চুম্বক আর লোহার টুকরোর পরস্পর টান দেখেছ নিশ্চয়ই। এ টানের নাম চুম্বক শক্তি বা চৌম্বকত্ব। শুধু চুম্বক আর লোহা নয়, বিশ্বজগতের সবকিছু পরস্পরকে টানে। এ শক্তির নাম মহাকর্ষ। ক্ষুদ্র জিনিসে এ টান দেখা বড় কঠিন—পরস্পর পরস্পরকে টানলেও মহাকর্ষ অত্যন্ত কম।
বস্তুর ভর যত বেশি, তত বেশি পরস্পরের প্রতি তাদের টান। মহাশূন্যের সবকিছুর আকার অনেক বড়। পরস্পরের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান থাকলেও তাদের পারস্পরিক টান অতি প্রচণ্ড। যেকোনো দূরত্বে মহাকর্ষের শক্তি অনুভব করা যায়; অবশ্য দূরত্ব বেশি হলে সে শক্তি স্বভাবতই কম।
পৃথিবী থেকে চাঁদ ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরে, তবু মহাকর্ষের টানে চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি থাকে এমন শক্তভাবে যে কোটি কোটি ইস্পাতের তারও তেমন করে বেঁধে রাখতে পারত না। সে জন্যই চাঁদ ছুটে বেরিয়ে যেতে পারে না মহাশূন্যে, তাকে ঘুরপাক দিতেই হয় পৃথিবীকে।
পৃথিবীর উপগ্রহ হল চাঁদ। তাকে নিয়েই আমাদের গ্রহনক্ষত্রের পরীক্ষা শুরু করা যাক। আগেই বলেছি, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। এটা সাংঘাতিক কিছু নয়। আজকের দিনে ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটার গতিসম্পন্ন যে সব যাত্রীবিমান আছে, তাদের কাছে এ সফর অত্যন্ত সহজ।
ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটার গতিতে গেলে চাঁদে পৌঁছাতে লাগবে ৩৮৪ ঘণ্টা, অর্থাৎ ষোলোটা দিন আর রাত। দরকার হবে শুধু যথেষ্ট পরিমাণে খাবার আর পানি, এবং অবশ্যই পৌঁছানো আর ফিরে আসার মতো জ্বালানি। তাহলে ওঠা যাক একটা বড় যাত্রীবিমানে। যা কিছু দরকার, তা নেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। বহিশূন্যের প্রথম অভিযাত্রী আমরা, কী দারুণ ব্যাপার।
ক্রমশ ওপরে উঠতে লাগল বিমান। উচ্চতা মাপার যন্ত্র অল্টিমিটারে দেখা গেল ৫, ১০, ১৫ কিলোমিটার। পৃথিবীর বস্তুগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে; নদীগুলো আঁকাবাঁকা সরু, সুতোর মতো, কালো ছোপগুলো জঙ্গল। কিন্তু কী ব্যাপার? আর উঁচুতে আমাদের বিমান উঠছে না। ইঞ্জিনগুলো ভীষণ গর্জে চলেছে, কিন্তু একই উচ্চতায় থেকে যাচ্ছে বিমানটা।
‘কী হলো!’ জিজ্ঞেস করলাম ক্যাপ্টেনকে। ‘হাওয়া অত্যন্ত পাতলা,’ বলল সে। ‘ওঠার মতো শক্তি পাচ্ছে না বিমান।’ আমরা তাকে বললাম, ‘যত দূরে যাবে, ততই খারাপ। কিছুক্ষণ পরেই হাওয়া বলে কিছু থাকবে না, শুধু ফাঁকা শূন্য। সেখানে বিমান উড়তে পারে না। আগে কথাটা মনে হয়নি কেন আমাদের? নামা যাক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামা যাক। আর এ অযাত্রার কথা কাউকে বলবেন না দোহাই!’
তোমরা হয়তো হো হো করে হেসে বলবে, ‘কী ছাইভস্ম লিখছেন যে আপনি! চাঁদে বিমানে করে উড়ে যাওয়ার কথা ভাবে, এমন বোকা লোক আছে নাকি!’ ঠিকই বলেছ। কী ধরনের যান চাঁদে উড়ে যেতে পারে, আশা করি সেটাও জানো। তার নাম রকেট! আর শুধু রকেটে করেই লোকে বহিশূন্যে যেতে পারবে। কারণ একমাত্র রকেটই মহাকর্ষের শক্তি অতিক্রম করতে পারে।
যে মহাকর্ষ নিয়ে এতক্ষণ কথা চলেছে, সেটা এখন বোঝালে হয়। ঘরের ভেতর একটা লাফ দিলে মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসবে মেঝেতে। ক্রীড়াবিদ হাতুড়ি ছাড়ল, শূন্যে একটা আর্ক, এঁকে কয়েক মিটার দূরে মাটিতে পড়ল সেটা। প্রকৃতির সবকিছুকে টানে পৃথিবী।
এক সময়ে লোকে ভাবত, মহাকর্ষের শেকল ভাঙা কখনো চলবে না। প্রায় শত বছর আগে সুপরিচিত ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্লামারিওন মঙ্গলগ্রহ সম্বন্ধে লেখেন তিক্ত ভাবে: এটি এমন এক নতুন পৃথিবী, যেখানে কোনো কলম্বাস কখনো পাড়ি দিতে পারবে না।’
কিন্তু এমনকি তত দিন আগেও মানুষেবাহী রকেটযানের কথা কল্পনা করেন রুশ বিপ্লবী নিকোলাই কিবালচিচ। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যার প্রচেষ্টায় যোগদানের জন্য তাঁর প্রাণদণ্ড দেয় জার সরকার। ফাঁসির আগে কারাগারে জীবনের শেষ কটি দিনে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান তিনি। তখনি রকেটযানের একটা নকশা এঁকে বর্ণনা দেন। রকেটযানের ছবিটা এখানে আছে। কিবালচিচের ফাঁসির পর জার কর্মচারীরা ছবিটা রাষ্ট্রীয় নথিশালায় রাখেন। অক্টোবর বিপ্লব ঘটা না পর্যন্ত সেটা থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
কখনো কখনো লোকে ভাবে যে হাওয়ায় সোজাসুজি ধাক্কা দিয়ে রকেট এগোয়। এটা ঠিক নয়। উড়ন্ত বিমান ভর করে হাওয়ায়, কিন্তু রকেটের যাত্রায় হাওয়া বাধা দেয়। রকেটের ভেতর বারুদ বা অন্য কোনো জ্বালানি পুড়ে পুড়ে গ্যাস তৈরি করে। গ্যাস পেছনে ছুটে গিয়ে সামনে ধাক্কা দেয় রকেটকে। এটা হলো জেটচালন নীতি; আর জানোই তো, বর্তমান জেট-ইঞ্জিন চালিত অনেক বিমান আছে, যেগুলো মহাবেগে চলে।
প্রখ্যাত একজন রুশ বিজ্ঞানী ছিলেন, নাম কনস্ট্যানটিন জাল্কোভস্কি। সারা জীবন তিনি আন্তঃগ্রহ যাত্রার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেন। এমনকি ১৯০৩ সালে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরগামী একটি রকেট-জাহাজের প্রথম ড্রয়িং আর অঙ্ক হিসেব ছাপান। পরে তিনি নকশা বানান এমন একটি বহুপর্যায়ী রকেটের, যেটি পৃথিবীর মহাকর্ষ অতিক্রম করতে পারে। কয়েকটি অংশ বা পর্যায়ে এর গঠন।
প্রথম পর্যায়ের জ্বালানি পুড়ে রকেটকে শূন্যে পাঠাবে, কিন্তু সাংঘাতিক বেগে নয়। জ্বালানি সব পুড়ে গেলে এ পর্যায়টি খসে পড়বে পৃথিবীতে। তখন শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ, অনেকটা হালকা হয়ে যাওয়া রকেটের গতিবেগ বৃদ্ধি পাবে। এ পর্যায়টি খসে পৃথিবীতে পড়লে তৃতীয় পর্যায়টি চালু হবে, রকেটের গতিবেগ হবে অতি দ্রুত। শেষ পর্যায় যে গতিবেগ সঞ্চয় করবে, তাতে আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। প্রমাণ হয়েছে যে অত্যন্ত উচ্চ বেগে পৃথিবীর মহাকর্ষ অতিক্রম করা যায়।
লাফিয়ে লোকে ফিরে আসে মেঝেতে, উৎক্ষিপ্ত হাতুড়ি পড়ে মাটিতে। তবে এমনটা হয় কেন? বহিশূন্যে চলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট বেগ তাদের নেই বলে। কিন্তু মনে রাখা দরকার—লাফ মারা লোকটি মাটি থেকে দুই-এক মিটার উঠেছিল, হাতুড়িটি দশ থেকে বিশ মিটার আর গোলাটি কয়েক কিলোমিটার। তার কারণ, লাফ মারা লোকটির চেয়ে হাতুড়ির গতিবেগ ছিল অনেক বেশি, আর হাতুড়ির চেয়ে অনেক গুণ বেশি ছিল গোলার বেগ।
সবচেয়ে দূরপাল্লার কামানের গোলা সেকেন্ডে প্রায় দুই কিলোমিটার বেগে কামানের মুখ থেকে বের হয়। বেগটা বেশ। এ বেগে লেনিনগ্রাদ থেকে মস্কোয় যাওয়া যায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। তবু পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে এ বেগ যথেষ্ট নয়। গোলাটি শূন্যে বিরাট একটা আর্ক এঁকে আবার পৃথিবীতে নেমে আসবে।
হিসেব করে জাল্কোভস্কি দেখলেন, সেকেন্ডে আট কিলোমিটার বেগ পেলে রকেট আর ফিরে মাটিতে পড়বে না, পৃথিবীকে আবর্তন করে পরিণত হবে উপগ্রহে বা মানুষের হাতে-গড়া চাঁদে। এই বেগেই প্রথম সোভিয়েত স্পুৎনিক নভোযানগুলোকে ছাড়া হয়। এর নাম বৃত্তাকার বেগ, কেননা এতে উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, পৃথিবীকে ছেড়ে যায় না।
সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার বেগ পেলে রকেট পৃথিবীর টান পেরিয়ে চাঁদ, মঙ্গল বা যেকোনো গ্রহের দিকে যেতে পারে। এ বেগের নাম মুক্তিবেগ। চন্দ্রপথের প্রথম পথিক হলো ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উৎক্ষিপ্ত মহাশূন্য রকেট। (এ রকেটের নাম লুনা ১। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, এটি চাঁদের বুকে গিয়ে পড়বে। পরে তা হয়নি।) চাঁদকে অতিক্রম করে এটি সূর্যের গ্রহে পরিণত হলো—সৌরজগতের প্রথম কৃত্রিম গ্রহ। ব্যাপারটার গুরুত্ব এত বেশি যে এ বিষয়ে আরও কিছু বলব পরে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।