সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামের সেই রাত…
১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল। জার্মানির আইন্ট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের বিরুদ্ধে ৭-৩ গোলে জয়ের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ডি স্টেফানোর হ্যাটট্রিক, ফেরেঙ্ক পুশকাসের চার গোল – মাঠ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সাদা জার্সিধারী এক দল। এই গল্প শুধু ট্রফির নয়, বিশ্ব ফুটবলে অমরত্বের দাবিদার এক প্রতিষ্ঠানের গৌরবগাথা। রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস মানেই ফুটবলের মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি অধ্যায় রচিত হয়েছে স্বপ্ন, সংগ্রাম আর অসম্ভবকে জয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯০২ সালে মাদ্রিদের এক ছোট্ট ক্লাব হিসেবে যাত্রা শুরু করা এই সংগঠন আজ বিশ্ব ফুটবলের মকুটহীন সম্রাট। লা ফাব্রিকা থেকে উত্পাদিত তারকাদের মিশেলে, ইউরোপের সিংহাসনে ১৪ বার আরোহণের রেকর্ড, আর ক্রমাগত নিজেকে পুনর্বিন্যাস করার ক্ষমতা – এই সব মিলিয়েই রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস মানব সভ্যতার অন্যতম বিস্ময়।
রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস: এক মহাকাব্যিক সূচনা (১৯০২-১৯৪৩)
“মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব“ নামে ১৯০২ সালের ৬ মার্চ জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠান। হুলিও পালাসিওস, কার্লোস প্যাড্রোসের মতো উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন মাদ্রিদে একটি শক্তিশালী ফুটবল দল গড়ে তুলতে। ১৯২০ সালে রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসো কর্তৃক “রিয়েল” (রাজকীয়) উপাধি প্রাপ্তিই ক্লাবের ভবিষ্যৎ গৌরবের ইঙ্গিত দেয়।
প্রাথমিক সাফল্যের ভিত্তি:
- প্রথম ট্রফি: ১৯০৫ সালে কোপা দেল রে (তৎকালীন কোপা দেল রেই) জয়। এটি ছিল স্প্যানিশ ফুটবলে তাদের প্রথম বড় অর্জন।
- লা লিগা প্রতিষ্ঠাতা: ১৯২৯ সালে স্পেনের প্রথম প্রফেশনাল লীগ লা লিগার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে রিয়েল মাদ্রিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সান্তিয়াগো বার্নাব্যু: কারিগর এক বিপ্লবের: ১৯৪৩ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন বার্নাব্যু। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে ক্লাবের ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি হয়। তার হাত ধরেই শুরু হয় “লা ফাব্রিকা” – বিশ্ববিখ্যাত যুব একাডেমি, যা পরবর্তীতে রাউল, ক্যাসিয়াস, কারভাহালের মতো তারকাদের জন্ম দেবে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ইউরোপ জয়ের, যার বাস্তবায়ন ঘটে তার মৃত্যুর পরও।
ইউরোপে আধিপত্যের স্বর্ণযুগ: পাঁচটি টানা ইউরোপিয়ান কাপ (১৯৫৫-১৯৬০)
এক অকল্পনীয় রেকর্ডের জন্ম: আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুশকাস, ফ্রান্সিসকো হেন্টোর মতো কিংবদন্তিদের নিয়ে গড়া দল ইউরোপকে মাতিয়ে দেয়। রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে ঝলমলে অধ্যায় এটি।
- প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী (১৯৫৬): ফ্রান্সের রেইমসকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে মাদ্রিদ। ডি স্টেফানোর নেতৃত্বে শুরু হয় জয়যাত্রা।
- টানা পাঁচ শিরোপা: ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ – এই পাঁচ বছর ইউরোপিয়ান কাপ শুধু মাদ্রিদের দখলেই ছিল। বিশেষ করে ১৯৬০ সালের ফাইনালে আইন্ট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টকে ৭-৩ গোলে উড়িয়ে দেওয়া ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাইনাল হিসেবে স্বীকৃত।
- ডি স্টেফানো ও পুশকাস: অমর জুটি: আর্জেন্টিনার ডি স্টেফানো এবং হাঙ্গেরির পুশকাসের জুটি ছিল ধ্বংসাত্মক। তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং গোল ক্ষমতা বিপক্ষ দলকে মাঝেমধ্যেই অসহায় করে তুলত। ডি স্টেফানোকে ক্লাবের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন বিবেচনা করা হয়।
“সেই সময়ে রিয়েল মাদ্রিদ শুধু একটি ক্লাব ছিল না; এটি ছিল ফুটবলের এক দর্শন, এক পরাক্রমের প্রতীক।” – ফুটবল ইতিহাসবিদ, সান্তিয়াগো সেগুরা (সূত্র: Universidad Complutense de Madrid-এর আর্কাইভ)
উত্থান-পতন ও নতুন করে জেগে ওঠা (১৯৭০-১৯৯০)
পাঁচটি ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের পর ক্লাবটি কিছুটা ঘুমন্ত অবস্থায় পড়ে। যদিও ঘরোয়া লীগে সাফল্য ধরে রাখে:
- লা লিগা আধিপত্য: এই সময়কালে মাদ্রিদ লা লিগা জয় করে ১০ বার (১৯৭২, ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯)।
- উয়েফা কাপ জয়: ইউরোপিয়ান কাপের সাফল্য না এলেও ১৯৮৫ এবং ১৯৮৬ সালে টানা দুইবার উয়েফা কাপ (বর্তমান ইউরোপা লীগ) জয় করে।
- কুইন্টা দেল বুইত্রে: ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে এমিলিও বুত্রাগুয়েনো, ম্যানুয়েল সানচিস, মিচেল, মিগেল পার্দেজা এবং রাফায়েল মার্টিন ভাজকুয়েজ – এই পাঁচ স্প্যানিশ তারকাকে নিয়ে গড়া “কুইন্টা দেল বুইত্রে” দলটি স্প্যানিশ ফুটবলে স্টাইল এবং সাফল্য নিয়ে আসে। তারা পাঁচটি টানা লিগ শিরোপা জিতে (১৯৮৬-১৯৯০) রেকর্ড গড়ে।
গ্যালাক্টিকোস যুগ ও ইউরোপে পুনরুত্থান (২০০০-২০১০)
ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের প্রথম সভাপতিত্বকাল (২০০০-২০০৬) রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মোড় নিয়ে আসে।
- গ্যালাক্টিকোস নীতি: বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাদের (প্রায়ই ব্যালন ডি’অর বিজয়ী) দলে ভিড়ানোর কৌশল। ফিগো (২০০০), জিনেদিন জিদান (২০০১), রোনাল্ডো (২০০২), ডেভিড বেকহ্যাম (২০০৩) এবং মাইকেল ওয়েন (২০০৪) – এই তারকারা একত্রে খেলেন, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে।
- ইউরোপিয়ান গৌরবের প্রত্যাবর্তন: যদিও ঘরোয়া লিগে বার্সেলোনার কাছে পিছিয়ে পড়ে, ইউরোপে সাফল্য আসে। ২০০২ সালে গ্লাসগো হ্যাম্পডেন পার্কে বায়ার লেভারকুজেনকে হারিয়ে নবম ইউরোপিয়ান কাপ জয় করে মাদ্রিদ। জিদানের সেই অলৌকিক ভলি গোলটি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে চিহ্নিত।
- লিগ শিরোপা: ২০০১, ২০০৩, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে লা লিগা জয় করে গ্যালাক্টিকোসরা।
গ্যালাক্টিকোস যুগের ট্রান্সফার ও প্রভাব:
খেলোয়াড়ের নাম (পজিশন) | ট্রান্সফার বছর | পূর্ব ক্লাব | প্রভাব/উল্লেখযোগ্য অর্জন |
---|---|---|---|
লুইস ফিগো (উইঙ্গার) | ২০০০ | বার্সেলোনা | সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে আসা; ব্যাপক বিতর্ক |
জিনেদিন জিদান (মিডফিল্ডার) | ২০০১ | জুভেন্টাস | ২০০২ ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালের জয়ী গোল; ব্যালন ডি’অর |
রোনাল্ডো (স্ট্রাইকার) | ২০০২ | ইন্টার মিলান | ঘরোয়া লিগে অসাধারণ গোলদক্ষতা প্রদর্শন |
ডেভিড বেকহ্যাম (মিডফিল্ডার) | ২০০৩ | ম্যান ইউনাইটেড | বিপণন ও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি |
মাইকেল ওয়েন (স্ট্রাইকার) | ২০০৪ | লিভারপুল | সাব-স্টিটিউট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ গোল |
লা দেসিমা থেকে চতুর্দশ শিরোপা: ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডো যুগ ও তার পর (২০১০-বর্তমান)
এই যুগে রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাসে যোগ হয় ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একাধিক শিরোপা, বিশেষ করে “লা দেসিমা” (দশম) এবং তার পরবর্তী সাফল্য।
- ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডো: গোল মেশিন: ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে আসা রোনাল্ডো ক্লাবকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি হয়ে ওঠেন ক্লাবের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৪৫০টি গোল) এবং এক যুগের প্রতীক।
- লা দেসিমার স্বাদ (২০১৪): ১২ বছরের অপেক্ষার পর ২০১৪ সালে আতলেতিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে (৪-১) দশম ইউরোপিয়ান কাপ জয় করে মাদ্রিদ। গ্যারেথ বেলের অতিরিক্ত সময়ের গোলটি চিরস্মরণীয়।
- টানা তিন শিরোপা (২০১৬, ২০১৭, ২০১৮): জিনেদিন জিদানের কোচিংয়ে রিয়েল মাদ্রিদ ইউরোপিয়ান ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টানা তিনটি শিরোপা জয় করে (২০১৬-২০১৮)। এই দলে ছিলেন রোনাল্ডো, বেল, কারিম বেনজেমা, লুকা মডরিচ, টনি ক্রুস, সার্জিও রামোসের মতো তারকা।
- চতুর্দশ শিরোপা (২০২২): কার্লো আনচেলত্তির দ্বিতীয় মেয়াদে কোচ হিসেবে ফিরে এসেই ২০২২ সালে লিভারপুলকে হারিয়ে (১-০) রেকর্ড ১৪তম ইউরোপিয়ান শিরোপা জয় করে মাদ্রিদ। ভিনিসিয়াস জুনিয়রের গোলটি সিদ্ধান্তমূলক হয়।
- নতুন প্রজন্মের উত্থান: রোনাল্ডো, রামোস, মার্সেলোর মতো তারকাদের প্রস্থানের পরও ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রড্রিগো, জুড বেলিংহাম, এডুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, ফেদে ভালভার্দের মতো তরুণ প্রতিভারা দলের হাল ধরেছে। ২০২৪ সালে আবারও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে উঠে (বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে) তারা প্রমাণ করেছে যে রিয়েল মাদ্রিদের সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকবে।
রিয়েল মাদ্রিদের ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের কালপঞ্জি (২০২৪ পর্যন্ত):
বছর | ফাইনালের প্রতিপক্ষ | ফলাফল | উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত | মাঠ |
---|---|---|---|---|
১৯৫৬ | স্টেড রেইমস (ফ্রান্স) | ৪-৩ | প্রথম শিরোপা | পার্ক দেস প্রিন্সেস, প্যারিস |
۱۹۵۷ | ফিওরেন্টিনা (ইতালি) | ২-০ | ডি স্টেফানোর নেতৃত্ব | সান্তিয়াগো বার্নাব্যু, মাদ্রিদ |
۱۹৫৮ | এসি মিলান (ইতালি) | ৩-২ (অ.সা.) | হেন্টোর জয়ী গোল | হেইজেল স্টেডিয়াম, ব্রাসেল্স |
۱۹۵۹ | স্টেড রেইমস (ফ্রান্স) | ২-০ | টানা চতুর্থ শিরোপা | নেকারস্টাডিয়ন, স্টুটগার্ট |
۱۹۶۰ | আইন্ট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট (জার্মানি) | ৭-৩ | ডি স্টেফানোর হ্যাটট্রিক, পুশকাসের ৪ গোল | হ্যাম্পডেন পার্ক, গ্লাসগো |
۱۹৬৬ | পার্তিজান বেলগ্রেড (যুগোস্লাভিয়া) | ২-১ | আমানসিওর জয়ী গোল | হেইজেল স্টেডিয়াম, ব্রাসেল্স |
۱۹৯৮ | জুভেন্টাস (ইতালি) | ১-০ | প্রেড্রাগ মিয়াতোভিচের গোল | আমস্টারডাম এরিনা, আমস্টারডাম |
۲۰۰۰ | ভ্যালেন্সিয়া (স্পেন) | ৩-০ | ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস, স্টিভ ম্যাকম্যানাম্যান, রাউলের গোল | স্তাদ দ্য ফ্রান্স, প্যারিস |
۲۰۰۲ | বায়ার লেভারকুজেন (জার্মানি) | ২-১ | জিনেদিন জিদানের অবিস্মরণীয় ভলি গোল | হ্যাম্পডেন পার্ক, গ্লাসগো |
۲۰۱৪ | আতলেতিকো মাদ্রিদ (স্পেন) | ৪-১ (অ.সা.) | সার্জিও রামোসের ৯৩তম মিনিটের গোল, গ্যারেথ বেলের অতিরিক্ত সময়ের গোল | এস্তাদিও দা লুজ, লিসবন |
۲۰۱৬ | আতলেতিকো মাদ্রিদ (স্পেন) | ১-১ (৫-৩ পে.) | পেনাল্টিতে জয়, রোনাল্ডো চূড়ান্ত পেনাল্টি | সান সিরো, মিলান |
۲۰۱۷ | জুভেন্টাস (ইতালি) | ৪-১ | ক্যাসেমিরো, রোনাল্ডো (২), মার্কো অ্যাসেন্সিওর গোল | মিলিনিয়াম স্টেডিয়াম, কার্ডিফ |
۲۰۱۸ | লিভারপুল (ইংল্যান্ড) | ৩-১ | গ্যারেথ বেলের চক্করদার বাইসাইকেল কিক গোল, করিম বেনজেমার কৌশলগত গোল | ন্যাশনাল স্টেডিয়াম, কিয়েভ |
۲۰۲۲ | লিভারপুল (ইংল্যান্ড) | ১-০ | ভিনিসিয়াস জুনিয়রের গোল, থিবো কোর্তোয়ার অসাধারণ সেভ | স্তাদ দ্য ফ্রান্স, প্যারিস |
বার্সেলোনার সাথে অমর দ্বৈরথ: এল ক্লাসিকোর উত্তাপ
রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস কখনোই সম্পূর্ণ হবে না যদি না বলা হয় তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার সাথে লড়াইয়ের কথা। এই দ্বৈরথ শুধু ফুটবল মাঠের নয়, স্পেনের রাজনীতি, সংস্কৃতি আর পরিচয়েরও প্রতীক।
- রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন: ঐতিহাসিকভাবে রিয়েল মাদ্রিদকে দেখা হয় স্পেনের কেন্দ্রীয় শক্তি, রাজতন্ত্র এবং প্রথাগত স্পেনের প্রতিনিধি হিসেবে। অন্যদিকে বার্সেলোনা কাতালুনিয়ার স্বায়ত্তশাসন, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং প্রগতিশীলতার প্রতীক।
- মেসি বনাম রোনাল্ডো যুগ: ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ফুটবলের দুই মহানায়ক লিওনেল মেসি (বার্সা) এবং ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডো (রিয়েল) সরাসরি এই দ্বৈরথে লিপ্ত ছিলেন। তাদের ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অসাধারণ পারফরম্যান্স এল ক্লাসিকোকে বিশ্বের সবচেয়ে দেখার মতো খেলায় পরিণত করে।
- অবিস্মরণীয় ম্যাচগুলো: ১৯৪৩ সালের কোপা দেল জেনারালিসিমো সেমিফাইনালে মাদ্রিদের ১১-১ জয় (বিতর্কিত পরিস্থিতিতে), ২০০৫ সালের বার্নাব্যুতে বার্সার ৩-০ জয় (রোনালদিনহোর স্ট্যান্ডিং ওভেশন), ২০১৪ সালে বার্সার ৪-৩ জয় (মেসির হ্যাটট্রিক), ২০১৭ সালে মাদ্রিদের ৩-২ জয় (মেসির শেষ মুহূর্তের জয়ী গোল) – প্রতিটি ম্যাচ ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে।
“এল ক্লাসিকো স্রেফ একটা ফুটবল ম্যাচ নয়; এটা একটা আবেগ, একটা যুদ্ধ, একটা নাটক। সারা বিশ্ব থামে এই ৯০ মিনিটের জন্য।” – আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা (সূত্র: ফিফা.কম সাক্ষাৎকার)
সাফল্যের রহস্য: লা ফাব্রিকা, ব্যবস্থাপনা ও মনোবল
রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস কেন এতটা সমৃদ্ধ? এর পেছনে আছে কিছু মৌলিক নীতি ও কৌশল:
- লা ফাব্রিকা: ভবিষ্যতের কারখানা: বিশ্বের সেরা যুব একাডেমিগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাউল গনজালেজ, ইকার ক্যাসিয়াস, গুটি, আলভারো আরবেলোয়া, ড্যানি কারভাহাল, ফেদে ভালভার্দে, ভিনিসিয়াস টোবিয়াসের মতো অসংখ্য তারকা তৈরি করেছে। এটি ক্লাবকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং নিজস্ব প্রতিভা উত্পাদনে সাহায্য করে।
- দূরদর্শী সভাপতিত্ব: সান্তিয়াগো বার্নাব্যু (ইউরোপিয়ান কাপের স্বপ্ন), রামোন মেন্দোজা (১৯৮০-র দশকের সাফল্য), ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ (গ্যালাক্টিকোস, বার্নাব্যুর আধুনিকায়ন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সাফল্য) – প্রত্যেকেই ক্লাবকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন।
- চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অদম্য মনোভাব: বারবার দেখা গেছে, লিগে হয়তো ফর্ম ভালো নয়, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়েল মাদ্রিদ অন্য মাত্রার দল। ম্যাচ হারতে বসেও শেষ মুহূর্তে জয়ী হওয়া বা অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। ২০২২ সালের নকআউট পর্বে পিএসজি, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি – সবকটিকেই হারিয়ে ফাইনালে উঠে তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
- আর্থিক শক্তি ও ব্র্যান্ডিং: বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং সবচেয়ে মূল্যবান ফুটবল ক্লাব (Forbes-এর ২০২৪ র্যাঙ্কিং অনুযায়ী শীর্ষে)। এই আর্থিক শক্তি তাদের বিশ্বসেরা খেলোয়াড় এবং ম্যানেজারদের আকর্ষণে সহায়ক। বিপণন এবং বিশ্বব্যাপী ভক্তকূল তৈরিতে তারা অত্যন্ত সফল।
বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ফুটবল ক্লাব (Forbes 2024):
স্থান | ক্লাবের নাম | আনুমানিক মূল্য (বিলিয়ন USD) | রাজস্ব (মিলিয়ন USD) | অপারেটিং ইনকাম (মিলিয়ন USD) |
---|---|---|---|---|
১ | রিয়েল মাদ্রিদ | ৬.৬ | ८৯৭ | ১৬২ |
২ | ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড | ৬.৫৫ | ৭৭৯ | ১৪০ |
৩ | বার্সেলোনা | ৫.৬ | ৮২১ | ১৩২ |
৪ | লিভারপুল | ৫.৩৭ | ৮০৬ | ১২৯ |
৫ | ম্যানচেস্টার সিটি | ৫.১ | ৮১৫ | ১৯৭ |
(সূত্র: Forbes.com – “The World’s Most Valuable Soccer Teams 2024”)
জেনে রাখুন: রিয়েল মাদ্রিদ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
রিয়েল মাদ্রিদের ডাকনাম “লস ব্লাঙ্কোস” বা “সাদারা” কেন?
ক্লাবের হোম জার্সি সম্পূর্ণ সাদা রঙের। এই স্বতন্ত্র সাদা জার্সিই তাদের “লস ব্লাঙ্কোস” (সাদারা) বা “লস মেরেঙ্গেস” (সাদা-মিষ্টির রঙের সাথে সাদৃশ্য) ডাকনাম দিয়েছে। এটি বিশুদ্ধতা, অভিজাত্য এবং ক্লাবের ঐতিহ্যের প্রতীক।
রিয়েল মাদ্রিদের সবচেয়ে সফল ম্যানেজার কে?
জিনেদিন জিদান বর্তমানে রিয়েল মাদ্রিদের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ম্যানেজার। তার প্রথম মেয়াদে (জানুয়ারি ২০১৬ – মে ২০১৮) তিনি টানা তিনটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ (২০১৬, ২০১৭, ২০১৮), একটি লা লিগা (২০১৬-১৭), দুটি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ এবং অন্যান্য ট্রফি জিতেছেন। কার্লো আনচেলত্তিও অত্যন্ত সফল, যিনি দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ (২০১৪, ২০২২) এবং দুটি লা লিগা শিরোপা জিতেছেন।
রিয়েল মাদ্রিদ স্টেডিয়ামের বর্তমান নাম কী এবং এর বিশেষত্ব কী?
বর্তমান নাম এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। ক্লাবের কিংবদন্তি সভাপতি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ও বৃহৎ ফুটবল স্টেডিয়াম। বর্তমানে এর ব্যাপক পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে, যা শেষ হলে এতে থাকবে রিট্র্যাক্টেবল ছাদ, রিট্র্যাক্টেবল পিচ, উন্নত হসপিটালিটি সুবিধা এবং আরও বেশি দর্শক ধারণক্ষমতা (প্রায় ৮৫,০০০)। এটি শুধু ম্যাচের মাঠ নয়, বরং একটি বিনোদন ও শপিং কমপ্লেক্সে পরিণত হবে।
রিয়েল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ গোলদাতা কে?
ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডো রিয়েল মাদ্রিদের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্লাবে থাকাকালীন ৪৫০টি গোল করেন মাত্র ৪৩৮টি ম্যাচে। তার পরেই রয়েছেন রাউল গনজালেজ (৩২৩ গোল) এবং কার্লোস সান্তিলানা (২৯০ গোল)। বর্তমান দলে কারিম বেনজেমা (৩৫৪ গোল) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা।
রিয়েল মাদ্রিদ এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল করেছে কোন সালে?
২০১১-১২ মৌসুমে জোসে মরিনহোর কোচিংয়ে রিয়েল মাদ্রিদ অভাবনীয় ১৭৪টি গোল করে সমস্ত প্রতিযোগিতায় (লা লিগা: ১২১ গোল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ: ৩২ গোল, কোপা দেল রে: ১৯ গোল, অন্যান্য: ২ গোল)। সেই মৌসুমে তারা লা লিগা জয় করে ১০০ পয়েন্ট নিয়ে (তখনকার রেকর্ড)।
রিয়েল মাদ্রিদ “কিংস অফ ইউরোপ” নামে পরিচিত কেন?
ইউরোপিয়ান কাপ/উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদের অতুলনীয় সাফল্যের জন্যই এই উপাধি। ১৪টি শিরোপা (পরবর্তী সর্বোচ্চ এসি মিলানের ৭টি) এই প্রতিযোগিতায় তাদের শীর্ষস্থান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের জয়ের ধারাবাহিকতা (বিশেষ করে ১৯৫০-৬০ দশকে পাঁচটি টানা এবং ২০১০-দশকে চারটি) এই উপাধিকে সমর্থন করে।
রিয়েল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস শুধু ট্রফি কাউন্টের গল্প নয়; এটি অদম্য মানসিকতা, বিপদে অটুট থাকার ক্ষমতা, এবং ক্রমাগত নিজেকে নতুন করে তোলার এক জীবন্ত দলিল। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দূরদর্শিতা থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মের তারকা জুড বেলিংহামের জাদু পর্যন্ত, এই গল্পের মূল সুর একই – গৌরবের প্রতি এক অদম্য লালসা। বার্সেলোনার সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ইউরোপের শিরোপায় আধিপত্য, এবং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে রাজত্ব করা – এই সব মিলিয়েই রিয়েল মাদ্রিদ শুধু একটি ফুটবল ক্লাব নয়, এটি এক কিংবদন্তি, এক বিশ্বাস, ফুটবল ইতিহাসের এক চিরন্তন গৌরবের গল্প। তাদের যাত্রা থামেনি, থামবেও না। কারণ, এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রতিটি ম্যাচের শুরুতে ভক্তদের সেই চিরচেনা স্লোগানই ধ্বনিত হয়: “¡Hala Madrid! Y nada más!” (এগিয়ে যাও মাদ্রিদ! এবং এর চেয়ে বেশি কিছু নয়!)। তাদের পরবর্তী মহান অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।