মুযযাম্মিল হক উমায়ের : হিজরি বছরের গণনা অনুযায়ী নবম মাসকে ‘রমজান’ মাস বলা হয়। এই মাসেই মুসলমানরা ফরজ রোজা পালন করে থাকেন। ‘রমজান’ এটি আরবি শব্দ। মূলধাতু হলো, رَمَضٌ এবং رَمْضَاءُ । অর্থ হলো, প্রখর তাপ, উত্তপ্ততা, সুর্যের তাপে উত্তপ্ত মাটি ইত্যাদি।
এই নামে মাসটিকে নামকরণের কয়েকটি কারণ পাওয়া যায়
১. কোনো মাসের নাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আরবদের প্রচলন ছিল, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে নাম নির্ধারণ করা। যেহেতু এই মাসের সময়টিতে আরব দেশে প্রখর রোদ ও সূর্যের উত্তাপ ছিল তাই তারা উক্ত মাসটিকে রমজান হিসাবে নির্ধারণ করেছে।
২. অনেকে বলেছেন, রোজা ফরজ হওয়ার সময়ে সূর্যের উত্তাপ বেশি ছিল। তাই উক্ত নামে নামকরণ করা হয়েছে।
৩. আধ্যাত্মিক মনীষীদের ভাষ্যমত হলো, রোজা যেহেতু বান্দার গুনাহসমূহকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেয়, তাই উক্ত নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই কথাটি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকেও বর্ণিত আছে।
রমজান মাসের আরও কয়েকটি নাম
মুসলমানদের কাছে রমজান মাসটি বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে পরিচিত। তাদের অন্তরে আছে মাসটির পূত ও পবিত্রতার গুরুত্ব। এসব কারণে মুসলমানদের কাছে এই মাসটি আরও কয়েকটি নামে পরিচিত।
১। شهر الصيام (সিয়াম-সাধনার মাস)
২। شهر الصبر (ধৈর্যের মাস)
৩। شهر العتق من النيران (জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস)
৪। شهر القيام (রাত জাগার মাস)
৫। شهر الإحسان (অনুকম্পার মাস)
৬। شهر إجابة الدعاء (দোয়া কবুলের মাস)
৭। شهر الخيرات (কল্যাণের মাস)
৮। شهر الجود (দানশীলতার মাস)
৯। شهر الرحمة (রহমতের মাস)
১০। شهر المغفرة (মাগফিরাতের মাস)
১১। شهر المواساة (পরস্পর সহানুভূতির মাস)
সূত্র: সাফাহাতুন রামাজানিয়্যাতুন: পৃ. ৯, ১৩
যে কারণে রমজান মাস শ্রেষ্ঠ
হিজরি বছরের গণনা অনযায়ী আরবি বারো মাসের বারোটি নাম আছে। মাসগুলোর ধারাবাহিক পূর্ণাঙ্গ নাম হলো এই,
১. مُحَرَّمٍ اَلْحَرَامِ
২. صَفَرُ الْمُظَفَّر
৩. رَبِيعُ الْأَوَّلِ
৪. رَبِيعُ الثَّانِي
৫. جُمَادَى الْأُولَى
৬. جُمَادَى الْآخِرَةِ
৭. رَجَبُ الْمُرَجَّبِ
৮. شَعْبَانُ الْمُعَظَّمِ
৯. رَمَضَانُ الْمُبَارَكِ
১০. شَوَّالُ الْمُكَرَّمِ
১১. ذِي الْقِعْدَةِ
১২. ذِي الْحِجَّةِ
পবিত্র কোরআনুল কারীম ও হাদিসে নববির দ্বারা উক্ত মাসটি অন্যান্য মাসগুলোর থেকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
১. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ ؕ وَ مَنْ كَانَ مَرِیْضًا اَوْ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیْدُ اللّٰهُ بِكُمُ الْیُسْرَ وَ لَا یُرِیْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ ؗ وَ لِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَ لِتُكَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ
রমজান মাস- যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য (আদ্যোপান্ত) হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেনো এ সময় অবশ্যই রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য দিনে সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটিই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না, এবং (তিনি চান) যাতে তোমরা রোজার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবির পাঠ করো এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা বাকারা: আয়াত-১৮৫)
২. অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةٍ مُّبٰرَكَةٍ اِنَّا كُنَّا مُنْذِرِیْنَ আমি এটি (অর্থাৎ কোরআন) নাজিল করেছি এক মোবারক রাতে। (কেননা) আমি মানুষকে সতর্ক করার ছিলাম। (সুরা দুখান: আয়াত-৩)
অধিকাংশ আলেমের মতে উক্ত আয়াত দ্বারা শবে কদর বুঝানো হয়েছে। তাদের কথার প্রমাণ পাওয়া যায় সুরা কদরের শুরু আয়াত দ্বারা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةِ الْقَدْرِ নিশ্চয় আমি এটি (অর্থাৎ কোরআন) শবে কদরে নাজিল করেছি। (সুরা কদর: আয়াত-১)
উক্ত দুটি আয়াত দ্বারা পবিত্র কোরআনুল কারীম শবে কদরে নাজিল হয়েছে প্রমাণিত। আর প্রথম আয়াত দ্বারা পবিত্র কোরআনুল কারীমের মাস রমজান সেটি প্রমাণিত। (তাফসিরে ইবনে কাসির: খ. ৭, পৃ. ২৫৫)
সুতরাং পবিত্র কোরআনুল কারীমের মাসে শবে কদর হওয়ায় রমজান মাসটির শ্রেষ্ঠত্ব আরও বেড়ে যায়।
৩. হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, سَيِّدُ الشُّهُورِ شَهْرُ رَمَضَانَ، وَأَعْظَمُهَا حُرْمَةً ذُو الْحِجَّةِ রমজান মাস হলো সমস্ত মাসের সরদার। আর জিলহজ মাস হলো সম্মানের দিক দিয়ে সমস্ত মাস থেকে মহান। (মাজমাউজ জাওয়ায়িদ: হাদিস-৪৭৭৫)
৪. হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
نِعْمَ الشَّهْرُ شَهْرُ رَمَضَانَ، تُفَتَّحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَتُغَلَّقُ فِيهِ أَبْوَابُ النَّارِ، وَتُصَفَّدُ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، وَيُغْفَرُ فِيهِ، إِلا لِمَنْ أَبَى .قَالُوا: مَنْ يَأْبَى يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: الَّذِي لا يَسْتَغْفِرُ রমজান মাস কতোই না উত্তম মাস! এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানগুলোকে শিকলবন্দি করা হয়। (মুসলমানদেরকে) ক্ষমা করে দেয়া হয়। তবে যে অস্বীকার করলো তাকে ক্ষমা করা হয় না। সাহাবারা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ অস্বীকারকারী কে? তিনি বললেন, যে (আল্লাহ তায়ালার কাছে) ক্ষমা চায় না। (ফাজায়িলে শাহরে রমাজান লি আবদিল গণি আল-মাকদিসি: পৃ.৪২)
৫. হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,لَوْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا لَهُمْ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ لَتَمَنَّتْ أُمَّتِي أَنْ تَكُونَ السَّنَةُ كُلُّهَا شَهْرَ رَمَضَانَ মানুষ যদি রমজান মাসের (পরিপূর্ণ কল্যাণ) জানতে পারতো, তাহলে সারা বছর রমজান মাস থাকার আকাঙ্ক্ষা করতো। (ফাজায়িলে শাহরে রমাজান লি আবদিল গণি আল-মাকদিসি: পৃ.৪৪)
৬. হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
أَظَلَّكُمْ شَهْرُكُمْ هَذَا بِمَحْلُوفِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا مَرَّ بِالْمُسْلِمِينَ شَهْرٌ خَيْرٌ لَهُمْ مِنْهُ، وَلَا مَرَّ بِالْمُنَافِقِينَ شَهْرٌ شَرٌّ لَهُمْ مِنْهُ
তোমাদের উপর তোমাদের এই মাস উদিত হয়েছে। আমার সত্তার কসম! মুসলমানদের উপর এই মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো মাস অতিবাহিত হয়নি। আর মুনাফিকদের উপর এই মাসের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো মাস অতিবাহিত হয়নি। (মুসনাদের আহমাদ: হাদিস-১০৭৮৩)
অন্য বর্ণনায় উক্ত মাসকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করার আদেশও বর্ণিত হয়েছে।
৭. হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
قَدْ جَاءَكُمْ شَهْرُ رَمَضَانَ افْتَرَضَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفَتَّحُ فِيهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَتُغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، وَتُغَلَّقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর এই মাসে রোজা রাখা ফরজ করেছেন। এই মাসে আসমানের দরজাগুলোকে খুলে দেয়া হয়। শয়তানদেরকে শিকলবন্দি করে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়। আর এই মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। (ফাজায়িলে শাহরে রমাজান লি আবদিল গণি আল-মাকদিসি: পৃ.৪৬)
অন্য বর্ণনায় উক্ত মাসকে মোবারক মাস হিসেবে তিনি স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে কল্যাণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, সে মূলত সমস্ত কল্যাণ থেকেই মাহরুম হয়ে গেলো।’ (সুনানে নাসায়ি: হাদিস-২১০৬)
৮. হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
أُنْزِلَتْ صُحُفُ إِبْرَاهِيمَ أَوَّلَ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ، وَأُنْزِلَتِ التَّوْرَاةُ لِسِتٍّ مَضَيْنَ مِنْ رَمَضَانَ، وَأُنْزِلَ الإِنْجِيلُ لِثَلاثَ عَشْرَةَ خَلَتْ مِنْ رَمَضَانَ، وَأُنْزِلَ الْقُرْآنُ لأَرْبَعٍ وَعِشْرِينَ خَلَتْ مِنْ رَمَضَانَ রমজানের প্রথম রাতে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের উপর সহিফা নাজিল করা হয়। রমজানের তেরো তারিখে ইঞ্জিল কিতাব নাজিল করা হয়। রমজানের আঠারো তারিখে জাবুর কিতাব নাজিল করা হয়। রমজানের ছয় তারিখে তাওরাত কিতাব নাজিল করা হয়। রমজানের চব্বিশ তারিখে পবিত্র কোরআনুল কারীম নাজিল করা হয়। (মুসনাদে আহমাদ)
অন্য বর্ণনায় রমজানের আঠারো তারিখে নাজিল হওয়ার কথা এসেছে। (শুয়াবুল ঈমান: হাদিস-২০৫৩) এছাড়াও হাদিসে উক্ত মাসটির অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেসব ফজিলতের কারণে উক্ত মাসটি মুসলমানদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। সুস্থমস্তিস্ক ও প্রাপ্তবয়সী মুসলমান নর-নারীর উপর উক্ত মাসে রোজা রাখাকে শরিয়ত কর্তৃক ফরজ করা হয়েছে।
লেখক: মুদাররিস, অনুবাদক, সংকলক, আকাবির আসলাফ সিরিজ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।