রঞ্জু খন্দকার, তারাগঞ্জ (রংপুর) থেকে: বাগানের গাছ থেকে তোলা হচ্ছে থোকায় থোকায় ধরা কফিফল। সেই ফল প্রক্রিয়াজাত করে স্থানীয়ভাবেই বানানো হচ্ছে পানের উপযোগী কফি। ধোঁয়া ওঠা সেই পানীয়র কাপে চুমুক দিচ্ছেন বাগানেরই পাশে তৈরি করা কফিশপে। একবার ভাবুন তো, অনুভূতিটা কেমন হবে?
যদি অত ভাবতে না চান, তাহলে কষ্ট করে আপনাকে যেতে হবে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায়। সেখানকার সয়ার ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ী গ্রামে গেলেই পাবেন কাঙ্ক্ষিত সেই ‘ফিলিংস’। অর্থাৎ বাগানের পাশে বসেই পান করতে পারবেন সেখানকার গাছ থেকে তোলা কফি।
এই ফিলিংস নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন গোয়ালপাড়া গ্রামেরই তরুণ কৃষিউদ্যোক্তা মোখলেছুর রহমান (৩৫)। গত ২৮ অক্টোবর থেকে নিজের বাগানের পাশে কফিশপ চালু করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস এই কৃষক।
মোখলেছুর জুমবাংলাকে জানান, আপাতত তিনি সীমিত পরিসরে কফিশপ চালু করেছেন। আস্তেধীরে পাশের বগুড়া, রংপুর ও সৈয়দপুর শহরসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি নিজের বাগান থেকে তোলা ফল প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা কফি সরবরাহ করবেন।
তারাগঞ্জসহ রংপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এক সময় তামাকের রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। বয়স্ক পুরুষেরা হুঁকায় গুড়ুক গুড়ুক শব্দে সেবন করতেন সেই তামাক। নারীদের কাছে পানমশলা হিসেবে জনপ্রিয় ছিল তামাকপাতা। এ ছাড়া এখনো বিড়ি বা সিগারেটে তামাক সেবন রয়েছে।
স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, তারাগঞ্জে এখন আগের মতো তামাকচাষ আর নেই। অন্য ফসলে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। এখন শুরু হয়েছে কফিচাষ। এভাবে অস্বাস্থ্যকর তামাকের জায়গা নিচ্ছে স্বাস্থ্যকর পানীয়ফসলের চাষ।
তারাগঞ্জ শহর থেকে একই জেলার বদরগঞ্জ উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তারাগঞ্জ সদর থেকে এই সড়ক ধরে দক্ষিণে প্রায় ৫ কিলোমিটার এগোলেই মোখলেছুরের কফিশপ। এর পাশেই তাঁর কফির বাগান।
গত ২১ অক্টোবর গোয়ালবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মোখলেছুরের বাগানজুড়ে থোকায় থোকায় ধরে আছে কফিফল। সবুজ পাতার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল, হলুদ রঙের পাকা ফল। কোনোটা অবশ্য তখনো পাকেনি। সেগুলোর রং সবুজ। গাছের উচ্চতা ছয়/সাড়ে ছয় ফুট।
মোখলেছুর বলেন, এখন কফিগাছের ফল আহরণ শুরু। চলবে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। গত সপ্তাহেই তিনি ফল তুলেছেন। এ বছর তিনি কফির বাগানে খরচ করেছিলেন প্রায় আড়াই হাজার টাকা। এবার নিজেই প্রক্রিয়াজাত করে কফি বিক্রি করবেন। এভাবে লাভ বেশি হবে। তাঁর টার্গেট, এভাবে তিনি ৩০ লাখ টাকার কফি বিক্রি করবেন।
কবে থেকে কফিচাষ শুরু-এমন প্রশ্নে মোখলেছুর জানান, প্রায় ৭ বছর আগে ইউটিউবের মাধ্যমে জানতে পারেন পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢালু জমিতে কফির চাষ হচ্ছে। তিনি ভাবেন, তারাগঞ্জের মাটিও তো ঢালু। তাহলে এখানেও তো কফিচাষ হতে পারে। যেই ভাবনা, সেই কাজ।
মোখলেছুর বলেন, ২০১৭ সালের শেষে চট্টগ্রামের একটি নার্সারি থেকে কফির চারা আনেন তিনি। সেগুলো নিজের ২০ শতক জমিতে রোপণ করেন। সাড়ে চার শ চারা লাগান তিনি। দুই বছরের মাথায় প্রথম ফল আসে তার বাগানে। এরপর প্রতি বছরই ফল আহরণ করছেন তিনি।
কফিচাষ অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে লাভজনক বলে মনে করেন মোখলেছুর। তিনি বলেন, একরপ্রতি হিসাব করলে খরচ বাদে কফিবাগান থেকে বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা লাভ আনা সম্ভব। তিনি ২০ শতক জমি থেকে প্রথমবার ২০১৯ সালে কফি বিক্রি করেন ৬ হাজার টাকা। এর পরের দুই বছর তিনি যথাক্রমে পৌনে দুই ও পৌনে তিন লাখ টাকার করে কফি বিক্রি করেন। ২০২২ সালে তিনি প্রায় পাঁচ লাখ টাকার কফি ও চারা বিক্রি করেন।
মোখলেছুরের কফিবাগানের আশপাশে সবই ধানীজমি। লাভজনক হলেও এসব জমির মালিকেরা কেন কফিচাষ করছেন না–এমন প্রশ্নে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এই কৃষক বলেন, প্রথমত, অন্য চাষিরা এই চাষ সম্পর্কে তেমন জানেন না। দ্বিতীয়ত, কফিচাষে প্রথম দুই বছর ফলন পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র চাষিরা এই সময়টুকু দিতে চান না। জমি ফেলে রাখতে চান না।
তবে ধীরে-ধীরে কফিচাষ জনপ্রিয় হচ্ছে বলে জানান মোখলেছুর। তিনি বলেন, তাঁর এলাকায় এখন তিনটি কফিবাগান। তাঁর দেওয়া চারা দিয়ে পঞ্চগড়, বগুড়া, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় ৫০টির বেশি বাগান হয়েছে। তিনি নিজে এসব চাষিকে বাগানের বিষয়ে নানা পরামর্শ দেন।
মোখলেছুর বলেন, চরাঞ্চলের বালিমাটি ছাড়া দেশের সব মাটি কফি চাষের জন্য উপযোগী। শুধু পানি আটকে থাকে না, এমন জমি হলেই রপ্তানিযোগ্য এ ফসল চাষ করা যাবে।
কফি নিয়ে অনেক স্বপ্ন মোখলেছুরের। তিনি বলেন, কফি বিশ্বের অন্যতম বড় শিল্প। তিনি দেশে এই শিল্পের বিকাশে কাজ করতে চান। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে কফির প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিদেশে রপ্তানিও করতে চান। এরই অংশ হিসেবে তিনি বাগানের পাশেই কফিশপটি চালু করেছেন। তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের কফিচাষে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে সরকারকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।