ঢাকার গার্মেন্টস কর্মী শাহিনা আক্তারের দিন শুরু হতো চা-বিস্কুটের ক্লান্তি আর শরীরের ব্যথায়। রাতের শিফট শেষে ঘরে ফিরতেন ভোররাতে, সকালটা কাটত ঘুমের ঘোরে। ডাক্তার বললেন, ডায়াবেটিস আর কোমরের ব্যথা এড়াতে শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন ছাড়া কোনো উপায় নেই। সন্দেহ নিয়ে শুরু করলেন মাত্র দশ মিনিটের স্ট্রেচিং আর হাঁটা। ছয় মাস পর? শাহিনার জীবন পাল্টে গেছে। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে, কোমরের ব্যথা উধাও, কাজের এনার্জি দ্বিগুণ। তার এই রূপান্তর শুধু ব্যক্তিগত জয় নয়; বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য এক প্রমাণ – সুস্থতার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে প্রতিদিনের ছোট ছোট শারীরিক প্রচেষ্টায়।
শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন: কেন এটি আপনার অপরিহার্য অভ্যাস হয়ে উঠবে
আমরা প্রায়শই ভাবি, শরীরচর্চা মানে জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো বা কঠোর ডায়েট মেনে চলা। এই ভাবনার জন্যই ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায়, চট্টগ্রামের গার্মেন্টস এলাকায়, কিংবা খুলনার গ্রামে – আমরা সুস্থতার নেশাকে দূরে ঠেলে দিই। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরিষ্কার করে বলেছে: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি ধরনের অ্যারোবিক ব্যায়াম (যেমন: দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার) বা ৭৫ মিনিট জোরালো ব্যায়ামই যথেষ্ট। এর মানে দাঁড়ায় প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট। এই সামান্য সময়টুকুই পারে আপনার জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই অভ্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ছুঁই ছুঁই। উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে প্রায় ২ কোটি মানুষ। হৃদরোগে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। গবেষণা বারবার দেখিয়েছে, নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এই অসংক্রামক রোগগুলোর (NCDs) বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী ঢাল। ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলছেন, “অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্তি এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা – এই ত্রয়ী বাংলাদেশে হৃদরোগের মহামারির প্রধান কারণ। প্রতিদিনের সামান্য ব্যায়াম, যেমন নিয়মিত হাঁটা, সিঁড়ি ব্যবহার করা বা ঘরে বসে স্ট্রেচিং, রক্তচাপ কমায়, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত করে। এটি ওষুধের চেয়ে কম কার্যকর নয়, বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন একটি চিকিৎসা।” তার মতে, শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন গড়ে তোলা প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশির জন্য জরুরি স্বাস্থ্যবীমার মতো।
কিন্তু সুস্থতা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্থতার সঙ্গেও এর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হকের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার হার ক্রমবর্ধমান, যার পেছনে কাজের চাপ, যানজট এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অন্যতম কারণ। “নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন ও সেরোটোনিন নামক ‘ফিল-গুড’ হরমোন নিঃসরণ ঘটায়। এটি প্রাকৃতিকভাবে মানসিক চাপ কমায়, ঘুমের মান উন্নত করে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়,” উল্লেখ করেন ড. হক। ঢাকার মতো অত্যন্ত চাপের শহরে প্রতিদিনের এই ছোট্ট ‘মি-টাইম’ (আত্ম-সময়) মানসিকভাবে রিচার্জ হওয়ার মূল চাবিকাঠি।
আপনার জীবনে কিভাবে শুরু করবেন শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন
এখন প্রশ্ন হলো – শুরু করবো কিভাবে? শাহিনার মতোই হয়তো আপনারও সময়ের অভাব, শারীরিক সীমাবদ্ধতা বা একঘেয়েমির ভয় কাজ করছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন গড়ে তোলার মূলমন্ত্র হলো ধারাবাহিকতা, নিখুঁততা নয়। লক্ষ্য রাখতে হবে:
- বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ: প্রথম দিনেই এক ঘণ্টা জগিং বা ভারী ওজন তোলার চিন্তা করবেন না। শুরু করুন মাত্র ৫-১০ মিনিট দিয়ে। সেটা হতে পারে সকালে উঠে ঘরের বারান্দায় হালকা স্ট্রেচিং, অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে দশ মিনিটের হাঁটা, বা রাতের খাবারের পর পরিবারের সাথে একটু হালকা হাঁটাহাঁটি। বাংলাদেশে প্রচলিত দৈনিক ‘হাঁটার আসর’ (Walking Groups) এই বিষয়ে চমৎকার উদাহরণ, যা সামাজিকতা ও ব্যায়ামকে একসাথে মেলায়।
- আপনার পছন্দের ব্যায়াম খুঁজে নিন: ব্যায়াম মানেই বিরক্তিকর কিছু নয়। আপনি কি গান শুনতে পছন্দ করেন? তাহলে জুম্বা বা ড্যান্স ফিটনেস হতে পারে আপনার জন্য। প্রকৃতির সাথে থাকতে ভালোবাসেন? পার্কে বা নদীর পাড়ে হাঁটুন। সাঁতার, সাইকেল চালানো, বাড়িতে যোগব্যায়াম (Yoga), এমনকি বাগান করা – যেকোনো শারীরিক সক্রিয়তাই ব্যায়ামের পর্যায়ে পড়ে। ঢাকার রমনা পার্ক, চট্টগ্রামের ফয়েজ লেক, বা খুলনার শিববাড়ি মাঠ – এগুলো হয়ে উঠতে পারে আপনার ব্যায়ামের প্রিয় ঠিকানা।
- সময় ঠিক করুন এবং এটাকে অটুট রাখুন: আপনার দৈনন্দিন রুটিন বিশ্লেষণ করুন। কোন সময়টাতে আপনি নিয়মিতভাবে ১৫-৩০ মিনিট বের করতে পারবেন? সেটা ভোরবেলা, দুপুরের বিরতি, অফিস থেকে ফেরার পর, নাকি রাতের খাবারের আগে? একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন এবং প্রতিদিন ওই সময়টাকেই শরীরচর্চার জন্য সংরক্ষিত রাখুন। এটাকে আপনার দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করুন, যা ক্যান্সেল করা যায় না। ক্যালেন্ডারে টুকে রাখুন বা রিমাইন্ডার সেট করুন।
- সহজে শুরু করুন: বাড়িতেই শুরু করতে পারেন। কিছু মৌলিক সরঞ্জাম যেমন একটি যোগা ম্যাট, হালকা ডাম্বেল, বা রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড যথেষ্ট। ইউটিউবে অসংখ্য বাংলা ফিটনেস চ্যানেল (যেমন: Fitness With Mim, Bangladeshi Fitness) রয়েছে যারা বাড়িতে করা যায় এমন সহজ ও কার্যকরী ব্যায়াম শেখায়। সামর্থ্য থাকলে নিকটস্থ কমিউনিটি সেন্টার বা সুলভ মূল্যের ফিটনেস ক্লাবে জয়েন করতে পারেন।
- অভ্যাস গড়ার কৌশল: প্রথম কয়েক সপ্তাহ কঠিন লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। টিকে থাকার জন্য:
- বন্ধু বা পরিবারকে যুক্ত করুন: একসাথে ব্যায়াম করলে উৎসাহ বাড়ে এবং দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।
- অগ্রগতি ট্র্যাক করুন: একটি ছোট ডায়েরি বা ফোনের অ্যাপে আপনার ব্যায়ামের সময় ও অনুভূতি লিখে রাখুন। ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করুন।
- নমনীয় হোন: কোনো দিন রুটিন মেনে চলতে না পারলে নিজেকে দোষারোপ করবেন না। পরের দিন আবার শুরু করুন। ধারাবাহিকতাই মুখ্য, প্রতিদিন একই রকম পারফরম্যান্স নয়।
- শরীরের সংকেত শুনুন: অতিরিক্ত ক্লান্তি বা ব্যথা হলে বিশ্রাম নিন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সকালের রুটিনের অমোঘ সুফল
ভোরবেলার শরীরচর্চার আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শরীরচর্চায় নামলে পাওয়া যায় একগুচ্ছ বিশেষ সুবিধা:
- মেটাবলিজম বুস্ট: সকালের ব্যায়াম পুরো দিনের জন্য মেটাবলিজমকে সক্রিয় করে তোলে, যার অর্থ সারাদিনে আপনি বেশি ক্যালরি পোড়াবেন, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে সহজে। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- মানসিক সতেজতা: সকালের নির্মল বাতাস ও ব্যায়াম মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমায়। ফলে সারাদিনের কাজের জন্য মনোযোগ, সৃজনশীলতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ে। ঢাকার একজন ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, “সকাল ৬টায় রমনা পার্কে ৩০ মিনিট হাঁটা আমার দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এরপর অফিসের চাপও সহজ মনে হয়।”
- ভালো ঘুমের নিশ্চয়তা: গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সকালে ব্যায়াম করেন তাদের রাতের ঘুম গভীর ও আরামদায়ক হয়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অনিদ্রা সমস্যার জন্য এটি কার্যকর সমাধান।
- নিয়মানুবর্তিতা: দিনের শুরুতে ব্যায়াম শেষ করলে বাকি কাজের জন্য সময় ও শক্তি থাকে। অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে বা ক্লান্ত হয়ে ব্যায়াম বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা কমে।
বিকেল/সন্ধ্যার রুটিনের নিজস্ব সুবিধা
সকালের রুটিন সম্ভব না হলে বা পছন্দ না হলে বিকেল বা সন্ধ্যা শরীরচর্চার জন্য আদর্শ সময় হতে পারে:
- শারীরিক কর্মক্ষমতা বেশি: দিনের দ্বিতীয়ভাগে সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ও হরমোনের মাত্রা শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য সর্বোত্তম অবস্থায় থাকে। ফলে শক্তি বেশি পাওয়া যায়, পারফরম্যান্স ভালো হয়, আঘাতের ঝুঁকি কমে।
- কাজের চাপ কমানো: সারাদিনের অফিসের চাপ, মিটিং, ডেডলাইনের পর ব্যায়াম চমৎকার একটি স্ট্রেস-বাস্টার। এটি দিনের সমস্ত উদ্বেগ ও মানসিক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে সাহায্য করে। চট্টগ্রাম পোর্টে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার ফারহানা ইয়াসমিনের মতে, “অফিস থেকে ফিরে সরাসরি জিমে চলে যাওয়া আমার দৈনিক রুটিন। এক ঘণ্টা ওয়ার্কআউটের পর মনে হয় পুরো দিনের টেনশন উধাও হয়ে গেছে।”
- সামাজিক সুযোগ: অনেক কমিউনিটি ফিটনেস ক্লাস, যোগা সেন্টার বা খেলার দল বিকেল বা সন্ধ্যায় সেশন আয়োজন করে। এটি অন্যের সাথে ব্যায়াম করার এবং সামাজিক মেলামেশার সুযোগ দেয়।
- পরিবারের সাথে সময় কাটানো: বিকেলে বা সন্ধ্যায় বাচ্চাদের সাথে পার্কে খেলাধুলা করা, পরিবারের সাথে হাঁটা বা সাইকেল চালানো – এগুলো একদিকে ব্যায়াম, অন্যদিকে পরিবারের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটানোর সুযোগ। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার এটি একটি চমৎকার উপায়।
স্থায়ীভাবে রুটিন ধরে রাখার বিজ্ঞানসম্মত কৌশল
শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন শুরু করাটা এক কথা, ধরে রাখাটা আরেক চ্যালেঞ্জ। এখানে কিছু কার্যকরী কৌশল:
- ৬৬ দিনের নিয়ম: গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে কোনো নতুন অভ্যাস স্থায়ীভাবে গড়ে তুলতে প্রায় ৬৬ দিন সময় লাগে (১৮ থেকে ২৫৪ দিন পর্যন্ত ব্যক্তিভেদে)। এই সময়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করুন। একদিন বাদ পড়লে হতাশ হবেন না, পরের দিন আবার শুরু করুন।
- ট্রিগার ব্যবহার করুন: আপনার দৈনন্দিন রুটিনের সাথে ব্যায়ামকে জুড়ে দিন। যেমন: সকালে দাঁত ব্রাশ করার পরই স্ট্রেচিং করা, অফিসের লাঞ্চ শেষে দশ মিনিট হাঁটা, রাতের খাবার আগে ১৫ মিনিট যোগা। এতে ব্যায়াম স্বয়ংক্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়।
- পরিবেশকে সহায়ক করুন: রাতে শোবার আগে ব্যায়ামের পোশাক গুছিয়ে রাখুন। ব্যাগে জুতো ও টাওয়েল রেখে দিন। ফোনে রিমাইন্ডার সেট করুন। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাধা কমে।
- বৈচিত্র্য আনুন: একই ব্যায়াম প্রতিদিন করলে একঘেয়েমি আসবেই। সপ্তাহে একদিন নতুন কিছু করুন – পার্কে হাঁটার বদলে সাঁতার কাটুন, যোগার বদলে ড্যান্স ক্লাসে যান, বাড়ির ওয়ার্কআউটের বদলে বন্ধুদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলুন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (BCB) বা স্থানীয় স্পোর্টস ক্লাব প্রায়ই কমিউনিটি ইভেন্ট আয়োজন করে।
- বড় ছবি দেখুন: যখন বিরক্তি বা ক্লান্তি আসবে, তখন নিজেকে মনে করিয়ে দিন – আপনি কেন শুরু করেছিলেন। আপনার স্বাস্থ্য লক্ষ্য কী? পরিবারের সাথে ভালো সময় কাটাতে চান? নিজের জন্য বিনিয়োগ করতে চান? এই বৃহত্তর উদ্দেশ্যই আপনাকে ধাক্কা দেবে সামনে এগিয়ে যেতে।
- সামাজিক সমর্থন নিন: বন্ধু, পরিবার বা অনলাইন কমিউনিটির সাথে আপনার লক্ষ্য ও অগ্রগতি শেয়ার করুন। তাদের উৎসাহ আপনাকে অনুপ্রাণিত রাখবে। ফেসবুক গ্রুপ বা স্থানীয় ফিটনেস কমিউনিটির সাথে যুক্ত হোন।
জেনে রাখুন (FAQs)
১। শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন মানেই কি প্রতিদিন কঠোর ওয়ার্কআউট করা?
- উত্তর: একেবারেই না! শরীরচর্চার ডেইলি রুটিনের মূল উদ্দেশ্য হলো নিয়মিত শারীরিক সক্রিয়তা বজায় রাখা। প্রতিদিনের এই সক্রিয়তা হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার হতে পারে। যেমন: ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, ২০ মিনিট সাইকেল চালানো, ১৫ মিনিট যোগা বা স্ট্রেচিং, বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা, বাগান করা, এমনকি বাড়ির কাজকর্মও (ঝাড়ু দেওয়া, মোছা) কার্যকর। সপ্তাহে ১-২ দিন ভারী ব্যায়াম বা বিশ্রামের জন্য রাখতে পারেন। ধারাবাহিকতাই মুখ্য।
২। আমি খুব ব্যস্ত, প্রতিদিন সময় বের করবো কিভাবে?
- উত্তর: সময়ের অভাব একটি সাধারণ বাধা, কিন্তু অজুহাত নয়। দৈনিক শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন নেই। দিনের কাজকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন: সকালে ১০ মিনিট স্ট্রেচিং, দুপুরে ১০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, সন্ধ্যায় আরও ১০ মিনিট – এভাবেই মোট ৩০ মিনিট পূরণ করা যায়। টিভি দেখার সময় সক্রিয় বসা বা হালকা ব্যায়াম করুন। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। অফিসে বসার সময় প্রতি ঘণ্টায় ২-৩ মিনিট হাঁটুন বা স্ট্রেচ করুন। ছোট ছোট প্রচেষ্টাই বড় পরিবর্তন আনে।
৩। শরীরচর্চা শুরু করার পর হালকা ব্যথা বা ক্লান্তি লাগে, কি করবো?
- উত্তর: নতুন করে ব্যায়াম শুরু করলে বা তীব্রতা বাড়ালে পেশিতে সামান্য টান বা ব্যথা (DOMS – Delayed Onset Muscle Soreness) হওয়া স্বাভাবিক। এটি সাধারণত ২৪-৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমে যায়। এই সময়ে হালকা ব্যায়াম (যেমন: হাঁটা), পর্যাপ্ত পানি পান, পুষ্টিকর খাবার (প্রোটিন সমৃদ্ধ) এবং পর্যাপ্ত ঘুম সাহায্য করে। গরম পানির সেঁক বা হালকা মালিশও উপকারী। তবে তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, মাথা ঘোরা বা শ্বাসকষ্ট হলে অবশ্যই ব্যায়াম বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। শুরুতেই নিজেকে অতিরিক্ত চাপ দিবেন না।
৪। বয়স বেশি বা শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে, শরীরচর্চার রুটিন কি আমার জন্য নিরাপদ?
- উত্তর: যেকোনো বয়সে ও শারীরিক অবস্থায় উপযুক্ত দৈনিক ব্যায়ামের রুটিন উপকারী। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক ধরনের ব্যায়াম বেছে নেওয়া। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, আর্থ্রাইটিস বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে শুরু করার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন। তারা আপনার অবস্থা অনুযায়ী নিরাপদ ও কার্যকর ব্যায়ামের ধরন ও তীব্রতা নির্ধারণ করে দেবেন। সাধারণত হাঁটা, সাঁতার, সাইকেল চালানো (স্থির বা সাধারণ), হালকা যোগা, টাই চি, বা চেয়ারে বসে করা ব্যায়ামগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদ ও উপকারী বিকল্প। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বা কোয়ালিফাইড ফিটনেস ট্রেইনারও আপনাকে গাইড করতে পারেন।
৫। খাওয়ার সাথে শরীরচর্চার রুটিনের সম্পর্ক কি?
- উত্তর: সুস্থ জীবনের জন্য শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস – এ দুটি সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং পরস্পরের পরিপূরক। ব্যায়ামের আগে হালকা কার্বোহাইড্রেট (যেমন: একটি কলা, এক টুকরো রুটি) শক্তি জোগায়। ব্যায়ামের পর ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টার মধ্যে প্রোটিন (ডিম, দই, ডাল, মাছ/মুরগি) ও জটিল কার্বোহাইড্রেট (ভাত, রুটি, ওটস) সমৃদ্ধ খাবার পেশি পুনর্গঠনে সাহায্য করে। সারাদিন পর্যাপ্ত পানি পান নিশ্চিত করুন, বিশেষ করে ব্যায়ামের আগে, সময়ে ও পরে। ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত তেল-চিনি-লবণ যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। বাংলাদেশি খাবারের মধ্যে ডাল, শাকসবজি, মাছ, হালকা তেলের তরকারি, ফল – এগুলোই আদর্শ। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন পুষ্টি বিভাগের নির্দেশিকা: National Nutrition Services Bangladesh – NNS.
৬। মোটিভেশন হারিয়ে ফেললে কিভাবে ফিরে পাবো?
- উত্তর: মোটিভেশনের ওঠানামা স্বাভাবিক। হতাশ হবেন না। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন – কেন মোটিভেশন কমলো? একঘেয়েমি? ক্লান্তি? সময়াভাব? তারপর সেই কারণের সমাধান করুন। পূর্বের সাফল্য বা অগ্রগতি মনে করুন। অনুপ্রেরণামূলক গল্প বা উক্তি পড়ুন। ছোট লক্ষ্য নিয়ে আবার শুরু করুন (মাত্র ৫ মিনিটের জন্য)। ব্যায়ামের ধরন বদলে ফেলুন। একজন ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি পার্টনার’ (যার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন) খুঁজে নিন। মনে রাখবেন, দৈনিক শরীরচর্চার অভ্যাস জীবনের দৌড়, স্প্রিন্ট নয়। একদিন পিছিয়ে পড়লেও পথ হারানো নয়, আবার সামনে এগিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য।
সতর্কতা: এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য সাধারণ স্বাস্থ্য পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত পরামর্শের বিকল্প নয়। নতুন করে ব্যায়াম শুরু করার আগে, বিশেষ করে যদি আপনার কোনো পূর্ব-বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন: হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, জয়েন্টের সমস্যা, গর্ভাবস্থা) থাকে, অথবা আপনি দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাহলে অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ব্যায়ামের সময় অস্বস্তি, তীব্র ব্যথা, মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যায়াম বন্ধ করুন এবং প্রয়োজনবোধে চিকিৎসা সহায়তা নিন।
শরীরচর্চার ডেইলি রুটিন কোনো বিলাসিতা নয়; এটি আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি, যেভাবে দাঁত ব্রাশ করা বা গোসল করা আমাদের নিত্যদিনের অঙ্গ। শাহিনা আক্তার থেকে শুরু করে রাজধানীর ব্যস্ত পেশাজীবী, গ্রামের কৃষক, স্কুলপড়ুয়া ছাত্র বা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি – প্রত্যেকেরই এই অভ্যাসের ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার সময় এসেছে। এটি শুধু রোগ প্রতিরোধের হাতিয়ার নয়; এটি উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, আয়ু দীর্ঘ করে, মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং জীবনকে করে তোলে অনেক বেশি উপভোগ্য। আজই একটি ছোট পদক্ষেপ নিন। কাল সকালের আলো ফোটার আগেই নিজের জন্য ১০ মিনিট বরাদ্দ করুন। হাঁটুন, স্ট্রেচ করুন, নাচুন, সাইকেল চালান – যা ইচ্ছা! এই প্রতিদিনের ছোট্ট প্রতিশ্রুতিই আপনাকে নিয়ে যাবে সুস্থ, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত জীবনের দিকে। আপনার সুস্থ ভবিষ্যৎ আজকের শরীরচর্চার ডেইলি রুটিনের মধ্যেই অপেক্ষা করছে। শুরু করে দিন, এখনই!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।