জুমবাংলা ডেস্ক : গাজী টায়ারস ফ্যাক্টরির যে ভবনে ২৫ শে অগাস্ট অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল সেটির কাঠামো এখন কোনভাবে টিকে আছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পর ফায়ার সার্ভিস এর ভেতরে অভিযান বন্ধ রেখেছে। কিন্তু অনেকে সেখানে আসছেন নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে।
গত ২৯শে অগাস্ট বৃহস্পতিবারে সেখানে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
ফ্যাক্টরির ধ্বংসস্তূপের ভেতরে ভাইকে খুঁজছিলেন মোঃ জাকির। তিনি জানান, এই ফ্যাক্টরির কর্মী ছিলেন তার ভাই মনির হোসেন। গত ৫ই অগাস্ট থেকেই ফ্যাক্টরির কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দুই মাসের বেতন বকেয়া থাকার কথাও জানান মিঃ জাকির। ফ্যাক্টরির মালিক সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তারের সাথে সাথে লুটতরাজ শুরু হয়। খবর পেয়ে পরিস্থিতি দেখতে এসেছিলেন তার ভাই। এরপর থেকে নিখোঁজ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়েও কোনও খোঁজ মেলেনি।
“তার দুইটা ছেলে একটা মেয়ে আছিল, তাদের আমি কী বইলা বুঝ দিমু?” বলছিলেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে চারতলা পর্যন্ত উঠে খুঁজেছেন তিনি। কোনও মরদেহের চিহ্ন পাননি। মানুষের চিহ্ন বলতে অনেকের পায়ের চপ্পল পড়ে ছিল বিভিন্ন জায়গায়।
ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু পোড়া মাটি ও ছাই হাতে তুলে পলিথিন ব্যাগে ভরে নেন মিঃ জাকির তিনি।
“গ্রামে গায়েবী জানাজা দিবো, তাই আমার ভাইয়ের মাটি নিয়ে যাইতেছি। মা’র মন বুঝ তো দিতে হইবো,” বিবিসি বাংলাকে একথা বলে গ্রামের উদ্দেশ্যে মাটি নিয়ে বের হয়ে যান তিনি।
তার সাথে ইসলাম নামে আরেকজন ছিলেন, যিনি তার ভাইয়ের সাথে একত্রে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। রবিবার ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন।
তারা জানান, মালিক গ্রেপ্তারের খবরের পর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষ এই ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
তখনকার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান, সেখানে কেউ এসেছিল লুটপাট করতে, কেউ এসেছিল অন্যদের লুট করা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতে, কেউ ছিল মালিকের প্রতি ক্ষোভ থেকে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে। তাদেরই একটি অংশ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
“আগুনের পর কিছু লোক লাফ দিয়ে পড়ছে। একটা রশি বেয়ে নয়জন পুরুষ, দুইজন মহিলা নামতেসিল, অর্ধেক নামার পরে রশি ছিঁড়ে পড়ে গেছে, সেনাবাহিনী উদ্ধার করে নিয়া গেছে,” বলছিলেন মিঃ ইসলাম।
এই ফ্যাক্টরিতে ৫ই অগাস্টও লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায়। এলাকাবাসী জানান সেসময়ও বাইরের গোডাউনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।
তবে মালিকের গ্রেপ্তারের খবরে পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফ্যাক্টরির বিশাল এলাকা জুড়ে চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ।
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ভবনটির ভেতরে ও চারপাশে ঝাঁঝালো পোড়া গন্ধ। জায়গায় জায়গায় আলকাতরার মতো তরল বা মিশ্র ধরণের পদার্থ ছড়িয়ে রয়েছে।
বৃহস্পতিবারও ভবনের ধোঁয়া মূল সড়ক থেকেই দেখা যাচ্ছিল। এখানে নিখোঁজের তালিকা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।
দমকল বিভাগ, পুলিশ ও ছাত্রদের অনেকেই আলাদা আলাদা তথ্য নিলেও সেগুলো অসম্পূর্ণ।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে জানানো হয়, তাদের হাতে যে তালিকা এসেছে তাতে ক্রমিক হিসেবে নিখোঁজ ১৮৪ জনের নাম রয়েছে। তবে সে সংখ্যা আরও কমতে পারে, কারণ একই ব্যক্তি একাধিকবার নথিভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
ওদিকে আগুনের পর থেকে অনেকেই আসছেন স্বজনের খোঁজে। দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে গেটের বাইরে এসেছিলেন রোজিনা। রিকশাচালক স্বামী আল আমিনের খোঁজ করছেন তিনি।
“আমি কইছি যাইয়ো না, আমার কথা শোনে না আমার ছেলেও কইছে যাইয়ো না। পরে রাইতে ১২ তার পর দেহি ফোন বন্ধ, আমার শাশুড়ি ফোন দিছে ১১ টা পর্যন্ত খোলা, এরপর বন্ধ,” বলছিলেন তিনি।
তারা যেখানে ভাড়া থাকেন সেখান থেকেই তিনজন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানান তারা। যেমন মিল শ্রমিক তনু মোল্লার খোঁজে তার শাশুড়ি পারভীন এসেছেন রোজিনার সাথে।
তিনি বলছিলেন “এইহানে আইয়া খোঁজ নিছি, হ্যারা কয় এদিকে নাই, মরা মানুষও নাই। যারা আছিল পুইড়া ছাই হয়ে গেছেগা, পাইবো কী?”
এছাড়াও রাশেদা বেগম নামে আরেকজনের সাথে কথা হয়, যিনি তার ২১ বছর বয়সী সন্তান মোঃ আমানুল্লাহর খোঁজে এসেছেন।
“ছেলে কই পামু? মোবাইল নাই, ছেলে নাই, কোনও সন্ধান নাই, নিখোঁজ হইয়া গেছে গা,” বলছিলেন রাশেদা বেগম।
তিনি জানান, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮ টায় তার ছেলে এখানে এসেছিল। মা’র সাথে শেষ ফোনে কথা হয় রাত ১০ টার দিকে।
“আমারে ফোন দিছে, কয় এইখানে মা গণ্ডগোল হইতেছে, হাজার হাজার মানুষ, ভিতরে লোক নিতেছে আমি সবার লগে যাইতেছি দেখতে।
“লোক ডাক পাইরা নিয়া ভেতরে আটক কইরা ফালাইছে, আর পাইলাম না।”
রাশেদা বেগমের ছেলে আমানুল্লাহর সাথে তার একজন বন্ধুও নিখোঁজ রয়েছে বলে জানান তিনি।
দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে অন্তত পাঁচজনের খোঁজে আসা স্বজনদের সাথে দেখা হয়। গেটের বাইরে বাকিরা যারা এসেছিলেন বেশিরভাগই উৎসাহী জনতা।
সেনাবাহিনীর একজনের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায় যারা আসছেন তাদের অনেকে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে সামনে আসছেন না, সেক্ষেত্রে লুটতরাজের ঘটনা একটা ফ্যাক্টর হয়ে থাকতে পারে।
তিনি জানান খুব বেশি সংখ্যক নিখোঁজ মানুষের খোঁজে স্বজনরা যে আসছেন তেমনটাও নয়। ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সেদিন ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ভেতরে ঢুকতে পারছিল না। সেনাবাহিনীর এসে রাস্তা ক্লিয়ার করতে হয়। তবে সেদিনই সচিবালয়ে আনসারদের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘাতের পরিস্থির পর এলাকার অন্যান্য আনসার ক্যাম্পের আশেপাশের পরিস্থিতি নজরদারিতে তাদের দল অন্য জায়গায় চলে যান বলে জানান।
ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকেও জানানো হয় তারা এখনও নিরাপত্তার জন্য সেখানে অবস্থানে রয়েছেন যেন উৎসুক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় প্রবেশ করতে না পারেন।
আগুন লাগা ভবনের চারপাশ দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। বুধবারের সেই ফুটেজ বিবিসিকেও দেয়া হয়।
সেখানেও দেখা যায় উপরের তলাগুলিতে আগুন জ্বলতে এবং তলাগুলির ছাদের অংশ কোথাও বেঁকে আছে, কোথাও রড বের হয়ে গেছে, কোথাও কিছুটা ধ্বসেও পড়েছে।
ছাদের একেবারে উপরেও দেখা হয়েছে। কিন্তু মরদেহের তেমন অস্তিত্ব দেখা যায়নি বলে জানানো হয়।
“নিচে বেজমেন্টে কম ঝুঁকিপূর্ণ, এজন্য টিম নিয়ে আমরা বেজমেন্টে সার্চ করি। বেজমেন্টে কোনও জীবিত বা মৃত লোক আমরা পাইনাই” বলছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মান্নান।
অবশ্য এটাও আলোচনা হচ্ছে যে মরদেহ থাকলেও সেটা হয়তো ধ্বংসস্তূপের মাঝে মিশে গেছে। ফ্যাক্টরির প্রায় সবদিকেই এখন ধ্বংসস্তূপ।
যেমন পরিস্থিতি তাতে করে আদৌ নিখোঁজদের খবর পাওয়া যাবে কিনা সেটা অনিশ্চিতই বলা যায়। সূত্র : বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।