জুমবাংলা ডেস্ক : প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে বিনিময় হারের বাড়তি সরকার যে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেটি বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট- পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, এই প্রণোদনার সুফল দিচ্ছে দুবাইভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠান।
সেই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ না করে প্রণোদনার অর্থ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতের উন্নয়নে ব্যয় করার তাগিদও দিয়েছেন তিনি।
শনিবার ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজিত সেমিনারে এসব কথা বলেন আহসান মনসুর।
সেমিনারের বিষয় ছিল, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থার কারণ’। তবে ব্যাংকিং ছাড়াও আলোচনায় উঠে আসে বিনিময় হার, রিজার্ভ, রেমিটেন্স, রপ্তানিসহ অর্থনীতির প্রধান চলকগুলোর কথা।
সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা বলেন, “রেমিটেন্স আনার নামে যে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, যাদের এটা দিয়ে লাভবান হওয়ার দরকার তারা এটা সেভাবে পাচ্ছেন না। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি এই ভর্তুকির অর্থ পাচ্ছে। তারাই লাভবান হচ্ছে বেশি।
“ফলে আমি মনে করি তাদের আড়াই শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়, এটা বন্ধ করা জরুরি। কারণ এটা চালু থাকলে বাজারে একাধিক মুদ্রার দর তৈরি হয়। এটা দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।”
রেমিটেন্সে বছরে সোয়া ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এই অর্থ দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা দরকার।
“ভারত স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে জিডিপির ৬ শতাংশ, আমেরিকা ব্যয় করে ১৭ শতাংশ। আর আমাদের ব্যয় ০. ৬ – ০.৭ শতাংশ। এতেই বোঝা যায় দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের অবস্থা কতটা নাজুক।”
দুবাই ভিত্তিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে রেমিটেন্সের প্রণোদনা সুবিধা পাচ্ছে- এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে সেমিনারের পর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “দুবাইতে কয়েকটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে রেমিটেন্সে সংগ্রহ করে। ওমান, সৌদি আরবসহ বেশি কিছু দেশ থেকে তারা এই অর্থ নিয়ে আসে। তারপর এক সঙ্গে রেমিটেন্স পাঠায় বাংলাদেশে। তাতে প্রণোদনার সুফল ভোগ করছে সেসব কোম্পানি। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে রেমিটেন্স আসা কমে গেছে।”
অর্থনীতি নিয়ে আবেগে না ভেসে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হয়, সে উদাহরণ দিতে ক্রলিং পেগের মাধ্যমে বিনিময় হার নির্ধারণের উদাহরণ টানেন আহসান মনসুর।
একদিনে ডলারের দর ৭ টাকা বাড়ার পর খোলা বাজারে ডলারের ১২৫ টাকা উঠলে তা পরে নেমে আসার কথা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, “অর্থাৎ গত আড়াই মাস ধরে ডলার বাজার স্থিতিশীল রয়েছে।”
নীতি সুদহার আরেকটু বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, “৮ দশমিক ৫০ শতাংশ করলে হবে না, আমার মতে প্রয়োজনে সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে গেলে অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।
“ডলার দর স্থিতিশীল থাকবে যদি ব্যাংক সুদের হার উচ্চ থাকে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ থাকা উচিত।”
এসব নীতি বাস্তবায়ন হলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বছর শেষে সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব বলেও মত দেন তিনি।
ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করার নামে তাদেরকে এক লাখ কোটি টাকা দিয়ে সহায়তা দিলে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলেও মত দেন তিনি। বলেন, “সঙ্গে ডলার বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। ফলে আর্থিক অবস্থা কোনদিকে যাবে তা নির্ভর করবে সরকার কোন ধরনের নীতি বাস্তবায়ন করবে।”
সঞ্চয়পত্র থেকে সরে আসার পরামর্শও দেন এই অর্থনীতিবিদ। বলেন, “এটা ব্রিটিশ আমলের পদ্ধতি। এখন সময় ট্রেজারি বিল ও বন্ডের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকে, সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো। আমাদেরও সেই দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।”
রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদও দেন আহসান মনসুর। বলেন, “নইলে আর্থিক খাতে সমস্যা সমাধান হবে না। বর্তমানে ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যেটা আগে ছিল ১১ শতাংশ।”
‘আর্থিক খাতের তথ্য-উপাত্ত ভুল’
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের হিসাব সংশোধনে ১৩ বিলয়ন ডলারের যে পার্থক্যটা দেখা যাচ্ছে, সেটি নিয়েও কথা বলেন আহসান মনসুর।
তিনি বলেন, “খালি রপ্তানি খাতে ডেটার তথ্য ভুল নয়, পুরো আর্থিক খাতে ডেটা ভুল রয়েছে। আসল তথ্য না দিয়ে তা (ভুল) জিইয়ে রাখা হচ্ছে।”
আর্থিক সূচক সব সূচক কমার পরও জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ার তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই অর্থনীতিবিদ বলন, “এটা কীভাবে সম্ভব। আর্থিক খাতের তথ্যে গরমিল রয়েছে। খালি জিডিপি বাড়ালেই হবে না, দেশের প্রবৃদ্ধিও করতে হবে।”
‘ধার করে রিজার্ভ বৃদ্ধি নয়’
ঋণের টাকা যোগ হয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লে কোনো লাভ হবে না বলেও মনে করেন আহসান মনসুর।
তিনি বলেন, “ধার করে আজীবন রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব নয়। রিজার্ভ বাড়াতে হবে সঠিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
“টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে এবং রেমিটেন্স ও রপ্তানি বাড়িয়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্টকে ঠিক করতে হবে। রিজার্ভ না বাড়ালে বাংলাদেশের ওপর কারও আস্থা থাকবে না। কারণ ১৩ বিলিয়ন রিজার্ভ দিয়ে খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।”
রিজার্ভের পতনের কারণে চীন থেকে ঋণ পাওয়া যায়নি মত দিয়ে পিআরআই কর্মকর্তা বলেন, “এটা অনেকটা এই রকম যে আপনি গরিব হয়ে গেলে আত্মীয়স্বজনরাও আপনাকে অর্থ ধার দিতে ভয় পাবে। কারণ, আপনি সেই অর্থ ফেরত দিতে পারবেন কিনা সেটার নিশ্চয়তা নেই।
“সামনে বড় বড় প্রকল্প করা সম্ভব হবে না। কারণ, জাপান সহায়তা না দিলে অন্য কোনো দেশ থেকে অর্থায়ন পাবে না সরকার। তাই ভাবনা চিন্তা করে প্রকল্প হাতে নেওয়া জরুরি।”
‘১৪ বছরে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়েছে’
গত ১৪ বছরে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়েছে বলেও মূল্যায়ন করেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, “২০০১ সালে আর্থিক খাতে সংস্করণ করা শুরু হয়েছিল। সে সময় ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়তে থাকে এবং একটা নিয়মের মধ্যেও এসেছিল। সে সময় ব্যাংকিং খাতে আসলেই একটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছিল। সঙ্গে ব্যাংক খাতে নন পারফর্মিং লোনও কমছিল।
“২০১১ সালের পর এ খাতের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। গত ১৪ বছরে ব্যাংক খাত ভালো হওয়ার বদলে দুর্বল হয়েছে। ব্যাংক খাত এখন এমন একটা পর্যায় গিয়ে ঠেকেছে যে সরকারকেও ঋণ দিতে পারছে না আবার ব্যক্তি খাতেও ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারাচ্ছে।”
ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি ১৭-১৮ শতাংশ, বর্তমানে সেটা ১০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কারণ, ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অনেক টাকা বের হয়ে গেছে। সেগুলা ব্যাংকিং খাতে আর ফিরে আসেনি। আবার আমানতকারীরাও ব্যাংকে আমানত করছেন কম। তাহলে ব্যাংক তো তারল্য সংকটের মধ্যে পড়বেই।”
ব্যাংক, বন্ড, পুঁজিবাজার এবং বীমাকে আর্থিক খাতের প্রধান চারটি উপদান তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি কিলোমিটারে ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চের ঘনত্ব অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। কিন্তু ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হলেও ব্যাংক খাতের সুশাসন নেই।”
ব্যাংকিং খাত অবনতি হওয়ার কারণে সাধারণ জনগণ, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করার তাগিদ দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “এই চর্চাটা অনেকটা মলম দেওয়ার মত একটি বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু অচল ব্যাংককে টাকা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। ফলে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় রয়েছে।”
ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নানা কথা বললেও এখন চুপ। এ নিয়ে কেও কথা বলছে না। আবার এ বিষয়ে কোন জবাব সকারের পক্ষ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থনীতি এভাবে চললেই কি ভালো হয়ে যাবে?”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।