োগ ক্ষেত্রে বৈষম্য কতটা যৌক্তিক?
পূর্বের সকল নীতিমালা- বিশেষ করে এই নীতিমালার পূর্বের সর্বশেষ ২০১০ সালের নীতিমালায় বেসরকারি সকল স্কুল, কলেজ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পদ দুটির নিয়োগ যোগ্যতা একই ছিল। অর্থাৎ গ্রন্থাগারিকের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ছিল স্নাতক ডিগ্রী এবং গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ এবং সহকারী গ্রন্থাগারিকের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ছিল স্নাতক ডিগ্রী এবং গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। তবে ২০১৮ সালের বর্তমান নীতিমালায় স্কুল, কলেজ ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আগের নিয়োগ যোগ্যতা বহাল থাকলেও একই নীতিমালার মাদ্রাসা অংশে উক্ত পদ দুটির নিয়োগ যোগ্যতা পরিবর্তন করা হয়।
সরকারি ঘোষণা মতে স্নাতক ও ফাজিল এবং স্নাতকোত্তর ও কামিল সমমান ডিগ্রি কিন্তু সহকারী গ্রন্থাগারিকের শিক্ষাগত যোগ্যতার শুধু ফাজিল ও আরবি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে এবং গ্রন্থাগারিক পদের ক্ষেত্রে কামিল ও আরবি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সাথে মাত্র ১ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রন্থাগারিক পদটির জন্য এরূপ যোগ্যতার কোন আবশ্যকতা নেই। যা পদটির প্রকৃত যোগ্যতার পরিপন্থী। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এর দ্বারা কী তাহলে শুধু বৈষম্যই ইঙ্গিত হচ্ছে?
নীতিমালার উক্ত পদদ্বয়ের নিয়োগ যোগ্যতা পরিবর্তন করার পক্ষে নীতিমালার কোথাও কোন আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা রাখা হয়নি। তবে নীতিমালা প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে জানা যায় যে, এরূপ নীতিমালার প্রধান কারণ হল মাদ্রাসায় আরবি সংশ্লিষ্ট বই- যা জেনারেল শিক্ষিতরা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে না। এখন আরবি বই যদি জেনারেল শিক্ষার্থীদের অযোগ্যতার প্রধান কারণ হয় তাহলে প্রশ্ন থাকে- গ্রন্থাগারে শুধু আরবিই নয়, বরং গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ভাষার বইও থাকতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ২৩টিরও অধিকভাষার বই আছে, তাহলে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কি ২৩ ভাষা বিশারদ গ্রন্থাগারিক নিয়োগ প্রয়োজন নাকি ২৩টি আলাদা ভাষার বইয়ের জন্য ২৩ জন গ্রন্থাগারিক নিয়োগ প্রয়োজন? না, এরকম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে কিন্তু মূল যোগ্যতা সনদকে অবমূল্যায়ন করা নয়। আর নীতিমালায় সমমানের যোগ্যতা না রাখা সঠিক বলে মনে করা হয় তাহলে, একই নিয়মানুসারে মেডিক্যাল কলেজগুলোর জন্য একজন ডাক্তারকে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীকে, কমার্স স্কুল, কলেজ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীদের শুধু যোগ্য ঘোষণা করা অথবা স্কুল, কলেজের জন্য ফাজিল/কামিল/আরবি বিষয়ের কোর্সধারীদের অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত।
গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য যেহেতু একটাই যা হলো গ্রন্থাগারিক বা সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। যেহেতু দেশের স্কুল- কলেজগুলোতে পদ দুটিতে পূর্ব থেকেই লোক নিয়োগ করা আছে অপরদিকে দেশের প্রায় সকল মাদ্রাসায় ১টি করে সহকারী গ্রন্থাগারিক বা গ্রন্থাগারিক নিয়োগ হবে। মূলত এই সম্ভাবনায় সকলে উক্ত কোর্সে ভর্তি হয়েছেন এবং সনদ অর্জন করেছেন। আর দেশে দাখিল থেকে কামিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যার প্রত্যেকটিতেই উক্তপদে নিয়োগ প্রদান করা হবে। এই নীতিমালাটি সংশোধন বা পরিবর্তন করে সমমান না করা হলে একদিকে মাদ্রাসাগুলো যেমন পর্যাপ্ত যোগ্য প্রার্থী পাবে না অন্যদিকে হাজার হাজার জেনারেল কোর্সধারী শিক্ষিতরা চাকরির নিশ্চয়তা হারাবে।
মোট কথা বৈষম্য কখনও সুখকর হয় না। একটা সমস্যা পর্যায়ক্রমে একাধিক সমস্যারই শুধু জন্ম দেয়। গ্রন্থাগারিক বিজ্ঞানের মৌলিক শিক্ষা সকল দেশের সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। এটি একটি আন্তর্জাতিক বিষয় এর যোগ্যতা কখন নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের পারদর্শিতার উপর নির্ভর করে না। আবার নীতিমালা সংশোধনী কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ বা সংশোধনী নীতিমালা প্রণয়নের পূর্বেই পদ দুটির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ শুরু হয়েছে। যা কোর্সধারীদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন করছে।
সুতরাং মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের ধারা সমুন্নত রাখতে এবং উক্ত পদদ্বয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে মৌলিক যোগ্যতার প্রাধান্য রেখে সনদের সমমান বিধান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে একদিকে যেমন শিক্ষার ভারসাম্য বজায় থাকবে অন্যদিকে বেকার সমস্যার নিরসনেও তা অবদান রাখবে।
তাই সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা- ২০১৮’ এর ১৫ নং কলামের গ্রন্থাগারিক এবং ৩৫ নং কলামের সহকারী গ্রন্থাগারিক পদদ্বয়ের নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতায় সমমান বিধান পুনর্বহালের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুনজর কামনা করছি।
লেখক: সভাপতি, সমমান বঞ্চিত লাইব্রেরী এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।