গত বছরের শেষ থেকেই বিশ্বজুড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রুদ্ধশ্বাসে পর্যবেক্ষণ করছেন আর্দ্রাকে। কারণ, ক্রমেই অনুজ্জ্বল হচ্ছে এই লোহিত দানবটি। আশা ছিল, আমাদের নিকটতম এই লাল দানবের আলোর ফুলঝুরি ঘটিয়ে মৃত্যুদশায় চলে যাবে, আর সেই বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হবে মানবজাতি। কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে আবার আর্দ্রার উজ্জ্বলতা বাড়তে শুরু করে এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। নাসার হাবল টেলিস্কোপের তোলা ছবি ব্যবহার করে একদল গবেষক জানিয়েছেন, এই অপ্রত্যাশিত অনুজ্জ্বলতার কারণ আর্দ্রার আশপাশে ধূলির মেঘ।
আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আর্দ্রা কালপুরুষ বা অরিয়ন তারকামণ্ডলীর সদস্য। এটা সূর্যের চেয়ে প্রায় ১১ গুণ ভারী কিন্তু আকারে ৯০০ গুণ বড়। এমন বিশাল ফোলানো-ফাঁপানো অবস্থা দেখে বোঝা যায়, এটা জীবনের শেষ পর্যায়ে আছে। এত বড় তারকা, তাই এর জীবন শেষ হবে আলোর পসরা মেলে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। সেই বিস্ফোরণ এত উজ্জ্বল হবে যে পৃথিবী থেকে দিনের বেলাতেও খালি চোখে দেখা যাবে সেই আলো।
আর্দ্রার উজ্জ্বলতার হ্রাস-বৃদ্ধি অজানা কিছু নয়। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ স্যার জন হার্শেল উনিশ শতকেই আবিষ্কার করেন নির্দিষ্ট সময় পরপর আর্দ্রার উজ্জ্বলতা বাড়া-কমার বিষয়টি। পরে আরও পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই হ্রাস–বৃদ্ধির দুটি পর্যায়কাল আছে—একটি প্রায় ৪২০ দিনের এবং অন্যটি প্রায় ৬ বছর বা ২১০০ দিনে।
এ সময় সর্বোচ্চ উজ্জ্বলতা কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে আর্দ্রার উজ্জ্বলতা হয়ে গিয়েছিল প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। তাই বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, এটা হয়তে বিস্ফোরণের কয়েক সপ্তাহ আগের অবস্থা। আর এ ঘটনা আমরা এখন দেখছি, কিন্তু এটা ঘটেছে ৭২৫ বছর আগেই। কারণ, আর্দ্রা আমাদের থেকে প্রায় ৭২৫ আলোকবর্ষ দূরে।
বিজ্ঞানীরা আশাহত, কারণ আর্দ্রা আবার উজ্জ্বল হতে শুরু করে এবং মে মাস নাগাদ আবার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় ফেরত আসে। তাই তখন বিজ্ঞানীরা লেগে পড়েছেন এর কারণ অনুসন্ধানে। বিজ্ঞানীদের মত হলো, ধূলির মেঘের কারণেই গত কয়েক মাস অনুজ্জ্বল দেখাচ্ছিল আর্দ্রাকে। কিন্তু এই ধুলার মেঘ এল কোথা থেকে? গবেষকেরা বলছেন, এই মেঘ এসেছে আর্দ্রার থেকেই।
হাবলের সংগৃহীত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখান, আর্দ্রার পৃষ্ঠ থেকে ঘণ্টায় প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার গতিতে উত্তপ্ত প্লাজমা ছুটে আসছিল। তাঁদের ধারণা, এই প্লাজমা পরবর্তী সময়ে তারার পৃষ্ঠ থেকে সামান্য দূরে ঠান্ডা হয়ে এই ধূলির মেঘ তৈরি করেছে। পৃথিবী থেকে দেখতে এই মেঘ আর্দ্রার নিচের দিকে প্রায় এক–চতুর্থাংশ জায়গা ঢেকে দিয়েছে।
অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা জানান, এই নিক্ষিপ্ত প্লাজমা তাঁরার থেকেই দুই-চার গুণ উজ্জ্বল ছিল। এর মাসখানেক পর থেকে আর্দ্রার নিচের দিকের অংশ অস্বাভাবিকভাবে অনুজ্জ্বল হতে শুরু করে। হাবল টেলিস্কোপের অন্য পরীক্ষায় দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি নাগাদ দৃশ্যমান আলোতে আর্দ্রার উজ্জ্বলতা কমলেও অতিবেগুনি রশ্মিতে ঠিকই স্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় ফিরে গিয়েছিল।
তবে ঠিক কী কারণে আর্দ্রার পৃষ্ঠ থেকে এমন প্লাজমা ছুটে বের হলো, তা পরিষ্কার নয়। তবে গবেষকেরা ধারণা করছেন, আর্দ্রার স্বাভাবিক ছোট–বড় হয়ে উজ্জ্বলতার হ্রাস–বৃদ্ধির সঙ্গেই এর কারণ যুক্ত আছে। জার্মানির লিবনিজ ইনস্টিটিউটের স্বয়ংক্রিয় টেলিস্কোপের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, আর্দ্রা যখন আকারে প্রসারিত হচ্ছিল (৪২০ দিনের পর্যায়কাল), তখনই এই নিঃসরণের ঘটনা ঘটে।
তবে তার মানে এই নয় যে আর্দ্রার বিস্ফোরণ নিকট ভবিষ্যতে হবে না। এর আগে কখনো বিস্ফোরণের আগে কোনো তারকাকে এত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি—সব পর্যবেক্ষণই হয়েছে বিস্ফোরণের পরে। তাই বিস্ফোরণের আগে আগে ঠিক কী হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে বছরের শুরুতে আমাদের যেমন ধারণা ছিল, তত দ্রুত হয়তো মারা যাচ্ছে না রাতের আকাশের চেনা এই সঙ্গী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।