মির্জা মেহেদী তমাল : রাজধানীতে হঠাৎ বেড়েছে ছিনতাই ডাকাতি। একের পর এক দুর্ধর্ষ সব ঘটনায় আতঙ্ক মানুষের মধ্যে। পুলিশের ওপর ভীষণ চাপ। কোনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে না তারা। পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। এমনই এক পরিস্থিতিতে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু হয়। সময়টা ২০১৩। ওই বছর ৪ জুন রাজধানীর দক্ষিণখান থানার গাওয়াইর থেকে তিন ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরা হলো সাইফুল ইসলাম মামুন, আকবর আলী লালু ওরফে রনি এবং আল আমিন। এ সময় তাদের কাছ থেকে কালো রঙের একটি বিদেশি ২২ বোরের রিভলবার উদ্ধার করা হয়। ছিনতাইকারীদের হাতে এমন দামি অস্ত্র দেখে গোয়েন্দারা হতবাক। অস্ত্রের উৎস নিয়ে জেরা করে তাদের। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে খিলক্ষেতের সেবা ক্লিনিকের মালিক আবুল হোসেনের বাসায় ডাকাতি করে মামুনরা। অন্যান্য মালের সঙ্গে রিভলবারটিও তারা লুটে নিয়ে যায়। এমনসব তথ্য পেয়ে গোয়েন্দারা জেরার পরিধি বাড়ায়। কয়জনকে খুন করেছিস? অস্বীকার করে তারা। বলে, ‘স্যার, আমরা এই মাল দিয়ে ভয় দেখাই। ভালো কাজে দেয় এটা।’ পুলিশ একে একে জেরা শুরু করে। আল আমিনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে গুলশানের একটি ঘটনা। বলে, ‘স্যার আমরা গুলশানে একটা কাম করতে গেছিলাম গাড়ি নিয়ে। রাতের বেলা একজনরে রাস্তায় আটকাইছি, কিন্তু পারাপারি করছিল। আমরা গুলি কইরা দিছি। শুনছি পরে লোকটা বিদেশি।’ এমন কথা শুনে গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসে। আবারও জানতে চান, ঠিক কোন জায়গায় ঘটনাটি। আল আমিন বলে, ১২০ নম্বর সড়কে। গোয়েন্দারা বুঝে নেয় কার কথা বলছে তারা। ব্যস্ত হয়ে পড়ে গোয়েন্দারা। পদস্থ কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয়। গোয়েন্দা দফতরে ছুটে আসে তারা। আবারও জেরা। রাতভর। নিশ্চিত হয় গোয়েন্দারা। সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর খুনি তাদের সামনে। শুধু তাই নয়, যে অস্ত্রটি দিয়ে খুন করা হয়, সেই অস্ত্রটিও উদ্ধার হয়েছে। খালাফের শরীর থেকে অপসারণ করা বুলেটের ব্যালাস্টিক রিপোর্টের সঙ্গেও উদ্ধার করা রিভলবারের রিপোর্ট মিলে গেছে। গোয়েন্দারা ভাবছে, এ যেন কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসল সাপ। গোয়েন্দারা খুশি। সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খুনের ঘটনা নিয়ে শুধু পুলিশ আর গোয়েন্দারাই নয়, সরকারও ছিল ভীষণ চাপে। ওই খুনের পর আতঙ্ক ছড়ায় বিদেশিদের মাঝে। সৌদি আরবে কর্মরত ২৭ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়ে। হত্যা রহস্য উদঘাটনের পর কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে। পুলিশ নিশ্চিত হয়, খালাফ হত্যার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না। নিছক ছিনতাইয়ের ঘটনা। ২০১২-এর ৫ মার্চ দিবাগত রাতে ছিনতাই করতে গিয়ে বাধা দেওয়ায় অস্ত্রধারীরা সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলীকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরদিন ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান এই কর্মকর্তা। ঘটনাটি ঘটেছিল গুলশানের কূটনৈতিক এলাকার ১২০ নম্বর সড়কের ১৯/বি নম্বর বাড়ির ঠিক সামনে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে পুলিশ হানা দেয় ভাসানটেক মানিকদি এলাকার রফিকের গ্যারেজে। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় হত্যাকান্ডে ব্যবহƒত গাড়ি। পুলিশি তদন্ত শেষে আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ঢাকার মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মাহমুদ আদনানের কাছে এ স্বীকারোক্তি প্রদান করে। খালাফ খুনের পর পুলিশ এর ক্লু বের করতে দিশাহারা হয়ে পড়ে। খালাফ আল আলী খুনের ঘটনায় তিন মাস পুরো অন্ধকারে থাকে পুলিশ। পুলিশের ধারণা ছিল ওটি পরিকল্পিত হত্যা। তাদের ধারণা ছিল, পরিকল্পিতভাবে কোনো চক্র খালাফকে গুলি করে পালিয়ে গেছে। এ ঘটনায় পেশাদার খুনিরা জড়িত থাকতে পারে। কেননা, একটি মাত্র গুলি তার বুকের বাম পাশে বিদ্ধ হয়। এতেই তার মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর ব্যাপক নিরাপত্তা বলয় এলাকা হিসেবে পরিচিত কূটনৈতিক জোন গুলশানে দূতাবাস কর্মকর্তা খুনের ঘটনায় সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এতে বিদেশি ছাড়াও বাংলাদেশি বাসিন্দারাও উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু ছিনতাইয়ের মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে স্পর্শকাতর খুনের ঘটনা।
বিচার : সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলী হত্যা মামলায় একজনের ফাঁসি ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আদালত। প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেয়। রায়ে আসামি সাইফুল ইসলাম মামুনের মৃত্যুদন্ড এবং আল আমিন, আকবর আলী লালু ও রফিকুল ইসলাম খোকনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রাখা হয়।
খালাফকে হত্যার অভিযোগে ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর আসামি সাইফুল ইসলাম মামুন, আল আমিন, রফিকুল ইসলাম খোকন, আকবর আলী লালু ও সেলিম চৌধুরী ওরফে সেলিম আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিচার শেষে পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ৪। এরপর মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর রায় দেয় হাই কোর্ট। হাই কোর্ট সাইফুল ইসলাম মামুনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে আল আমিন, রফিকুল ইসলাম খোকন ও আকবর আলী লালুর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। পলাতক আসামি সেলিম চৌধুরীকে খালাস দেয়। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি সাইফুল ইসলাম মামুনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ রাত ১০টা ১ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে এ রায় কার্যকর করা হয়। ২০১২ সালের ৫ মার্চ মধ্যরাতে গুলশানের কূটনৈতিক এলাকার ১২০ নম্বর রোডের ১৯/বি নম্বর বাসার কাছে গুলিবিদ্ধ হন খালাফ। পরদিন ভোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।