জুমবাংলা ডেস্ক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ ছাড়ের শর্তে রিজার্ভের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাস্তবতার নিরিখে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিলেও কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আহরণ বাড়েনি। এসব কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করে আগামী দিনে রিজার্ভ ও রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণের শর্তগুলো নিয়ে গতকাল বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম দিনের বৈঠকে এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে আইএমএফের ডেভেলপমেন্ট মাইক্রোইকোনমিকস ডিভিশনের প্রধান ক্রিস পাপাগেওর্জিউর নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধিদল।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ঋণ কর্মসূচির আওতায় শর্ত বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে আসা আইএমএফ মিশন বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চলতি ও আগামী বাজেটে আরো ব্যয় সংকোচন এবং ভর্তুকি কমিয়ে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ক্রলিং পেগ বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চেয়েছে। বর্তমানে কী প্রক্রিয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান নির্ধারিত হচ্ছে, সে বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্থাটি। একই সঙ্গে ক্রমেই দুর্বল অবস্থায় থাকা রিজার্ভ বাড়ানো এবং আর্থিক হিসাবে ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার তাগিদ দিয়েছে প্রতিনিধিদল।
‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এতে মুদ্রার দর সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন নির্ধারণ করা সীমার মধ্যে রাখা হয়। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।
গতকাল অর্থ বিভাগের বাজেট এবং ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে আইএমএফ মিশন। এই বৈঠকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এবং আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্তের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছর ও আগামী অর্থবছরের কর জিডিপির অনুপাত ০.৫ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জাতীয় নির্বাচন পরিস্থিতির বিবেচনায় শর্ত সহজ করার অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় কিস্তির ঋণ ছাড় গত ডিসেম্বরভিত্তিক রিজার্ভ, রাজস্ব আহরণসহ বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছিল আইএমএফ।
এদিকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সংশোধিত কর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার বিপরীতে এক লাখ ৬২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা আদায় করেছে সরকার। চলতি অর্থবছর শেষে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা কর রাজস্ব আহরণ করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসের রাজস্ব আহরণ প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করে এনবিআর শঙ্কা প্রকাশ করেছে, জুন শেষে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে থাকতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা এবং আগামী অর্থবছরে কর জিডিপির অনুপাত ০.৫ শতাংশ বাড়ানোর পর্যাপ্ত কর্মপরিকল্পনা না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ মিশন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছর কর জিডিপির অনুপাত ৭-৮ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আবারও করনীতি প্রশাসন ও কর আহরণ কর্তৃপক্ষ আলাদা করার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। এই বাস্তবতায় রাজস্ব বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জোর তাগিদ দিয়েছে আইএমএফ।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৮১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে দুই লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ নিজের লক্ষ্যমাত্রা থেকেই সংস্থাটি পিছিয়ে রয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের দেওয়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পুরো অর্থবছরে এনবিআরকে চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে।
রাজস্ব আহরণে গতি না থাকা এবং সার্বিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে গত অর্থবছর থেকেই ব্যয় সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। তবু আগামী দিনে অর্থিক ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংকোচননীতি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে যেসব জায়গায় ভর্তুকি কমানোর সুযোগ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমিয়ে বাজেট ঘাটতি সংশোধিত বাজেটে জিডিপির ৪.৬ শতাংশ নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। চলতি বাজেটে এ ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫.২ শতাংশ। আগামী বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি ৪.৬ শতাংশের মধ্যে রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বৈদেশিক লেনদেন নিয়ে আলোচনার পর্যায়ে মুদ্রা বিনিময় হার আরো বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি কিছুটা বাড়ায় চলতি হিসাবে এর মধ্যে বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি রয়েই গেছে। এ ক্ষেত্রে চলতি হিসাবে স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি আর্থিক ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার তাগিদ দেওয়া হয়। সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে বাড়তি নজর দিতে বলছে সংস্থাটি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সাড়ে তিন বছর মেয়াদে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কার্যক্রমের বিপরীতে আইএমএফ অনেক শর্ত দেয়। রিজার্ভ ছাড়া প্রায় সব শর্ত পূরণ করে দুই দফায় দুই কিস্তিতে ১১৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এবার তৃতীয় কিস্তির পালা। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী মে মাস নাগাদ তৃতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড় করতে পারে আইএমএফ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের শর্ত কতটুকু কী পূরণ হলো, তার মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই কিস্তি ছাড় করা হবে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ ছাড়া সব শর্ত পূরণ করেছে সরকার। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অব্যাহতি চেয়েছিল বাংলাদেশ, সংস্থাটি তা অনুমোদন করে। সে অনুযায়ী ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। গত ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২৬.৮ বিলিয়ন ডলার, তা থেকে কমিয়ে ১৭.৭৮ বিলিয়ন ডলার করা হয়। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিট রিজার্ভ ছিল ১৬.৭৫ বিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের মার্চ মাসেও নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। মার্চ শেষে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ১৯.২৬ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুনে ২৩.৭ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও নিট রিজার্ভ ছিল ১৯.৫ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে ঢাকা সফরে সংস্থাটির ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি থাকবে ৮ মে পর্যন্ত। এই সময়ে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
সংবাদ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না সাংবাদিকদের
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।