নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাবেক শীর্ষ নেতা হাসান মাহমুদ চৌধুরীকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন এবং তার মৃত্যুতে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকের শোক প্রকাশ করা নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশই বাড়ছে।
১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ও দিনদুপুরে জাতীয় ছাত্র সমাজ নেতা হামিদের হাত কেটে নিয়ে উল্লাস করার নেতৃত্বে ছিলেন হাসান মাহমুদ চৌধরী। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পরে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বনে যাওয়া হাসান মাহমুদ চৌধুরী ছিলেন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ভাবশিষ্য ও ব্যবসায়িক অংশীদার।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলুর ছোট ভাই হাসান মাহমুদ চৌধুরী (৬১) সোমবার রাজধানীর একটি হাসাপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গুলশান আজাদ মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাযা শেষে তাকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
হাসান মাহমুদ চৌধুরীর মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অনেকেই শোক প্রকাশ এবং তাকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের পর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এর প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়েছেন। বুদ্ধিজীবী কবরস্থান থেকে তার লাশ সরানোর দাবিও উঠেছে।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘ প্রয়াত হাসান মাহমুদ চৌধুরী সত্তরের দশকেই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহজালাল হলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রশিবিরের চবি শাখার সভাপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন। জামায়াত-শিবিরের খুন-রগ কাটা, সন্ত্রাসের রাজনীতি মাস্টারমাইন্ড ছিল সে। তার মৃত্যুতে শোক জানানো এবং বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা— এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমরা ক্ষুব্ধ। তার লাশ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান থেকে সরানো হোক, এটা আমাদের দাবি,।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আশির দশকের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা একরাম হোসাইন ফেসবুকে পোস্টে উল্লেখ করেছেন, ‘সে (হাসান মাহমুদ) শাহজালাল হলের ছাত্র ছিল। তার সময়ে বহু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে শিবির ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম— ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বরে শিবিরের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান, দিনের দুপুরে এরশাদের জাতীয় ছাত্র সমাজ নেতা হামিদের হাত কব্জি থেকে কেটে নিয়ে উল্লাস, সাথে সাথে হুইশেল বাজিয়ে মোটরসাইকেলযোগে শিবিরের ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ, একই সময়ে সবগুলো হলের একেকটি কক্ষ থেকে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা বাঁশি শুনে হলে হলে অন্য সংগঠনের নেতাদের উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ পরিচালানা করে ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। শিবিরের সেই সফল অভিযানের সময় শিবির চবি শাখার সভাপতি ছিল চৌদ্দগ্রামের আমির হোসেন, সাধারণ সম্পাদক নূরানী চেহারার এই আলোচিত হাসান মাহমুদ (স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের সময়কার এরশাদের দালাল কুখ্যাত জিয়া উদ্দিন বাবলুর ছোট ভাই)।… হাসান মাহমুদ সাধারণ সম্পাদক থাকাকালেই চবি ক্যাম্পাস পুরোপুরি শিবিরের দখলে চলে যায়। পরে কয়েকবার দখল, পাল্টা দখল হয়েছে। স্বার্থ-সুবিধায় আওয়ামী লীগ এই ইতিহাস মনে রাখবে না।’
নব্বইয়ের দশকের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর সহযোগী হিসেবে আমরা চিনতাম হাসান মাহমুদকে। তার মৃত্যুর পর সরকারি দলের কতিপয় নেতা, বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন তাকে দানশীল, সমাজসেবী— এ ধরনের নানা উপাধিতে ভূষিত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে, আগামীতে হয়তো গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলীদের মরণোত্তর পদক দেওয়া হবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সঙ্গে একজন কুখ্যাত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছে। এটা মেনে নিতে পারছেন না আওয়ামী লীগের লোকজনও। আজকাল মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অনেকে বলেন, অথচ সামান্য ক’টা টাকার জন্য অনেকে নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, সম্মান, আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেন— এটা ভাবতেও কষ্ট হয়।’দয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কুখ্যাত সাবেক শিবির নেতার লাশ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল জুমবাংলার সম্পাদক হাসান মেজর তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাবেক শীর্ষ নেতা হাসান মাহমুদ চৌধুরীকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি।
১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর চবি ক্যাম্পাসে শিবিরের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ও দিনদুপুরে জাতীয় ছাত্র সমাজ নেতা হামিদের হাত কেটে নিয়ে উল্লাস করার নেতৃত্বে ছিলেন হাসান মাহমুদ চৌধরী। তখন তিনি চবি শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
আওয়ামী লীগের মধ্যে যে ব্যাপক হারে জামাত-শিবির ঢুকে পড়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সাবেক শিবির নেতার দাফনই তা প্রমাণ করে। যদি না ঢুকতো তাহলে শিবির নেতার দাফন কখনই শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে হওয়ার সুযোগ ছিল না।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ছোট ভাই সাবেক শিবির নেতা হাসান মাহমুদ চৌধুরীর মরদেহ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান থেকে অনতিবিলম্বে সরানোর দাবি জানাচ্ছি।’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত হাসান মাহমুদের মৃত্যুর সংবাদে উল্লেখ আছে, তার মৃত্যুতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাউজানের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, জামায়াত ইসলামীর চট্টগ্রাম মহানগরের আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম, বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি আলী আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ সাবেক ছাত্র সমিতির সাবেক সভাপতি গিয়াস উদ্দিন ও সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সভাপতি মনজুরুল আলম মনজু ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানসহ প্রায় অর্ধশত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা শোক জানিয়েছেন।
শোক জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদও।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শোক বিবৃতি পাঠিয়েও পরে ফেসবুক একটি পোস্ট দিয়ে সেটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
উপমন্ত্রী তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ‘কাশেম-নুর ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান, জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর ভাই, হাসান মাহমুদ চৌধুরীর মৃত্যুতে অনেকের মতো আমিও শোক প্রকাশ করেছি। তার সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় ছিল না। অস্ট্রেলিয়ায় চট্টগ্রাম সমিতির একটি অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। যতদূর জানি এই ফাউন্ডেশন করোনাকালীন অনুদান দিয়ে সহযোগিতা করেছে চট্টগ্রামে। তাই দানশীল ব্যক্তির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। তবে অতীতে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করেছেন বলে আমাকে জানানো হয়েছে এবং এই অভিযোগও তোলা হয়েছে যে তিনি ছাত্রলীগ নেতা হত্যার মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। আমি সেই সময়ের রাজনীতির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম না। তবে যারা ছিলেন, তারা এই কথা বলেছেন এবং যারা বলেছেন, তারা ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীই ছিলেন। সুতরাং ছাত্রশিবিরের খুনের আর বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির অপরাধ শুধু কিছু টাকা দান করলেই মোচন হয়ে যাবে না। অতীত রাজনৈতিক ও ফৌজদারি অপরাধের (যদি করে থাকে) অনুশোচনা তার ছিল কি না, জানি না। তবে সেই রাজনীতির প্রতি এবং এর ধারককে অবশ্যই ধিক্কার জানাই। বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতি, খুন-হত্যা-রাহাজানির রাজনীতি, স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে হত্যা করার রাজনীতি কখনোই আর্থিক অনুদান দিলেই মোচন হয়ে যাবে না, যেতে পারে না। শিবিরের খুনের রাজনীতি এবং এই রাজনীতিকে যেই ব্যক্তিই ধারণ করেছে, যদি তা সত্য হয়ে থাকে এবং যদি অনুশোচনা না করে থাকেন, তাহলে তার প্রতি সহানুভূতি এবং শোক প্রকাশের কোনো অবকাশ নাই।’
সাংবাদিক শাবান মাহমুদও তার শোক বার্তাটি প্রত্যাহার করে আজ এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ভাই ব্যাবসায়ী হাসান মাহমুদ চৌধুরী। সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তার সঙ্গে একবারই অামার দেখা হয়েছিলো। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে মাননীয় শিক্ষা উপ মন্ত্রী, চট্রগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগেরও একাধিক নেতা শোক জানান নিজ নিজ ফেসবুক আইডিতে। শোক জানিয়েছেন চট্রগ্রাম দক্ষিন জেলার দুই শীর্ষ নেতা। চট্রগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তাকে নিয়ে লিখেছেন দৈনিক পূর্বকোনে। স্বাভাবিকভাবেই আমার মধ্যেও ইতিবাচক ধারনার জন্ম নেয়। মরহুমকে শায়িত করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। তার রাজনৈতিক পরিচয় আমি জানতাম না। আমার ধারনা ছিলো তিনি হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক ছিলেন। যে কারনে আমিও শোক জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা বদলে যায় যখন দেখলাম শিক্ষা উপমন্ত্রী তার স্ট্যাটাসটা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আমিও তাৎক্ষণিক আমার স্ট্যাটাস প্রত্যাহার করে নেই। কারো সম্পর্কে না জেনে আমি অজ্ঞাতসারে একটি ভুল করেছি, এজন্যে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি….।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।