সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামের সেই রাত। বাতাসে উন্মাদনা, সিঁড়িতে উৎকণ্ঠা। অতীতের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বিজয়ের প্রতিধ্বনি যেন মিলেমিশে একাকার। ঘড়ির কাঁটায় তখন ম্যাচের শেষ মুহূর্ত। শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা ভেঙে গর্জে ওঠেন দর্শকেরা – ‘গোল!’ এক ঝলকে লক্ষাধিক হৃদয়ে জ্বলে ওঠে একই অনুভূতি। এটি শুধু একটি গোল নয়; এটি শতাব্দীর প্রতিশ্রুতি, এক অদম্য সত্তার প্রকাশ, একটি প্রতিষ্ঠানের হৃদয়স্পন্দন। রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব – শুধু একটি দল নয়, এক জীবন্ত কিংবদন্তি। এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি ট্রফি, প্রতিটি জয়লব্ধ মুহূর্ত একত্রে বুনে দিয়েছে ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-র এক মহাকাব্য। যার পাতা উল্টালেই মেলে সাহস, দক্ষতা, নাটকীয়তা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার এক অবিশ্বাস্য গল্প। এই গল্পের শুরু হয়েছিল একদল স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে, যারা কল্পনাও করেনি তাদের হাতেই রচিত হবে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে মহিমান্বিত অধ্যায়গুলোর একটি – এক ইতিহাস যা কখনো ম্লান হয় না, শুধু নতুন করে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়।
রিয়াল মাদ্রিদ: ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাসের সূচনা ও প্রতিষ্ঠার গল্প (1902-1950)
মাদ্রিদের শহরতলির এক ছোট্ট দোকান ‘আল ক্যাপিচো’। সেখানে জড়ো হতেন ফুটবলপ্রেমী একদল তরুণ। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন জুলিয়ান পালাসিওস। স্প্যানিশ রাজধানীতে তখন ফুটবলের জোয়ার। কিন্তু ইংরেজ কর্মকর্তা ও অভিবাসীদের আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। পালাসিওস ও তার সঙ্গীরা ভাবলেন, কেন স্থানীয় স্প্যানিশরাই মাদ্রিদের প্রতিনিধিত্ব করবে না? এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ১৯০২ সালের ৬ই মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হল ‘মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব‘। ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস রচনার প্রথম অক্ষর লেখা হলো এই দিনেই। প্রথম প্রেসিডেন্ট হন পালাসিওস নিজেই। সাদা শার্ট ও নেভি ব্লু শর্টস ছিল তাদের প্রথম পোশাক – আজকের কিংবদন্তি সাদা জার্সির পূর্বসূরি।
প্রাথমিক বছরগুলো ছিল সংগ্রামের। রিয়াল মাদ্রিদের এই চিরসবুজ ইতিহাস কিন্তু সহজ পথে আসেনি। ট্রফির দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বেশ কিছু বছর। প্রথম বড় সাফল্য আসে ১৯০৫ সালে, যখন তারা কোপা দেল রে (তখন কোপা দেল রেয়ে) জয় করে। স্প্যানিশ ফুটবলের প্রারম্ভিক যুগে এই ট্রফি ছিল সর্বোচ্চ সম্মানের। এই জয় দলটির ভিত্তিকে মজবুত করে এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার স্থান সুদৃঢ় করে। ১৯২০ সালে ক্লাবের নামের আগে যুক্ত হয় ‘রিয়াল’ (রয়্যাল) উপাধি, সম্মানসূচক এই উপাধি দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজা আলফনসো ত্রয়োদশ, ক্লাবের প্রতি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার নিদর্শন হিসেবে। এটি শুধু নাম পরিবর্তন নয়, সমগ্র স্পেনে ক্লাবটির মর্যাদা ও স্বীকৃতিকে চিরস্থায়ী করে দেয়।
- সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে: স্থপতি যিনি ইতিহাস গড়লেন: ১৯৪৩ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে। এই নামটি রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস-এর সমার্থক। তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট ছিলেন না, ছিলেন একজন দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা। তার হাত ধরেই রিয়াল মাদ্রিদ স্থানীয় সাফল্য ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পা রাখে। তার সবচেয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল:
- ইউরোপিয়ান কাপের ধারণা: বার্নাব্যুই ছিলেন ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান ইউএফএ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রাণপুরুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন ইউরোপের সেরা দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত। তারই অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও দূরদর্শিতার ফল ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর।
- নিউ চামার্টিন স্টেডিয়াম: পুরনো স্টেডিয়ামের জায়গায় তিনি গড়ে তোলেন বর্তমানের কিংবদন্তি সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়াম (১৯৪৭), যা পরবর্তীতে তার নামেই নামকরণ করা হয়। এটি শুধু একটি মাঠ নয়, ফুটবল বিশ্বের একটি পবিত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।
- লস ব্লাঙ্কোসের সাংস্কৃতিক বিপ্লব: বার্নাব্যু বিশ্বাস করতেন আক্রমণাত্মক, দর্শনীয় ফুটবল খেলাই রিয়াল মাদ্রিদের পরিচয় হওয়া উচিত। তিনি এমন খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়ে তোলেন দল, যারা এই দর্শন মাঠে প্রতিফলিত করবে। তার আমলেই শুরু হয় ‘লস ব্লাঙ্কোস’ (শ্বেতশুভ্ররা) নামে পরিচিতি।
বার্নাব্যুর নেতৃত্বে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে রিয়াল মাদ্রিদ ইউরোপিয়ান কাপে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে। আলফ্রেদো ডি স্টেফানো, ফেরেন্ক পুস্কাস, ফ্রান্সিস্কো হেন্তো, রেমন্ড কোপার মতো কিংবদন্তিদের নিয়ে গড়া দলটি ফুটবলকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাদের খেলার সৌন্দর্য, গোলের বিস্ফোরণ দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। এই যুগ রিয়াল মাদ্রিদের ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এ এক স্বর্ণযুগের সূচনা করে, যার আলো আজও উজ্জ্বল।
ইউরোপের সিংহাসনে আরোহণ: গ্যালাক্টিকোস যুগ এবং অমর সাফল্য (1950s-2000s)
রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস-এর সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়গুলোর একটি লেখা হয় ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর দশক জুড়ে। এটি ছিল ইউরোপিয়ান কাপের শুরুর যুগ, এবং রিয়াল মাদ্রিদই ছিল এর অপরাজেয় সম্রাট। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতার প্রথম পাঁচটি সংস্করণই জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ! এটি একটি অবিশ্বাস্য রেকর্ড, যা সম্ভবত কখনই ভাঙা হবে না। এই সাফল্যের কেন্দ্রে ছিলেন দুজন কিংবদন্তি: আলফ্রেদো ডি স্টেফানো এবং ফেরেন্ক পুস্কাস।
ডি স্টেফানো ছিলেন দলের মস্তিষ্ক ও প্রাণ। তার অপরিসীম কর্মক্ষমতা, গোল করার ক্ষমতা এবং মাঠের সর্বত্র উপস্থিতি তাকে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন সেই ইঞ্জিন যার উপর চলত পুরো দল। পুস্কাস, ‘দ্য গ্যালোপিং মেজর’, ছিলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলস্কোরার। তার বাম পায়ের জাদু, অসাধারণ ফিনিশিং ক্ষমতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করার নেশা তাকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে। ১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে এই জুটি তাদের মহিমার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায়। হ্যাম্পডেন পার্কে আইন্ট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টকে ৭-৩ গোলে উড়িয়ে দেয় রিয়াল। পুস্কাস করেন পোকার হ্যাট্রিক, ডি স্টেফানো করেন হ্যাট্রিক! এই ম্যাচটি ইউরোপিয়ান কাপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ফাইনাল হিসেবে স্বীকৃত। এই যুগের অন্যান্য নক্ষত্র ছিলেন ফ্রান্সিস্কো ‘পাকো’ হেন্তো (ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ট্রফিজয়ী খেলোয়াড়), রেমন্ড কোপা, হোসে মারিয়া জারা এবং হেক্টর রিয়াল। তারা শুধু ট্রফি জিতেনি, খেলতেন এক জাদুকরী ফুটবল, যা ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-কে সমৃদ্ধ করেছিল শিল্পের মর্যাদায়।
সত্তর ও আশির দশকেও রিয়াল মাদ্রিদ সাফল্যের ধারা বজায় রাখে, যদিও ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা বিরতি পড়ে। তারা লা লিগা এবং কোপা দেল রেতে আধিপত্য ধরে রাখে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নক্ষত্রদের মধ্যে ছিলেন প্রাণোদিত রাইট-ব্যাক চেন্দো, শক্তিশালী স্ট্রাইকার সান্তিয়ানা, ক্যারিশম্যাটিক ডিফেন্ডার হোসে আন্তোনিও কামাচো এবং জার্মান গোলরক্ষক বের্ন্ড শুস্টার। ১৯৮৫ সালে তারা আবার ইউরোপিয়ান শিরোপার স্বাদ পায়, ইউইএফএ কাপ (বর্তমান ইউরোপা লিগ) জিতে।
গ্যালাক্টিকোস: তারকাপুঞ্জের নয়া যুগ এবং লা ডেসিমার অপেক্ষা
নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ এবং নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের চিরসবুজ ইতিহাস-এ যোগ করে এক নাটকীয় ও বিতর্কিত অধ্যায় – ‘গ্যালাক্টিকোস’ যুগ। প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্টিনো পেরেজের ‘জিদান ও পাভোন’ নীতি (বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় এবং সেরা তরুণ প্রতিভাদের একত্রিত করা) বাস্তবায়িত হয় ফিগো, জিনেদিন জিদান, রোনালদো (ব্রাজিলিয়ান), ডেভিড বেকহ্যাম এবং মাইকেল ওয়েনের মতো সুপারস্টারদের স্বাক্ষরে। এই দলটি ছিল বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বাণিজ্যিকভাবে সফল এবং আলোচিত দল। ২০০২ সালে গ্লাসগোর হ্যাম্পডেন পার্কে (যেখানে ১৯৬০ সালে ঐতিহাসিক ৭-৩ জয়) বেয়ার লেভারকুজেনকে হারিয়ে তারা জিতে নেয় তাদের নবম ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। জিদানের সেই অলৌকিক বাম ভলি গোলটি শুধু একটি গোল নয়, এটি ফুটবল ইতিহাসের একটি শিল্পকর্ম, ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর অন্যতম অমর মুহূর্ত।
তবে, গ্যালাক্টিকোস যুগ শুধু জাদুই নয়, বিতর্কও নিয়ে আসে। দলে ভারসাম্যের অভাব, অতিরিক্ত তারকা নির্ভরতা এবং প্রতিরক্ষার দুর্বলতা প্রায়শই প্রকাশ পেত। ফলশ্রুতিতে, ট্রফি সংগ্রহের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি সবসময়। বিশেষ করে, ইউরোপের সর্বোচ্চ শিরোপা – লা ডেসিমা (দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়) এক অবাস্তব স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। ২০০২-এর পর দীর্ঘ বারো বছর ধরে রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালও পার হতে পারেনি, যা তাদের জন্য এক যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার সময় ছিল।
নতুন শতাব্দীতে পুনর্জন্ম: লা ডেসিমা, ট্রেবল এবং অব্যাহত আধিপত্য (2010s-বর্তমান)
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ২০১৪ সালে। কার্লো আনচেলত্তির কোচিংয়ে এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, গ্যারেথ বেল, লুকা মড্রিচ, সার্হিও রামোস, টনি ক্রুসের মতো তারকাদের নেতৃত্বে রিয়াল মাদ্রিদ আবারও ইউরোপের শীর্ষে আরোহণ করে। লিসবনের এস্তাদিও দা লুজে স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদের বিরুদ্ধে এক নাটকীয় ফাইনালে সার্হিও রামোসের অতিরিক্ত সময়ের মরিয়া হেডারে গোল (৯৩’ মিনিটে!) এবং গ্যারেথ বেল, মার্সেলো ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর গোলে ৪-১ গোলে জয়ী হয় রিয়াল। এটি ছিল তাদের দশম ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা – লা ডেসিমা অর্জিত! এই জয় শুধু একটি ট্রফি নয়, এটি ছিল দীর্ঘ বছরের তৃষ্ণা মেটানো, ঐতিহাসিক মর্যাদা ফিরে পাওয়া এবং ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর সবচেয়ে সন্তোষজনক অধ্যায়গুলোর একটির সমাপ্তি। মাদ্রিদ শহর রাতারাতি সাদায় সেজে ওঠে, উদযাপনে মাতোয়ারা হয় লক্ষ লক্ষ সমর্থক।
এই জয় ছিল এক নতুন রাজবংশের সূচনা মাত্র। জিনেদিন জিদানের নেতৃত্বে (প্রথমে সহকারী, পরে প্রধান কোচ) রিয়াল মাদ্রিদ ইউরোপিয়ান ফুটবলে এক অভূতপূর্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে নেয় – একটি অকল্পনীয় কীর্তি যা আধুনিক যুগে পুনরাবৃত্তি হওয়া অসম্ভব বলে ধরা হয়। এই ‘থ্রিপিট’ (টানা তিন শিরোপা) অর্জন ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-কে এক নতুন মহাকাশে নিয়ে যায়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এই যুগের অবিসংবাদিত নায়ক, ক্লাবের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং অগণিত রেকর্ডের অধিকারী। কিন্তু তার পাশাপাশি লুকা মড্রিচের মধ্যমাঠের জাদু, সার্হিও রামোসের নেতৃত্ব ও লড়াকু মনোভাব, মার্সেলো-কারভাজালের প্রাণবন্ত উইং-ব্যাক প্লে, টনি ক্রুস-ক্যাসেমিরোর মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণ এবং গ্যারেথ বেল-ইস্কোর মতো খেলোয়াড়দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান এই সাফল্যের ভিত্তি রচনা করে। ২০২২ সালে কার্লো আনচেলত্তি ফিরে আসেন এবং আরেকটি ঐতিহাসিক কীর্তি গড়েন। রিয়াল মাদ্রিদ লিভারপুলকে হারিয়ে জিতে নেয় তাদের চতুর্দশ ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, তাদের ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতায় আধিপত্যকে আরও সুদৃঢ় করে। এই যাত্রাপথে বার্সেলোনার বিরুদ্ধে এল ক্লাসিকো জয়ের মতো অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত যুক্ত হয়েছে ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর পাতায়।
বার্নাব্যুর রূপান্তর ও ভবিষ্যতের দিগন্ত
রিয়াল মাদ্রিদ শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামের ব্যাপক আধুনিকায়ন ও পুনর্নির্মাণ চলছে, যা একে ২১শ শতাব্দীর সবচেয়ে আধুনিক ও সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন স্টেডিয়ামে পরিণত করবে। এটি শুধু ম্যাচ আয়োজনের জায়গা নয়, একটি বিনোদন কমপ্লেক্স হিসেবে কাজ করবে, ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-কে ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়ার একটি সেতু। একই সাথে, ক্লাব তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘ক্যান্টেরা’ (যুব একাডেমি) থেকে প্রতিভা উৎপাদনের উপর জোর দিচ্ছে। ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রড্রিগো, এডুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, ফেদে ভালভার্দে, আরডা গুলার, জুড বেলিংহামের মতো তরুণ তারকারা ইতিমধ্যেই প্রথম দলে জায়গা করে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছে। জুড বেলিংহামের আগমন এবং তাত্ক্ষণিক প্রভাব রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস-এ নতুন এক উত্তেজনাপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসের মর্মবাণী: শুধু জয় নয়, এক অমর প্রেরণা
রিয়াল মাদ্রিদের গল্প শুধু গোল, ট্রফি কিংবা তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে নয়। এটি একটি ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস যা শেখায় কীভাবে অদম্য মনোবল, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং শীর্ষে থাকার অঙ্গীকার একটি প্রতিষ্ঠানকে সময়ের সীমানা পেরিয়ে অমর করে তোলে। এটি সাহসের গল্প – হ্যাম্পডেন পার্কে ৭ গোল করার সাহস, লিসবনে ৯৩তম মিনিটে সমতা ফেরানোর সাহস, কিংবা টানা তিন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস। এটি অধ্যবসায়ের গল্প – ডি স্টেফানোর ক্লান্তিহীন দৌড়, বার্নাব্যুর স্বপ্ন দেখার অদম্য ইচ্ছা, কিংবা লা ডেসিমার জন্য ১২ বছরের ধৈর্যের পরীক্ষা। এটি ঐতিহ্য রক্ষার গল্প – সেই সাদা জার্সির মর্যাদা, বার্নাব্যুর মাঠের সম্মান এবং যে কোনও পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দেওয়ার সংস্কৃতি। প্রতিটি ‘হালা মাদ্রিদ!’ ধ্বনি শুধু সমর্থন নয়, সেই চিরন্তন ইতিহাসের প্রতি এক প্রণতি। রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস তাই শুধু ফুটবল ক্লাবের অতীত নয়; এটি বর্তমানের প্রেরণা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি উজ্জ্বল মশাল। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের মহত্ত্ব কখনো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, বরং প্রতিটি সংগ্রাম, প্রতিটি বিজয় তাকে করে তোলে আরও দীপ্তিমান, আরও চিরসবুজ। এই ইতিহাসের পাতায় আপনার নামও লেখা থাকতে পারে – শুধু অনুসরণ করুন তাদের যাত্রা, অনুপ্রাণিত হোন তাদের অমর গল্পে, এবং সাক্ষী থাকুন কিভাবে ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস প্রতিদিন নতুন করে রচিত হচ্ছে। রিয়াল মাদ্রিদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলগুলোতে যুক্ত থাকুন, এই চলমান কিংবদন্তির প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাক্ষী হোন!
জেনে রাখুন-
১। রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কে?
রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস রচনায় অসংখ্য ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে। তবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইউরোপিয়ান কাপ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন, কিংবদন্তি সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন এবং ১৯৫০-৬০ দশকের স্বর্ণযুগের দল গড়ে তোলেন। তার দূরদর্শিতা ও নেতৃত্ব ক্লাবের ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর ভিত্তি স্থাপন করে।
২। রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসে ‘লা ডেসিমা’ বলতে কী বোঝায় এবং এটি কেন এত তাৎপর্যপূর্ণ?
‘লা ডেসিমা’ বলতে রিয়াল মাদ্রিদের দশম ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা (২০১৪ সালে জয়) কে বোঝায়। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ১৯৬৬ সালে নবম শিরোপা জয়ের পর দীর্ঘ ৩২ বছর (২০০২ সালে অষ্টম জয়ের পর ১২ বছর) তারা এই শিরোপা জয় করতে পারেনি। ‘দশমটি’ পাওয়া ছিল সমর্থক ও ক্লাবের জন্য এক আবেগঘন, ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত লক্ষ্য অর্জন, যা তাদের ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এ নতুন গৌরব যোগ করে।
৩। ‘গ্যালাক্টিকোস’ যুগ কী এবং এটি রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসে কী প্রভাব ফেলেছিল?
‘গ্যালাক্টিকোস’ যুগ (প্রধানত ২০০০-২০০৬) ছিল রিয়াল মাদ্রিদের এমন এক নীতি যেখানে প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্টিনো পেরেজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা খেলোয়াড়দের (লুইস ফিগো, জিনেদিন জিদান, রোনালদো, ডেভিড বেকহ্যাম ইত্যাদি) দলে ভেড়ানোর উপর জোর দেন। এটি ক্লাবকে বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্য ও বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা এনে দেয় এবং ২০০২ সালে অষ্টম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে ভূমিকা রাখে (জিদানের বিখ্যাত গোল)। তবে, দলে ভারসাম্যের অভাবের কারণে ধারাবাহিক সাফল্য আসেনি এবং এটি বিতর্কও সৃষ্টি করে। তবুও, এটি ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর এক নাটকীয় ও আলোচিত অধ্যায়।
৪। রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি বলে বিবেচিত হয়?
রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস-এ অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত রয়েছে। তবে ১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে আইন্ট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টকে ৭-৩ গোলে উড়িয়ে দেওয়া (ডি স্টেফানো ও পুস্কাসের হ্যাট্রিক) এবং ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিরুদ্ধে ৯৩তম মিনিটে সার্হিও রামোসের সমতাসূচক হেডার গোলকে প্রায়শই শীর্ষস্থানে রাখা হয়। প্রথমটি ফুটবল শিল্পের এক অনবদ্য প্রদর্শনী, দ্বিতীয়টি ছিল প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি ফাইনালকে জয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার নাটকীয় মোড়।
৫। বর্তমান দলে রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন কোন খেলোয়াড়রা?
বর্তমান দলে ভিনিসিয়াস জুনিয়র (ঝড়ো গতি ও গোল), জুড বেলিংহাম (তরুণ নেতা, গোল ও সহায়তা), ফেদে ভালভার্দে (অক্লান্ত শক্তি), এডুয়ার্দো কামাভিঙ্গা (মধ্যমাঠের প্রভাব), রড্রিগো (গুরুত্বপূর্ণ গোল), এবং অরেলিয়েন চৌমেনি/এরলিং হালান্ডের সাথে লড়াই করা অ্যান্টোনিও রুডিগারের মতো খেলোয়াড়রা ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর উত্তরাধিকার বহন করছেন। অভিজ্ঞ টনি ক্রুস, লুকা মড্রিচ এবং নাচো ফার্নান্দেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
৬। রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসে ‘ক্যান্টেরা’ (যুব একাডেমি) এর ভূমিকা কী?
রিয়াল মাদ্রিদের ‘ক্যান্টেরা’ (যুব একাডেমি) চিরসবুজ ইতিহাস-এর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি স্থানীয় প্রতিভা চিহ্নিত করে, প্রশিক্ষণ দেয় এবং মূল দলে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ দেয়। রাউল গঞ্জালেজ, ইকার কাসিয়াস, গুটি, ড্যানি কারভাজাল, ফেদে ভালভার্দে এবং অসংখ্য তারকা ক্যান্টেরা থেকে উঠে এসেছেন। এটি ক্লাবের দর্শন, খেলার স্টাইল এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখতে সহায়তা করে, ভবিষ্যতের জন্য প্রতিভার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে, সেই ঐতিহ্যকে চিরসবুজ রাখে।
৭। এল ক্লাসিকো (বার্সেলোনার বিরুদ্ধে ম্যাচ) রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাসে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এল ক্লাসিকো বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি। রিয়াল মাদ্রিদের চিরসবুজ ইতিহাস-এ এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ম্যাচগুলো প্রায়শই লিগ কিংবা কাপের শিরোপা নির্ধারণ করে থাকে। ডি স্টেফানো, পুস্কাস থেকে শুরু করে রোনালদো, রামোস, বেনজেমা এবং বর্তমান তারকাদের জয়-পরাজয় ফুটবল ক্লাবের চিরসবুজ ইতিহাস-এর পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা রয়েছে। প্রতিটি ক্লাসিকো জয় সমর্থকদের জন্য অপরিসীম গর্বের বিষয় এবং ক্লাবের আধিপত্যের প্রতীক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।