জুমবাংলা ডেস্ক: রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গবাদিপশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি)। গত কয়েক মাসে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে কয়েকশ গরু। বাংলানিউজ-এর প্রতিবেদক গৌতম ঘোষের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
‘লাম্পি স্কিন’ রোগে মৃত্যুহার কম হলেও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দুগ্ধ ও চামড়া শিল্পে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পশুর চামড়া অনেকটাই অকার্যকর হয়ে যায়। আবার গাভী আক্রান্ত হলে দুধ উৎপাদন শূন্যের কোটায় নেমে আসে। দেশের দুধ উৎপাদনকারী খামারগুলোয় এ রোগের প্রভাব পড়ছে। দুধ উৎপাদন কমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা।
এদিকে দেশে গরুর ‘লাম্পি স্কিন’ রোগ ছড়িয়ে পড়লেও এতে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, খুব সাধারণ চিকিৎসায় গবাদি পশুর এই রোগ সারানো সম্ভব। সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। লাম্পি স্কিন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বছর দেশে ‘লাম্পি স্কিন’ রোগ প্রথম চিহ্নিত হয় রংপুর জেলায়। এরপর পর্যায়ক্রমে তা দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, খুলনা ও কুমিল্লা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এসব জেলায় আক্রান্ত হয়েছে কয়েক লাখ গরু। বেশকিছু গরু মারাও গেছে। এক রংপুর বিভাগেই মারা গেছে আড়াইশ গরু।
খামারিরা বলছেন, গরু উৎপাদন বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। এ খাতে বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। গরু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক যুগের ব্যবধানে দেশে গরুর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ বেড়েছে। আর বর্তমানে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে খামারকে মুক্ত রাখা না গেলে এই অগ্রযাত্রায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। গাভী আক্রান্ত হলে দুধ উৎপাদন শূন্যের কোটায় নেমে আসে। ফলে উৎপাদন কমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা। এর কোনো প্রতিষেধক না থাকায় গরু নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন খামারিরা। লাম্পি স্কিন ডিজিজ গরুর জন্য একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাসজনিত চর্মরোগ, যা খামারের ক্ষতির কারণ। দ্রুত রোগটি প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত।
রংপুরের চিলমনের ক্ষুদ্র খামারি সাইফুল ইসলাম বলেন, দুটি গরুর গায়ে গুটি দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে অন্য গরু থেকে আলাদা করে রেখেছি। দুই দিনের মাথায় গরুর গায়ের গুটি ফেটে মাংস পড়ে পড়ে যাচ্ছে। অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা করেও ভালো হচ্ছে না। মনে হয় না এই গুরু আর বাঁচবে। দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলে বলে, এই রোগের কোনো চিকিৎসা নাই। যেটা আছে সেটা প্রয়োগ করা হয়েছে। এই দুইটা গরুর দাম হবে কম করে হলেও ৩ লাখ টাকা। এখন আতঙ্কে আছি, অন্য গরু আক্রান্ত হলে আমি শেষ হয়ে যাবো!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত মশা ও মাছির মাধ্যমে ভাইরাসজনিত রোগটি সারা দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে গরু আমদানি করা হয়। এমনকি কার্গো বিমানে করে ব্রাহামা জাতের গরুও আনা হচ্ছে। কিন্তু আমদানিকারকরা কী ধরনের গরু আনছেন বা আমদানি করা গরুর শরীরে প্রাণঘাতী ভাইরাস আছে কিনা, সে পরীক্ষা করা হচ্ছে না, যা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে আগে এ ধরনের রোগ দেশে ছিল না। ওষুধেরও তাই প্রয়োজন পড়েনি। লাম্পি স্কিন ডিজিজের চিকিৎসায় গোট পক্সের ভ্যাকসিন প্রাথমিকভাবে কাজে লাগতে পারে। তবে এ ভ্যাকসিনেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে দেশে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (প্রাণি হেলথের) উপপরিচালক ডা. মো. শাহিনুর আলম বলেন, গরুর লাম্পি স্কিন রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। শুধু সচেতনতার মাধ্যমেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হয়। প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিপাইরেটিক ও অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। নডিউল বা গুটি ফেটে গেলে বা সেকেন্ডারি ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন দমন করার জন্য ক্ষতস্থানে পভিসেপ অথবা ভয়োডিন দিয়ে ড্রেসিং করে বোরিক পাউডার বা সালফানিলামাইড পাউডার লকগানো যেতে পারে। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, এই রোগ প্রতিরোধে অসুস্থ পশু আলাদা করতে হবে। খামারের ভেতরের এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে মশা-মাছির উপদ্রব কমিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রান্ত গরুর খামারের শেড থেকে আলাদা করে অন্য স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখলে অন্য গরুতে সংক্রমণ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আক্রান্ত গাভীর দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া উচিত। আক্রান্ত গরুর ব্যবহার্য কোনো জিনিস সুস্থ গরুর কাছে আনা বা সেই গরুর খাবার অন্য গরুকে খেতে না দেওয়া যাবে না।
এই প্রাণিস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এই রোগ নিয়ন্ত্রণে টিকা দেওয়া যেতে পারে। তবে আমাদের দেশে এই রোগের কোনো টিকা না থাকলেও গোট পক্স টিকা দিলে উপকার পাওয়া যাচ্ছে। তবে ২১ দিন পর সাধারণত এমনিতেই রোগটি সেরে যায়। তাই লাম্পি স্কিন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলেই দ্রুত উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা রেজিস্ট্রার্ড প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই লাম্পি স্কিন রোগ প্রতিরোধে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না।
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিরাজুল হক বলেন, গত তিন চার বছর ধরে দেশে এই রোগ দেখা যাচ্ছে। এ বছর রংপুর জেলায় ৮ উপজেলার প্রায় ৩০ শতাংশ গরু এই লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত। এর চিকিৎসায় এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো টিকা আমাদের দেশে আসেনি। এই রোগ প্রতিরোধে আমরা গোট পক্স ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি। এতে আক্রান্ত পশুর সুস্থ হওয়ার হার প্রায় ৮০ ভাগ। এছাড়া আক্রান্ত পশুর জন্য আমরা লক্ষণভিত্তিক সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা দিচ্ছি। পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করারও চেষ্টা করছি। তবে দুই-এক মাসের মধ্যে শীত এলে এমনিতেই এর প্রাদুর্ভাব কমে আসবে।
তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে লাম্পি ভ্যাক্স নামে একটি টিকা উৎপন্ন হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় সেটা দিয়ে উপকার পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর বড় গুরুর থেকে বাছুর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। রংপুর জেলায় এ বছর এখন অবধি ৩০টি গরু মারা গেছে। আর পুরো বিভাগে সেটা ২০০/২৫০ টি হতে পারে। রংপুরসহ আশেপাশের বিভাগগুলোর পশুও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
দিনাজপুর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলতাফ হোসেন বলেন, যারা আক্রান্ত গরু আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন তাদের আমরা ভ্যাকসিন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। পাশাপাশি আক্রান্ত গরু আলাদা ঘরে রেখে মশারি দিতে বলছি। তবে অনেকে গ্রামের চিকিৎসকের পরামর্শে এই রোগে আক্রান্ত গরুকে ব্যথার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছেন। এতে আক্রান্ত পশু আরও দুর্বল হয়ে যায়। অনেকেই কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের অনেকের গরু মারা গিয়ে থাকতে পারে। তবে আমাদের কাছে সেই তথ্য নেই। আমরা তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি।
১৯২৯ সালে সর্বপ্রথম আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়াতে লাম্পি স্কিন রোগ দেখা দেয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। মশা-মাছি বাহিত রোগটি মূলত মশার মধ্যমেই বেশি ছড়ায়। আক্রান্ত গরু সুস্থ হতে দীর্ঘদিন সময় লাগে। দিন দিন গরু-বাছুর দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। একটি খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দিতে খুরা রোগের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর রোগ লাম্পি স্কিন।
বাংলাদেশে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রথম দেখা দেয় ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে। এরপরই মাঠে নামে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তদন্ত টিম। তখন দেশের ১২ জেলায় ৪৮ হাজার গরুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এ বছর আবার রোগটি দেশের বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশে ৪০ শতাংশ গরু এ রোগে মারা গেছে বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে।
রোগের কারণ: মূলত এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসটি Poxviridae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Capripox virus গণের ভাইরাস। ছাগল ও ভেড়ার পক্স ভাইরাসের সাথে এ ভাইরাসের খুবই সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এ ভাইরাস গরু ছাড়া মহিষেও ছড়াতে পারে। এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। ছাগল ও ভেড়ায় প্রতিলিপি তৈরি করলেও এরা সাধারণত লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয় না। এছাড়াও এ ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করে না।
আক্রান্তের সময়: রোগটি প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে বা বসন্তের শুরুতে মশা-মাছির বেশি বিস্তারের সময় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
রোগের লক্ষণ: আক্রান্ত গরু প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং খাবার রুচি কমে যায়। জ্বরের সাথে সাথে নাক-মুখ দিয়ে লালা বের হয়, পা ফুলে যায়, দুই পায়ের মাঝে পানি জমে যায়। পশুর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চামড়া পিণ্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্টি হয়। আর এ ক্ষত শরীরের অন্যান্য জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। শরীরের কোথাও কোথাও ফুলে যায়। যা ফেটে টুকরা মাংসের মতো বের হয়ে ক্ষত হয় এবং পুঁজ বের হয়। পাকস্থলি বা মুখের ভেতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরুর পানি পানে অনীহা তৈরি হয় এবং খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।
যেভাবে ছড়ায়: এ রোগে আক্রান্ত গরু থেকে বিভিন্ন উপায়ে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হলো মশা ও মাছির আক্রমণ। মশা ও মাছিকে এ ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কীট-পতঙ্গের মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গরুর লালা গরুর খাবারের মাধ্যমে এবং খামার পরিচর্যাকারী ব্যক্তির কাপড়ের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গাভির দুধেও এ ভাইরাস বিদ্যমান। তাই আক্রান্ত গাভীর দুধ খেয়ে বাছুর আক্রান্ত হতে পারে। গ্রাম-গঞ্জের প্রাণি চিকিৎসকরা এক সিরিঞ্জ ব্যবহার করে বিভিন্ন গরু-ছাগলকে টিকা দেন। এতেও সিরিঞ্জের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসে আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন প্রজননে ব্যবহার করলেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কেবল গরু, মহিষ ও ছাগল লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।