জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ঘিরে নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। জাতিসংঘের অনুরোধে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মতি দিলেও, এ সিদ্ধান্ত ঘিরে রাজনীতি ও নিরাপত্তার দিক থেকে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। রাখাইনে চলমান সংঘাত, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ এবং জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এই পদক্ষেপের গুরুত্ব যেমন অনেক, তেমনি উদ্বেগও কম নয়।
Table of Contents
রাখাইনে মানবিক করিডর বিষয়টি শুধু একটি সহায়তার রাস্তা নয়—এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই করিডোরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ব্যবহার করা হলে ভবিষ্যতে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তবু, মানবিক দিক বিবেচনায় এ ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না।
রাখাইনে মানবিক করিডর: বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ও এর পটভূমি
রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে যে সম্মতি দিয়েছে, তা সরাসরি জাতিসংঘের অনুরোধের প্রেক্ষিতে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাখাইনে বর্তমানে হাজার হাজার মানুষ খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকটে ভুগছে। রাখাইন রাজ্যে একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সরবরাহের জন্য একটি করিডোর খোলা প্রয়োজন বলে মনে করছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশ সরকারও রাখাইনের মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করিডোরের বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেওয়া হয়েছে, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যেমন—রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা, ত্রাণের সমবন্টন নিশ্চিত করা এবং শর্তহীন সহায়তা সরবরাহ।
তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এখনও জাতিসংঘের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি এবং এটি “মানবিক করিডোর” নয় বরং “লজিস্টিক সাপোর্ট” বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এই দ্বৈত বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, করিডোর বিষয়ক সিদ্ধান্ত এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। তবুও, নীতিগত সম্মতির মাধ্যমে বিষয়টি একটি দিকেই এগোচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানবিক করিডোর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও কৌশলগত উদ্বেগ
মানবিক করিডোর বাস্তবায়ন শুধু নৈতিক বা মানবিক প্রশ্ন নয়—এটি কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কেও গভীরভাবে জড়িত। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেছেন, রাখাইনে বর্তমানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘাত চলছে। এই প্রেক্ষাপটে করিডোর খুলে দিলে যদি কোনো পক্ষ এতে লাভবান হয়, তাহলে অন্য পক্ষের প্রতিক্রিয়া আসবেই। ফলে বাংলাদেশ নিজেই একটি নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই করিডোর বাস্তবায়নে মিয়ানমারের সরকার এবং আরাকান আর্মি—উভয়পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। এক পক্ষের আপত্তি থাকলে এই করিডোর বাস্তবায়ন হবে না। এ কারণে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
সেখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠছে—কেন শুধুমাত্র বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এই করিডোর গঠনের কথা উঠছে? বঙ্গোপসাগর কিংবা থাইল্যান্ড, ভারত কিংবা চীন—এসব দেশকেও এই মানবিক সহায়তার উদ্যোগে যুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বিষয়টি আরও ঘোলাটে হয়েছে, কারণ রাখাইনে কোন পথ দিয়ে করিডোর যাবে তা এখনও নির্ধারিত নয়। স্থলপথে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে কিংবা নৌপথে বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে ত্রাণ সরবরাহ সম্ভব—এই দুটি বিকল্পই আলোচনায় রয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: কেন বিতর্কে জড়ালো করিডোর ইস্যু?
রাখাইনে মানবিক করিডোর ইস্যুতে সবচেয়ে বড় বিতর্ক শুরু হয়েছে দেশের রাজনীতিতে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তাঁর মতে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এমন একটি বিষয়ে কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ গ্রহণযোগ্য নয়।
গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকেও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে। তারা বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিষয় জড়িত থাকায় এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকা জরুরি। সরকারের একক সিদ্ধান্ত দেশে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি সাধারণ প্রশ্ন—বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে কি অন্য কোনো দেশের স্বার্থে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া উচিত? এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা দ্ব্যর্থবোধক বার্তা আসায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
রাখাইনে সহায়তার প্রয়োজনীয়তা: মানবিকতা বনাম নিরাপত্তা
একদিকে যদি নিরাপত্তা ও রাজনীতির প্রশ্ন উঠে, অন্যদিকে রয়েছে একটি ভয়াবহ মানবিক সংকট। রাখাইন রাজ্যে এখন হাজার হাজার মানুষ খাদ্য, ওষুধ, ও বীজের অভাবে রয়েছে। এই মুহূর্তে মানবিক করিডোর খুলে দিলে হয়তো হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।
জাতিসংঘের মতে, মানবিক করিডোর খুলে দিলে শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা নয়, বরং সেখানে সহিংসতার মাত্রাও কমে আসতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো—যেখানে সরকার এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী যুদ্ধরত, সেখানে নিরপেক্ষভাবে ত্রাণ বিতরণ প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশের অবস্থান তাই দ্বিধান্বিত। একদিকে রয়েছে একটি মানবিক দায়িত্ব, অন্যদিকে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ঝুঁকি। এই দোলাচল থেকেই জন্ম নিয়েছে বিতর্ক এবং জনগণের মধ্যে শঙ্কা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
রাখাইন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিও এখন বাংলাদেশের দিকে। কেননা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র—সব পক্ষই রাখাইন ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একধরনের আগ্রহ দেখিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা হবে অনেক বেশি গুরুত্ববহ। কারণ মানবিক করিডোরের মাধ্যমে যদি একপক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্বের আভাস মেলে, তাহলে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই কৌশলগত দিক বিবেচনায় করিডোর বাস্তবায়নের আগে আন্তর্জাতিক মহলকেও সঙ্গে নেওয়া জরুরি।
করিডোর বাস্তবায়নে কী হতে পারে বাংলাদেশের কৌশল?
বাংলাদেশ যদি সত্যিই রাখাইনে মানবিক করিডোর বাস্তবায়ন করে, তাহলে তা হতে হবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং নিরপেক্ষ। কিছু কৌশল হতে পারে:
- জাতিসংঘের নেতৃত্বে এবং তত্ত্বাবধানে করিডোর বাস্তবায়ন
- সব পক্ষের লিখিত সম্মতি এবং অংশগ্রহণ
- বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার হলেও নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিশ্চিত করা
- প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা
- সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যমের তদারকি রাখা
এই ধরনের একটি কৌশল বাস্তবায়ন না হলে করিডোর তৈরি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাখাইনে মানবিক করিডর ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন এক জটিল দ্বন্দ্বের মুখোমুখি—মানবিক দায়বদ্ধতা বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। এই করিডোর কেবল ত্রাণ নয়, বরং একটি বৃহৎ কূটনৈতিক অবস্থানও প্রকাশ করে। তাই সময় এসেছে, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে, স্বচ্ছ এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবারের কাছে ঘরের চাবি হস্তান্তর করলেন প্রধান উপদেষ্টা
রাখাইনে মানবিক করিডোর কী? রাখাইনে মানবিক করিডোর হলো একটি নিরাপদ রুট, যার মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন রাজ্যে। এটি সাধারণত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ কেন করিডোর দিতে সম্মত হয়েছে? মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বিবেচনায় জাতিসংঘের অনুরোধে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তবে এটি এখনো আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দেওয়া হয়েছে।
এই করিডোর কি বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে? হ্যাঁ, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় করিডোর তৈরি করলে তা ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
রাখাইনে কোন পথে করিডোর হতে পারে? স্থলপথে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে অথবা বঙ্গোপসাগর হয়ে নৌপথে করিডোর হতে পারে, তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
সব রাজনৈতিক দল করিডোর বিষয়ে একমত কি? না, বিএনপি ও গণসংহতি আন্দোলন সরকারের একক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।