জুমবাংলা ডেস্ক: ভাব প্রকাশ, চিন্তার প্রসার বা প্রাপ্তির প্রয়োজনীয়তা যাই বলি না কেন সব জায়গাই যোগাযোগ প্রয়োজন। ভাব প্রকাশের ভাষা ও চিন্তা ভাবনা একেক জনের একেক রকম। প্রতিটি মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাও ভিন্ন। মানুষের এই ভিন্নতা তৈরি হয় তার পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে। পূর্বের জ্ঞান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ মানুষটির আচরণ, মনোভাব, অভ্যাস ও চাহিদার ভিন্নতা তৈরি করে। এবং তখন এক ধরণের সমস্যা তৈরি হয়।
দেখা যায়, মানুষ তার পূর্বের অভিজ্ঞতার সাথে ভিন্ন কোন বিষয় খুব সহজে নেয় না। তার মানে স্বভাবগত ভাবেই নতুন বিষয় গ্রহণ করতে চায় না। নতুন ধারণার গ্রহণের ক্ষেত্রে মানষিকভাবে অস্বস্তিতে ভুগে। যার ফলে হতাশা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পরে। এর ফলে কখনো কখনো তার আচরণ আক্রমণাত্মক হযে ওঠে এমনকি সংঘর্ষ বাঁধে। যোগাযোগবিদরা এই সংকট সমাধানে “কগনিটিভ ডিজওনেন্স” থিওরি তৈরি করেন।
লিওন ফেস্টিংগার কগনিটিভ ডিজওনেন্স থিওরির ধারণা প্রথম দেন। পরে এই থিওরির উপর ভিত্তি করে আরো অনেক থিওরি তৈরি হয়। থিওরিটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক। যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে কাজে লাগে। ফেস্টিংগার ১৯৫৭ সালে এই ধারণা সবার সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, মানুষ তার জ্ঞানের ধারাবাহিকতা দিয়ে একধরণের অভিজ্ঞতা তৈরি করে। তা দিয়ে বাস্তব পৃথিবীতে চলতে চায়। ফলে, অভিজ্ঞতার সাথে পুরোপুরি বিপরীত কিছু সে গ্রহণ করতে চায় না। সেসব তথ্য এড়িয়ে যায়। যখন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার সাথে ভিন্ন কিছু তথ্য পায় তখন সেটা তাকে হতাশ করে। আবার কখনো ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগে। এর ফলে, জ্ঞানের যে পার্থক্য ছিল তা থেকে যায়। এভাবে মানুষের সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বাড়ে।
বর্তমান সময়ে এসেও এই থিওরির গুরুত্ব অনেক। এই থিওরি নিয়ে বেশকিছু গবেষণা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গবেষণা হচ্ছে, “Cognitive Dissonance Theory After 50 Years of Development”। টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ইডি হারমন-জোনস এবং কিনডি হারমন-জোনস থিওরিটি নিয়ে গবেষণা করেন। প্রথমেই তারা থিওরির গাণিতিক ভাবে ব্যাখ্যা দেন। ব্যাখ্যায় দেখা যায়, কোন একজন মানুষের পূর্বের জ্ঞানের সাথে বর্তমান জ্ঞানের মিল না হলে ডিজওনেন্স হয়। এটি সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, কগনিশন=ডি/(ডি+ সি)। এখানে, ডি হচ্ছে কগনিশন ডিজওনেন্ট এর সমগ্র এককের সাথে নির্দিষ্ট কোন কগনিশন। সি হচ্ছে, কগনিশন কনসোনেন্ট এর সকল এককের সাথে একক নির্দিষ্ট কগনিশন। এখানে মূলত কগনিশনের সাথে ডিজওনেন্স ডিগ্রি বুঝানো হয়েছে।
কি ধরণের কগনিশনের ফলে কতটুকু ডিজওনেন্ট হতে পারে তার ব্যাখ্যা। ধরা যাক, কোন একজন ব্যক্তি তার পূর্বের জ্ঞানকে বিশ্বাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তিনি বিশ্বাসের বিপরীত নতুন তথ্য পেলে যেভাবে নিবেন আর যিনি জানেন কিন্তু বিশ্বাস পর্যায়ে এখনো নেয়নি তার ডিজওনেন্ট এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। কগনিশন যখন বিশ্বাস, অভ্যাস, স্বভাব, মূল্যবোধ পর্যায়ে চলে যায় তখন তার ডিজওনেন্স এর মাত্রা বেশি হয়। এই থিওরি দিয়ে বিভিন্ন বাদ (ইজম) বিশ্লেষণ করা খুব সহজ। উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে কগনিশন বিশ্বাসের চরম পর্যায়ে চলে যায় বলেই ডিজওনেন্ট বা নেতিবাচক প্রভাব বেশি হয়। তারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
সত্তর দশকের শুরু থেকে এই থিওরির উপর ভিত্তি করে নতুন কিছু থিওরি তৈরি হয়। কগনিটিভ ডিজওনেন্স যেভাবে মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে এবং কখনো তা ভায়োলেন্সের দিকে চলে যায়। ফলে- এমন কিছু থিওরি দরকার, যার ফলে মানুষটির বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে। সেসব থিওরির মাঝে রয়েছে- এরনসোন্স’র “সেলফ কনসিসটেন্সি থিওরি” (১৯৬৮[v], ১৯৯৯[vi]), স্টিলি’র “সেলফ এফারমেশন থিওরি” (১৯৮৮[vii]), কুপার এবং ফেজিও’র “নিউ লুক এট ডিজওনেন্স” (১৯৯৪[viii]) থিওরির আবিস্কার হয়।
অজানা তথ্য জানতে ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রয়োজন
“সেলফ কনসিসটেন্সি”-তে বলা হয়, মানুষ তার কগনিশন নিয়ে ইতিবাচক থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ডিজওনেন্স এর ফলে খারাপ কোন অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়া। ফলে, আচরণ পরিবর্তন বা অভ্যাস পরিবর্তন এর জন্য ওই ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ জরুরী। এককভাবে তার গল্প শোনা, তার ইচ্ছে বা অনিচ্ছের কথা শোনা বেশি কাজে দেয়। এতে তার বাধা, ট্রিগারিং ফ্যাক্টর, মোটিভেশন জানা যায়। সকল কিছু জানা গেলে তার আচরণ পরিবর্তন করা সহজ হয়। বিহেভিওর চেঞ্জ কমিউনিকেশন, ইনফরমেশন এডুকেশন এন্ড কমিউনিকেশন এর ফ্রেমওয়ার্কসমূহ এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। পরবর্তীতে এই যোগাযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময় এক্সপেরিমেন্ট করেও দেখা হয়েছে।
দূরত্ব নয়; পাশে থাকা জরুরী
এই ধারণা প্রথম সামনে নিয়ে আসেন স্টিলি “সেলফ এফারমেটিভ” থিওরির মাধ্যমে। কোন ব্যক্তি যখন কোন ধারনা বা বিশ্বাস লালন করেন তখন তার ভেতর একধরণের ছবি আঁকা হয়ে যায়। তার এই বিশ্বাসকে সম্মানের মধ্য দিয়েই তাকে বিশ্বাস থেকে সরিয়ে আনতে হবে। তার বিশ্বাসের জন্য তাকে দূরে ঠেলা নয় বরং পাশে থাকতে হবে। এতে তার ডিজওনেন্স এর মাত্রা কমে যাবে। এবং সেও একটা সময়ে অন্য মত, ধারণা, বিশ্বাসকে সম্মান জানাবে। গ্রহণ করবে। তার সাথে থেকে বিনয়ের সাথে কগনিশন পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। পরে অবশ্য ম্যাকওয়েভার, সাইমন, গ্রিনবার্গ ও ব্রেম (১৯৯৫) সালে স্টিলির এই থিওরি বাস্তবে কতটা কার্যকর তা নিয়ে গবেষণা করেন। এছাড়াও এরনসন, কোহেন, নেইল (১৯৯৯) থিওরিটি নিয়ে কাজ করেছেন।
অজ্ঞতা মানুষকে আচ্ছন্ন করে কুসংস্কার আর অযৌক্তিক আচরণের বলয়ে
কিছু মানুষ এমন আছে যারা কখনোই চায় না তাদের বিশ্বাস পরিবর্তন হোক। তারা সাধারণ কিছু জ্ঞানের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে, এবং সেগুলোই বিশ্বাস করে। ফলে- তাদের মাঝে কুসংস্করতা তৈরি হয়। তার সীমাবদ্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবন চালায় এবং কখনোই এই জ্ঞানের বাহিরে যেতে চায় না। ‘নিউ লুক’ থিওরিতে তাত্ত্বিক ডিজওনেন্স নিয়ে এই ব্যাখ্যা দেন। তাত্ত্বিক বিশ্বাস করেন, কগনিশনের জন্য জ্ঞানের অধারাবাহিকতা বা নতুন জ্ঞানে আগ্রহ না থাকা মূলত দায়ী। কারণ অনেকেই আছে তারা ধরে নেন, জ্ঞানের সকল শাখায় তার বিচরণ না করলেও চলবে। ফলে- তার জানার ও মানার আগ্রহ ও ইচ্ছে কম থাকে। তাত্ত্বিক তাই তার না জানার কারণ হিসেবে তার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
তাত্ত্বিকরা যে ৪টি জিনিস মানুষের মাঝে দেখেছেন
কগনিটিভ ডিজওনেন্স নিয়ে যেসকল তাত্ত্বিকরা কাজ করেছেন, তারা মানুষের মাঝে ৪ টি জিনিস দেখেছেন। একদল মানুষ আছে, যাদের মানসিকতা পরিবর্তন এর ইচ্ছে কম বা পরিবর্তন করতে চায় না। ২য় দলটির মানসিকতা পরিবর্তন সম্ভব তবে কোন বিষয়গুলো তার মানসিকতা পরিবর্তনে ট্রিগার করবে তা গবেষণা দিয়ে বের করা যায়নি। এক্ষেত্রে, নতুন ধারণা প্রসারের ক্ষেত্রে বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে টার্গেট অডিয়েন্স এর উপর গবেষণা করে সেসকল মানুষের চাহিদা, সীমাবদ্ধতা, মোটিভেশন ও ট্রিগারিং ফ্যাক্টর বের করে নিতে হবে।
তাহলে, যোগাযোগে ভালো রেজাল্ট আসবে। এছাড়াও আরো একদল মানুষ আছে যাদের খুব বেশি ডিজওনেন্স হয় না। ফলে- এদের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা কম থাকে। এসকল মানুষকে ভালোকিছু দেওয়া হলে এবং সে বিষয়ে সঠিক ধারণা দিলে তারা এমনিতেই সেসব গ্রহণ করে। এছাড়াও কিছু মানুষ আছে, যাদের প্রথম প্রথম ডিজওনেন্স হলেও পরে নিজ থেকেই পরিবর্তন এর জন্য চেষ্টা করে। এসব মানুষের অন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। বরং তারা একটা কাজের পর নিজেরাই ভাবতে থাকে, কোথাও আমার ভুল হচ্ছে বা হয়তো আমারই ভুল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।