২০২৪ সালের ফরাসি অভিবাসন আইনেই নাগরিকত্ব অর্জনের শর্ত কঠোর করার ইঙ্গিত ছিল। এবার তার সঙ্গে যুক্ত করা হলো ৪০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা। এ ডিক্রি জারির মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ফ্রান্সে নাগরিকত্ব ও অভিবাসন নীতি এখন আগের তুলনায় অনেক কঠোর। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গৃহীত নতুন অভিবাসন আইনের মাধ্যমে এর শুরুটা হয়েছিল। এই আইনের মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের ফ্রান্সে প্রবেশ ও বসবাসের প্রক্রিয়াকে কঠোর করা এবং ফরাসি সমাজে অন্তর্ভুক্তি বা ইন্টিগ্রেশনকে জোরদার করা।
আইনটি অভিবাসীদের ভাষাগত দক্ষতা, পেশাগত স্থিতিশীলতা ও নাগরিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে প্রণয়ন করা হয়। এতে নাগরিকত্বের জন্য ফরাসি ভাষার দক্ষতা বি১ থেকে বি২ স্তরে এবং স্থায়ী রেসিডেন্ট পারমিটের অনুমতির জন্য এ২ থেকে বি১ স্তরে উন্নীত করা হয়।
তবে আইনটির কয়েকটি ধারা বিতর্কিত হওয়ায় ফ্রান্সের সাংবিধানিক আদালত তাতে আংশিক পরিবর্তন আনে। আদালত অন্তুর্ভুক্তি ও ভাষাগত দক্ষতা সম্পর্কিত ধারাগুলোকে বৈধ ঘোষণা করে এবং এগুলোকে সংবিধানসম্মত বলে রায় দেয়। এর ফলে ফ্রান্সে নাগরিকত্ব অর্জন প্রক্রিয়ায় কঠোরতা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
• প্রশাসনিক পর্যায়ে কঠোরতা : সার্কুলার ২০২৫
এরপর ২০২৫ সালের ৫ মে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো এক গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার জারি করেন, যা ফ্রান্সের সব প্রিফেকচুর প্রধানদের কাছে পাঠানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের আবেদন মূল্যায়নের সময় আবেদনকারীর ফরাসি ভাষায় উচ্চস্তরের দক্ষতা (বি২ স্তর), নাগরিক মূল্যবোধ ও প্রজাতন্ত্রের নীতিতে বিশ্বাস, ফ্রান্সে আসার পর থেকেই আবেদনকারীর কর্মকাণ্ড এবং গত পাঁচ বছরের পেশাগত স্থিতিশীলতাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
রোতাইয়ো বলেছিলেন, ফরাসি নাগরিকত্ব কোনো স্বয়ংক্রিয় অধিকার নয়, এটি অর্জন করতে হবে। ফরাসি হওয়া মানে এই দেশের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা। এই সার্কুলারটি মূলত ২০২৪ সালের অভিবাসন আইনকে বাস্তবিক প্রয়োগের পথে নিয়ে আসে এবং ফ্রান্সে অভিবাসীদের ফরাসি সমাজে অন্তর্ভুক্তির ধারণাকে প্রশাসনিক পর্যায়ে প্রয়োগের নির্দেশ দেয়।
• নাগরিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে ডিক্রি
অবশেষে গত ১০ অক্টোবর সই করা এক ডিক্রিতে এই ধারাবাহিক সংস্কারের চূড়ান্ত ধাপ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি রোববার (১২ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডিক্রি অনুসারে, বিদেশি নাগরিকেরা যদি নিম্নলিখিত তিন ধরনের আবেদনের যেকোনোটি করেন, তবে তাদের একটি নাগরিক পরীক্ষা বা সিভিক টেস্ট দিতে হবে।
• ফরাসি নাগরিকত্ব
• দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের অনুমতি (২ অথবা ৪ বছর মেয়াদী কার্ড)
• স্থায়ী রেসিডেন্স পারমিট (১০ বছর মেয়াদী কার্ড)
• নাগরিক পরীক্ষা : কাঠামো ও উদ্দেশ্য
নতুন দক্ষতা যাচাই পরীক্ষাটি হবে ৪০টি প্রশ্নের সমন্বয়ে। এটি মাল্টিপল চয়েস বা নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতিতে ডিজিটালি অনুষ্ঠিত হবে। যার সময়সীমা হবে ৪৫ মিনিট। পরীক্ষাটি অবশ্যই ফরাসি ভাষায় অনুষ্ঠিত হবে। অংশগ্রহণকারীদের পাশ করতে অন্তত ৮০ শতাংশ সঠিক উত্তর দিতে হবে।
৪০টি প্রশ্নের মধ্যে থাকবে :
• প্রজাতন্ত্রের নীতিমালা ও মূল্যবোধ (স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, লাইসিতে বা ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রজাতন্ত্রের প্রতীক) : ১১টি প্রশ্ন
• রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো (রাষ্ট্র, সংসদ, ভোটাধিকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন): ৬টি প্রশ্ন
• অধিকার ও কর্তব্য (আইন, কর, নাগরিক দায়িত্ব): ১১টি প্রশ্ন
• ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতি (বিপ্লব, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি): ৮টি প্রশ্ন
• ফরাসি সমাজে জীবনযাপন (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, পরিবার): ৪টি প্রশ্ন
ডিক্রির প্রথম ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এই পরীক্ষা তিন ধরনের আবেদনের জন্য একই কাঠামোর হবে। অর্থাৎ নাগরিকত্ব, দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী বসবাস এবং কয়েক বছর মেয়াদী রেসিডেন্স পারমিটের আবেদন এই তিন ক্ষেত্রেই একই ধরনের মূল্যায়ন পরীক্ষা থাকবে।
পরীক্ষা হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। শুধু অনুমোদিত কেন্দ্রগুলোতে নেওয়া যাবে। প্রার্থীর পরিচয় যাচাই বাধ্যতামূলক। প্রতারণা বা জালিয়াতি প্রমাণিত হলে পরীক্ষা বাতিল হবে এবং প্রার্থীকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য নাগরিকত্ব আবেদনে নিষিদ্ধ করা হবে।
ফ্রান্সে নাগরিকত্ব পরীক্ষায় এমসিকিউ বা নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের ধারণাটি নতুন নয়। ২০১১ সালে প্রথম এটি সামনে এনেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লদ গেয়ো। ওই সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিকোলা সারকোজি।
ক্লদ গেয়ো নাগরিকত্বের শর্ত কঠোর করার অংশ হিসেবে এটি প্রস্তাব করেছিলেন। তবে ২০১২ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টির সরকার ক্ষমতায় এসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানুয়েল ভালস এই পদক্ষেপ বাতিল করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, নাগরিকত্ব কোনো লিখিত পরীক্ষা দিয়ে নয় বরং ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা উচিত।
এক দশকের বেশি সময় পর ২০২৫ সালে এসে সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়োর ডিক্রির মাধ্যমে সেই পুরোনো ধারণাই আবার বাস্তবায়িত হলো। তার বিদায়ের পর চলতি সপ্তাহে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনোনীত হয়েছে লরো নুনেজ। তিনি আমলা এবং প্যারিস প্রেফেকচুরের প্রশাসনিক প্রধান তথা প্রেফে হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফরাসি সরকারের মতে, এই সংস্কার অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি ও মূল্যবোধের পুনর্নির্মাণের একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নতুন পরীক্ষা ও কঠোর ভাষান মানদণ্ড অনেক অভিবাসীর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবার ও শরণার্থীদের ক্ষেত্রে।
ডিক্রিতে উল্লেখিত নতুন নিয়মগুলো ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ এখন অভিবাসন ও নাগরিকত্বকে ‘অধিকার নয়’ বরং যোগ্যতার স্বীকৃত হিসেবে দেখছে। ইনফোমাইগ্রেন্টস।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।