রাতের অন্ধকারে যখন শহর নিস্তব্ধ, তখনও লক্ষ মানুষের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করা, ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকা, আর মাথায় শুধুই একটি প্রশ্ন – “কখন আসবে ঘুম?” এই ব্যস্ত, চাপপূর্ণ জীবনে রাতে ভালো ঘুমের জন্য করণীয় জানা শুধু আরামের কথা নয়, এটি সুস্থতা ও উৎপাদনশীলতার বুনিয়াদ। মনে রাখবেন, ঘুম কোনো বিলাসিতা নয়; এটি একান্ত প্রয়োজনীয়তা, আমাদের দেহ ও মনের জন্য প্রাকৃতিক মেরামতির কারখানা। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন অনিদ্রা বা ঘুমের অন্য কোনো সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু হতাশ হবেন না। আজকের এই নিবন্ধে শুধু তত্ত্ব নয়, আমি আপনাকে জানাবো সেইসব সহজ, প্রায়োগিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কৌশল, যা আপনাকে আবারও ফিরিয়ে দেবে রাতের শান্তি আর সকালের সতেজতা।
ঘুম কেন এত জরুরি: শুধু ক্লান্তি দূর করাই নয়!
ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, এটি দেহ-মনের পুনর্নির্মাণ। যখন আমরা ঘুমাই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক দিনের সমস্ত তথ্য প্রক্রিয়া করে, স্মৃতি সংরক্ষণ করে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের কোষগুলো মেরামত হয়, হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা পায় (বিশেষ করে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা), রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণা মতে, প্রতিদিন ৭-৯ ঘন্টা গভীর ঘুম না হলে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, এমনকি বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের ঝুঁকি। এটি সরাসরি প্রভাব ফেলে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের উপর। একটি গভীর ও পূর্ণাঙ্গ ঘুমের চক্র (স্লিপ সাইকেল) এর মধ্য দিয়ে যাওয়াটা তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার অপরিহার্য স্তম্ভ।
আপনার ঘুমের পরিবেশ গড়ে তুলুন: শান্তির নীড়
আপনার শোবার ঘরই হওয়া উচিত ঘুমের জন্য আদর্শ আশ্রয়স্থল। এর পরিবেশ কেমন হবে, তা সরাসরি প্রভাবিত করে আপনার ঘুমের গুণগত মান।
- অন্ধকারের রাজত্ব: মেলাটোনিন নামক ‘ঘুমের হরমোন’ নিঃসরণের জন্য অন্ধকার অপরিহার্য। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন (NSF) জোর দিয়ে বলে, কৃত্রিম আলো, বিশেষ করে নীল আলো (ব্লু লাইট) – মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিন থেকে নির্গত – মেলাটোনিন উৎপাদনে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে। সমাধান:
- ঘরের জন্য অন্ধকার, ঘন পর্দা (ব্ল্যাকআউট কার্টেন) ব্যবহার করুন।
- রাতে (বিশেষ করে ঘুমানোর ১-২ ঘন্টা আগে) ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। অসম্ভব হলে ‘নাইট মোড’ চালু করুন বা ব্লু লাইট ব্লকিং চশমা পরুন।
- ঘরে থাকা ছোট ছোট আলোর উৎস (লাল বা সবুজ LED, চার্জারের আলো) ঢেকে দিন বা সরিয়ে ফেলুন। সম্পূর্ণ অন্ধকারই লক্ষ্য।
- শব্দহীনতা বা সাদা শব্দ: রাস্তার গাড়ির আওয়াজ, প্রতিবেশীর টিভি, পাখির ডাক – অল্প শব্দও গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সমাধান:
- জানালা বন্ধ রাখুন বা শব্দরোধী পর্দা ব্যবহার করুন।
- হোয়াইট নয়েজ মেশিন বা অ্যাপ ব্যবহার করুন (যেমন: পাখির ডাক, সমুদ্রের ঢেউ, বৃষ্টির শব্দ)। এই স্থির, একঘেয়ে শব্দ অন্যান্য হঠাৎ শব্দকে ঢেকে দিতে সাহায্য করে।
- আরামদায়ক ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করুন।
- ঠাণ্ডা আরাম: গবেষণা মতে, ঘরের আদর্শ তাপমাত্রা ১৮-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬৫-৭২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর মধ্যে হওয়া উচিত। খুব গরম বা খুব ঠাণ্ডা উভয়ই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। দেহের কোর তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য কমলেই ঘুম আসতে সাহায্য করে। সমাধান:
- এসি, ফ্যান বা হিটার ব্যবহার করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন।
- শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়ক, প্রাকৃতিক তন্তুর (সুতি, লিনেন, বাঁশের আঁশ) হালকা চাদর ও বালিশের কভার ব্যবহার করুন। সিনথেটিক কাপড়ে ঘাম জমে অস্বস্তি হতে পারে।
- আরামদায়ক বিছানা: আপনার গদি, বালিশ ও কম্বল – সবকিছুই হওয়া উচিত স্বস্তিদায়ক। একটি পুরানো বা নরম/শক্ত গদি পিঠে ব্যথা ও অস্বস্তির কারণ হতে পারে। প্রতি ৭-১০ বছর পর গদি পরিবর্তন করা উচিত। বালিশের উচ্চতা এমন হওয়া দরকার যাতে ঘাড় মেরুদণ্ডের সমান্তরালে থাকে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারস অ্যান্ড স্ট্রোক (NINDS) সুপারিশ করে যে ঘুমের পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিন – এটি ঘুমের মান উন্নয়নের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি।
রাতের রুটিন: ঘুমের জন্য মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করুন
একটি স্থির, শিথিলকারী রাতের রুটিন আপনার মস্তিষ্ক ও দেহকে সংকেত দেয় যে এখন বিশ্রামের সময় এসেছে। এটি আপনার অভ্যন্তরীণ ঘড়ি (সার্কাডিয়ান রিদম) কে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- নির্দিষ্ট সময় মেনে চলুন: প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে উঠুন (সপ্তাহান্তেও!)। এই ধারাবাহিকতা আপনার দেহের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে শক্তিশালী করে, ঘুম আসাটাকে স্বাভাবিক করে তোলে। ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা পরের রাতের ঘুম নষ্ট করতে পারে।
- ডিজিটাল ডিটক্স: ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘন্টা (আদর্শ ২ ঘন্টা) আগে টিভি, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট বন্ধ করুন। স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদন দমন করে। চাপপূর্ণ ইমেইল বা খবর পড়াও উদ্বেগ বাড়িয়ে ঘুম তাড়াতে পারে।
- শিথিলকরণের আচার: এই সময়টি নিজেকে শান্ত করার জন্য নির্ধারিত করুন:
- গরম পানিতে গোসল বা শাওয়ার: দেহের কোর তাপমাত্রা সামান্য কমিয়ে আনে, যা ঘুমের সংকেত দেয়।
- হালকা, ধীর গতির স্ট্রেচিং বা ইয়োগা: শারীরিক চাপ দূর করে (যেমন: বালাসন বা শিশুর ভঙ্গি)।
- গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (ডিপ ব্রিদিং) বা প্রগতিশীল পেশী শিথিলকরণ (PMR): উদ্বেগ কমাতে খুব কার্যকর।
- হালকা সঙ্গীত শোনা, ধ্যান করা বা নিঃশব্দে বসে থাকা।
- কাগজে কলমে চিন্তা লিখে ফেলা: পরের দিনের কাজের তালিকা বা মাথায় ঘুরপাক খাওয়া দুশ্চিন্তাগুলো লিখে ফেললে মস্তিষ্ক হালকা হয়।
- পাঠের সময়: একটি ভালো বই (কঠিন বা উত্তেজনাপূর্ণ নয়!) পড়তে পারেন। কিন্তু ই-বুক রিডার নয়, বরং কাগজের বই বেছে নিন।
- রুটিনের ধারাবাহিকতা: প্রতিদিন একই ক্রমে শিথিলকারী কার্যকলাপগুলো করুন। এতে মস্তিষ্ক দ্রুত সংকেত পায় যে ঘুমের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
দিনের অভ্যাস: সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দর ঘুমের ভিত্তি
আপনার দিনের বেলাকার অভ্যাসও রাতের ঘুমকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
- সকালের রোদ: প্রতিদিন সকালে ১৫-৩০ মিনিট প্রাকৃতিক সূর্যালোকে থাকুন। এটি আপনার সার্কাডিয়ান রিদমকে শক্তিশালী করে, দিনের বেলা সতেজ থাকতে এবং রাতে মেলাটোনিন নিঃসরণ সঠিক সময়ে শুরু হতে সাহায্য করে। জানালার পাশে বসে কাজ করলেও উপকার পাবেন।
- শারীরিক ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম ঘুমের গুণগত মান বাড়ায় এবং ঘুমাতে যাওয়ার সময় কমায়। তবে, ঘুমানোর খুব কাছাকাছি সময়ে (২-৩ ঘন্টা আগে) ভারী বা উচ্চ-তীব্রতার ব্যায়াম করবেন না। এটি দেহ উত্তপ্ত করে এবং ঘুম আসতে বাধা দিতে পারে। সকালে বা বিকালে ব্যায়াম করা আদর্শ। হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার বা যোগব্যায়াম – যেকোনো মধ্যম মাত্রার কার্ডিও ব্যায়াম উপকারী।
- ক্যাফেইন ও নিকোটিন নিয়ন্ত্রণ: কফি, চা (বিশেষ করে গ্রিন টি), এনার্জি ড্রিংক বা কোলার মত ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় ঘুমানোর কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা আগে পান করা বন্ধ করুন। ক্যাফেইন একটি উত্তেজক, যা ঘুমের প্রবণতায় বাধা দেয়। একইভাবে, নিকোটিনও উত্তেজক হিসেবে কাজ করে, তাই ঘুমানোর আগে ধূমপান এড়িয়ে চলুন। সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) ক্যাফেইন ও নিকোটিনকে ঘুমের অন্যতম প্রধান ব্যাঘাতকারী হিসেবে চিহ্নিত করে।
- অ্যালকোহল নয়: অনেকের ধারণা অ্যালকোহল ঘুমাতে সাহায্য করে। এটি আংশিক সত্য – অ্যালকোহল আপনাকে দ্রুত ঘুম পাড়াতে পারে, কিন্তু এটি ঘুমের গুণগত মান, বিশেষ করে REM (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুমের পর্যায়কে ব্যাহত করে। ফলে ঘুম ভাঙভাঙ লাগে, রাতে বারবার জেগে ওঠা এবং সকালে ক্লান্তি অনুভব হতে পারে।
- রাতের খাবার: ঘুমানোর কমপক্ষে ২-৩ ঘন্টা আগে রাতের খাবার শেষ করুন। ভারী, চর্বিযুক্ত, মশলাদার বা অম্লীয় খাবার খেলে তা হজমের সমস্যা (অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা বুকজ্বালা) সৃষ্টি করে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। রাতে হালকা, সহজপাচ্য খাবার খান। প্রোটিন ও জটিল কার্বোহাইড্রেটের (যেমন: ছোট পরিমাণ ভাত/রুটি, ডাল, সবজি) সংমিশ্রণ ভালো। অতিরিক্ত চিনি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- দুপুরের ঘুম সতর্কভাবে: দিনের বেলা ২০-৩০ মিনিটের ছোট্ট একটি পাওয়ার ন্যাপ সতেজতা আনতে পারে। কিন্তু বিকেল ৩টার পর ঘুমাবেন না এবং দীর্ঘ সময় (৩০ মিনিটের বেশি) ঘুমাবেন না। এটি রাতের ঘুমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যখন ঘুম আসে না: বিছানায় এপাশ-ওপাশ না করে যা করবেন
১৫-২০ মিনিট বিছানায় শুয়ে থাকার পরও যদি ঘুম না আসে, তাহলে বিছানায় শুয়ে আর চেষ্টা করবেন না। এতে হতাশা বাড়ে এবং বিছানাকে জেগে থাকা ও হতাশার সাথে যুক্ত করে ফেলার ঝুঁকি থাকে।
- বিছানা ছাড়ুন: শান্তিপূর্ণভাবে অন্য ঘরে চলে যান।
- শিথিলকারী কাজ করুন: মৃদু আলোয় বসে বই পড়ুন (কঠিন বিষয় নয়), শান্ত, মৃদু সঙ্গীত শুনুন, গভীর শ্বাস নিন বা হালকা স্ট্রেচিং করুন।
- উত্তেজক কিছু নয়: ফোন চেক করা, টিভি দেখা, ভারী কাজ করা, গরম বা ঠান্ডা ঝালাই খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- ক্লান্তি চলে এলে ফিরে যান: শুধুমাত্র যখন আপনি সত্যিই ঘুমাতে প্রস্তুত (চোখে ঘুম এসেছে) বোধ করবেন, তখনই বিছানায় ফিরে যান।
- ঘড়ির দিকে তাকাবেন না: বারবার সময় দেখলে তা উদ্বেগ বাড়ায়। ঘড়িটি এমন জায়গায় রাখুন যাতে সহজে দেখা না যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য ও ঘুম: অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা – এগুলো ঘুমের সবচেয়ে বড় শত্রু। আবার ঘুম না হওয়াটাও এই সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এটি একটি চক্র।
- চিন্তা থামানোর কৌশল: মেডিটেশন অ্যাপ (যেমন: ইনসাইট টাইমার, ক্যালম – বাংলায় গাইডেড মেডিটেশন আছে), জার্নালিং (মনের কথা লিখে ফেলা), বা শিথিলকরণের ব্যায়াম শিখুন ও চর্চা করুন।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: দিনে ছোট ছোট বিরতি নিন, নিজের জন্য সময় দিন, প্রিয়জনের সাথে কথা বলুন, প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটান। কাজের চাপকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভাগ করুন।
- পেশাদার সাহায্য: যদি উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা বা বিষণ্ণতা দীর্ঘদিন ধরে থাকে এবং ঘুমের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, মনোবিদ বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি ফর ইনসমনিয়া (CBT-I) অনিদ্রার জন্য অত্যন্ত কার্যকর একটি থেরাপি, যেখানে ওষুধ ছাড়াই ঘুমের অভ্যাস ও চিন্তাভাবনা পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক স্বাস্থ্য ও ঘুমের মধ্যে গভীর সংযোগের উপর জোর দেয় এবং প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে উৎসাহিত করে।
রাতের ঘুম শুধু চোখ বন্ধ করা নয়; এটি হচ্ছে পরের দিনের শক্তি, সুস্থতা ও আনন্দের বীজ বপন করা। এই রাতে ভালো ঘুমের জন্য করণীয় সহজ কৌশলগুলোকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে নিন। ধৈর্য ধরুন, নিজের প্রতি সদয় হোন। হয়তো প্রথম রাতেই অলৌকিক পরিবর্তন আসবে না, কিন্তু ধারাবাহিক চেষ্টায় অবশ্যই আপনি ফিরে পাবেন সেই মধুর, প্রশান্তিদায়ক ঘুম। আজই শুরু করুন – এই মুহূর্তে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ, যেমন রাত ১০টার পর মোবাইল না দেখা বা সকালে ১৫ মিনিট রোদে বসা, হতে পারে আপনার সুন্দর ঘুমের যাত্রার প্রথম সোপান। আপনার শরীর ও মন এই যত্নের যোগ্য!
জেনে রাখুন
১. রাতে কত ঘন্টা ঘুমানো উচিত?
বয়সভেদে ঘুমের চাহিদা ভিন্ন। প্রাপ্তবয়স্কদের (১৮-৬৪ বছর) সাধারণত ৭-৯ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। কিশোরদের (১৪-১৭ বছর) ৮-১০ ঘন্টা, স্কুলপড়ুয়া শিশুদের (৬-১৩ বছর) ৯-১১ ঘন্টা এবং প্রিস্কুলারদের (৩-৫ বছর) ১০-১৩ ঘন্টা ঘুম দরকার। তবে গুণগত মানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। গভীর ঘুম ও REM ঘুমের পর্যায়গুলো পূর্ণ হওয়া আবশ্যক। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন বয়স অনুযায়ী সুপারিশকৃত ঘুমের সময় প্রকাশ করে।
২. রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়, কী করব?
এটি বিরক্তিকর সমস্যা। প্রথমে কারণ খুঁজুন: অতিরিক্ত পানি পান? প্রস্রাবের সমস্যা? স্লিপ অ্যাপনিয়া (নাক ডাকা, শ্বাস বন্ধ হওয়া)? রাতে হালকা খাবার খান, ঘুমানোর ১-২ ঘন্টা আগে পানি কম পান করুন। ঘর অন্ধকার ও ঠাণ্ডা রাখুন। যদি নাক ডাকা বা শ্বাসকষ্ট থাকে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মানসিক চাপও কারণ হতে পারে, তাই শিথিলকরণ কৌশল চর্চা করুন। সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে ডাক্তার দেখান।
৩. কাজের শিফটের জন্য ঘুমের রুটিন কীভাবে ঠিক করব?
শিফট ওয়ার্ক, বিশেষত নাইট শিফট, সার্কাডিয়ান রিদমের জন্য চ্যালেঞ্জিং। দিনে ঘুমানোর সময় ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার ও শান্ত করার চেষ্টা করুন (ব্ল্যাকআউট কার্টেন, ইয়ারপ্লাগ, হোয়াইট নয়েজ)। রুটিন থেকে ফেরার পরপরই সূর্যের আলোয় কিছুক্ষণ থাকুন (সানগ্লাস খুলে) – এটি আপনার অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে পুনরায় সেট করতে সাহায্য করে। ঘুমানোর আগে হালকা নাস্তা করুন, ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন। ক্যাফেইন সেবনের সময়সীমা মনোযোগ দিয়ে ঠিক করুন।
৪. গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা দূর করার উপায় কী?
গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন, বুকজ্বালা, পা ব্যথা, বারবার প্রস্রাব ইত্যাদি কারণে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বাম কাতে ঘুমান (বিশেষ করে শেষের দিকে), পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে উঁচু করুন, মাথার নিচে বা পেটের নিচে (পাশ ফিরে শোওয়ার সময়) অতিরিক্ত বালিশ ব্যবহার করুন। দিনে ছোট ছোট ঘুম (পাওয়ার ন্যাপ) নিতে পারেন। হালকা ব্যায়াম (চিকিৎসকের পরামর্শে) ও পর্যাপ্ত পানি পান করুন (দিনের বেলায় বেশি, রাতে কম)। কোনো ওষুধ বা হরবাল চা খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
৫. বাচ্চাদের ভালো ঘুমের জন্য কী করণীয়?
শিশুদেরও একটি স্থির রাতের রুটিন দরকার (যেমন: গোসল > পাজামা পরা > দাঁত ব্রাশ > গল্প বলা/গান শোনা > ঘুম)। ঘর অন্ধকার ও শান্ত রাখুন। দিনের বেলায় পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক আলো নিশ্চিত করুন। ঘুমানোর আগে উত্তেজক খেলা বা স্ক্রিন টাইম এড়িয়ে চলুন। ছোট বাচ্চাদের জন্য আরামদায়ক কম্বল বা খেলনা (কমফোর্ট অবজেক্ট) সাহায্য করতে পারে। ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৬. ঘুমের ওষুধ (স্লিপিং পিল) কতটা নিরাপদ?
ঘুমের ওষুধ শর্ট-টার্ম সমাধান হিসেবে ডাক্তারের পরামর্শে ও কঠোর তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করা উচিত। দীর্ঘদিন ব্যবহারে নির্ভরতা, সহনশীলতা (ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া) এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (পরের দিন ঝিমুনি, মাথা ঘোরা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, এমনকি স্লিপওয়াকিং) হতে পারে। ঘুমের অভ্যাস ও পরিবেশ উন্নত করাই (স্লিপ হাইজিন) সবচেয়ে টেকসই ও নিরাপদ সমাধান। কোনো ওষুধ নিজে নিজে বা দীর্ঘদিন সেবন করবেন না। প্রাকৃতিক উপায়ে ঘুম না এলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন, তিনি প্রয়োজনে ওষুধ দেবেন বা CBT-I থেরাপির পরামর্শ দেবেন।
📌 দ্রষ্টব্য: এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য সাধারণ জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক সুপারিশ। এটি কোনো চিকিৎসা পরামর্শের বিকল্প নয়। দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র ঘুমের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট (স্লিপ অ্যাপনিয়া), বা অন্যান্য শারীরিক/মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগ থাকলে অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।