লালমনিরহাটে সৌরচালিত সেচ পাম্পের সেচের আওতায় ৩ হাজার একর জমি

মো. জাহাঙ্গীর আলম, বাসস: লালমনিরহাট জেলায় কৃষিতে সৌরচালিত সেচ পাম্প চালু হওয়ায় সেচের আওতায় এসেছে প্রায় ৩ হাজার একর বোরো ধানের জমি। সেচ নির্ভর দানাদার ও সব্জি জাতীয় শস্য উৎপাদনে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।

লালমনিরহাটজেলায় এই পর্যন্ত ৫৩টি সৌরশক্তি চালিত পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এতে বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা ডিজেল সাশ্রয় হচ্ছে। সেচের আওতায় এসেছে প্রায় ৩ হাজার একর বোরো ধানের জমি। যাতে উৎপাদন হবে প্রায় ৬ হাজার ৫০ টন খাদ্য শস্য। যার বাজার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সেচ নির্ভর দানাদার ও সব্জি জাতীয় শস্য উৎপাদনে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।

সেচ নির্ভর কৃষিতে সৌর চালিত সেচ পাম্প আর্শীবাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কৃষি শস্য উৎপাদন ব্যয় অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে। বেচে যাচ্ছে অরিতিক্ত কৃষিশ্রমিকের মজুরি ও শ্রম ঘন্টা। জমিতে পানি সেচ নিয়ে বিবাদ এখন শূন্যে নেমে এসেছে। কৃষক জমির সেচ নিয়ে এখন চিন্তা করেনা। ধানের বা কৃষি সেচের দায়িত্ব এখন সৌর চালিত সেচ পাম্পের ম্যানেজারের উপর দিয়ে কৃষক নিশ্চিন্ত। বাই রোটেশনে ও যার জরুরি প্রয়োজন তাকেই যখন যত পানি লাগে প্রায় বিনামূল্যে পাচ্ছে কৃষক। সৌরচালিত সেচ পাম্প কৃষকের সেচ কাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জেলায় এই সেচ পাম্প ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর সেচ কাজে ব্যবহ্নিত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা প্রায় ৬ কোটি টাকার ডিজেল সাশ্রয় হচ্ছে। উৎপাদন ৬ হাজার ৫০ টন খাদ্য শস্য। সৌর চালিত পাম্প কৃষিতে এক নিরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। যা পরিবেশ বান্ধব ও নবায়ন যোগ্য প্রযুক্তি।

বিএডিসি লালমনিরহাট জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায়  এই পর্যন্ত ৫৩টি সৌরশক্তি চালিত পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এই পাম্প গুলোর দুইটি রয়েছে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী বিলুপ্ত ছিটমহলে ও জেলা সদরের কুলাঘাটের বাঁশপঁচাই ছিটমহলে। বাকি গুলো রয়েছে বিএডিসি’র সেচ প্রকল্পের অধিনে সারা জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই সব সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্পের পানি উত্তোলনের ক্ষমতা অর্ধ কিউসেক ও এক কিউসেক। এক কিউসেক সৌরশক্তি চালিত পাম্প স্থাপনে প্রায় ২৩ লাখ টাকা ও অর্ধ কিউসেক সৌরশক্তি চালিত পাম্প বসাতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই ৫৩টি সৌর সেচ পাম্প ৬৮০টি ডিজেল চালিত অগভীর নলকুপের পাম্পের সমান কাজ করে। শুস্কমৌসুমে প্রায় চার মাস পাম্প গুলো সেচের আওতায় সার্বক্ষণিক পানি উত্তোলন করে থাকে। ৫৩টি পাম্প হতে প্রায় ৭১৯ দশমিক ৬ কিলো ওয়াড বিদ্যুত উৎপাদন হয়। প্রতিবছর এই সব সৌরশক্তি চালিত পাম্প বাবদ কৃষকদের দলকে ৭ হাজার ৫০০ হতে ১০ হাজার টাকা রক্ষণাবেক্ষন বাবদ সারচার্জ দিতে হয়। এছাড়া অন্যে কোন খরচ নেই বলেই চলে। কৃষকদের সেচ পাম্প ভিত্তিক সমিতির মাধ্যমে সরকারি এই সৌরশক্তি চালিত পাম্পগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। কৃষকদের সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক সমিতির অন্যান্য সদস্যের মতামতে ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। সমিতির অধিনে প্রতিটি সেচ পাম্প পরিচালনায় একজন দক্ষ কৃষি শ্রমিক দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কৃষক সমিতি গুলো। মুলত তিনিই বাই রোটেশনে ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে পর্যায় ক্রমে সৌর চালিত পাম্প দিয়ে সেচ দিতে থাকে। সেচ নালা ও পানি সরবরাহের দায়িত্বে কৃষক বা জমির মালিক তেমন তদারকির প্রয়োজন হয় না। সমধিকার ভিত্তিতে সেচ এখানে চালু থাকে। জ¦ালানির কোন প্রয়োজন নেই। ফলে কৃষককে জ¦ালানি বাবদ অতিরিক্ত অর্থর প্রয়োজন নেই। বেশি ব্যয়ের চিন্তা থাকেনা। তাই সেচের পানি কিভাবে কতটুকু আসছে তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। জমিতে সময় মত সঠিক মাপে পানি এলেই হল। সেটা কম সময় ধরে এলো তা নিয়ে কোন চিন্তা নেই। পানি আগে পরে নেয়া নিয়ে হুড়োহুড়ি পারাপারি নেই। তাই কৃষককে পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়না। ফলে কোন ছোটখাট সংঘাত একদম সৃষ্টি হয় না। সমিতির সকল সদস্যও সেচ আওতায় সকল কৃষকের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

কৃষক রমজান আলী(৫৫) জানান, এক কিউসেক শক্তি সম্পূর্ণ সৌর শক্তি চালিত পাম্প দিয়ে প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া যায়। অর্ধ কিউসেক দিয়ে প্রায় ১৫ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া যায়। এতে করে শুস্কমৌসুমে বোরো জাতীয় ধানের জমি প্রায় ৩ হাজার  একর জমি সেচের আওতায় আনা যায়। তাতে যে পরিমান দানাদার ও সব্জি জাতীয় খাদ্য শস্য উৎপাদন হবে যাহ প্রায় ৬ হাজার ৫০ টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ১৭ শত কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা আমদানিকৃত ডিজেল সাশ্রয় হবে প্রায় ৬ কোটি টাকা। এতে কৃষকের সেচ সুবিধা দেয়অর খরচ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। শ্রমের ব্যয় কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। সৌর শক্তি চালিত সেচ পাম্প গুলো নবায়ন যোগ্য। এখানে যান্ত্রিক কোন খরচ প্রায় নেই বলেই চলে। শুধুমাত্র সৌর প্যানেল গুলো মাঝে মাঝে সাবান সোডা দিয়ে পরিস্কার করে দিতে হয়। এখানে জ¦ালানি ব্যবহার না হওয়ায় পরিবেশগত কোন ক্ষতি হয় না। বরং সরকার প্রতিটি সেচ পাম্প হতে বছরে ৭ হাজার ৫০ টাকা হতে ১০ হাজার টাকা আয় করছে। এতে সরকার বাৎসরিক আয় হয় প্রায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ৫০ টাকা। ২৫-৩০ বছর সেচ পাম্প গুলোতে বড়ধরণের কোন সংস্কার কাজ করতে হবে না। সেচ মৌসুমের পরেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজেও ব্যবহার করতে পারবে। সেচ মৌসুমের পর অন্য সময় দিনের আলোতে উৎপাদিত বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে দেয়া যেতে পারে। সরকার ভেবে দেকতে পারে। এই ৮ মাস সৌর প্যানেল গুলো মাঠে পড়ে থাকে। এই সময় ৮ মাস সৌর প্যানেল গুলৈা ব্যবহার হয় না বলেই চলে। তখন সৌর প্যানল গুলো ব্যবহারের মধ্যে থাকলে ক্রুটিমুক্ত ও যতেœ থাকত।

বিএডিসির উপপরিচালক মো. আব্দুল লতিফ জানান, সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্পগুলো কৃষিকে নতুন ভাবে এগিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। সেচ নির্ভর কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। সেচ নির্ভর সব্জি চাষ ও ধান জাতীয় ফসল উৎপাদনকে অনেক লাভজনক করে তুলেছে। ডিজেল নির্ভর সেচ পাম্প হতে মুখ ফিরে নিচ্ছে কৃষক। কিছুদিন পর ডিজেল নির্ভর কোন সেচ পাম্প দেশে থাকবে না।