ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি অদৃশ্য সেতু
রোজার দিনে হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে আসে ইফতারির সেমাই, পূজার সন্ধ্যায় মুসলিম তরুণরা মন্দির প্রাঙ্গণে নিরাপত্তায় দাঁড়ায়। বাংলাদেশের এই দৃশ্য কেবল সহাবস্থান নয়, এক জীবন্ত ইন্টারফেইথ ডায়লগ। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৮% বাংলাদেশী বিশ্বাস করেন ধর্মীয় সম্প্রীতি জাতীয় অগ্রগতির চাবিকাঠি (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। তবুও সাম্প্রদায়িক উস্কানির ঝড়ে কখনও কাঁপে এই সহাবস্থান। এই প্রেক্ষাপটেই ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ‘ শব্দগুচ্ছ রূপ নেয় এক সামাজিক অস্তিত্বের মন্ত্রে। এটি কেবল তত্ত্ব নয়, প্রতিদিনের চা-দোকানের আলোচনা থেকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পর্যন্ত বিস্তৃত এক প্রাণবন্ত প্রক্রিয়া।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ: বাংলাদেশের বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের মর্মমূল
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১(১) অনুচ্ছেদ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও বাস্তবে সম্প্রীতির পথ রচিত হয় গ্রামীণ উঠোন থেকে শহরের কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের রক্তে লেখা আমাদের অভিন্ন ইতিহাস। কিন্তু ২০২১ সালের ঢাকার পূজামণ্ডপে হামলা বা ২০২২ সালের রংপুরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মনে করিয়ে দেয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ কতটা নাজুক হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ড. তানভীর হক বলছেন, “এখানে সমস্যা ধর্ম নয়, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপান্তর। প্রকৃত ইন্টারফেইথ ডায়লগ শুরু হয় যখন আমরা বুঝি— আমার প্রতিবেশীর ধর্মাচরণ আমার ধর্মবিশ্বাসের জন্য হুমকি নয়।”
গুরুত্বের তিন স্তম্ভ:
- অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ধর্মীয় সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.৭% কমতে পারে
- সামাজিক স্থিতিশীলতা: পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে ধর্মীয় উত্তেজনা সংশ্লিষ্ট সংঘাত ৩১% হ্রাস পেয়েছে যেসব এলাকায় ইন্টারফেইথ কমিটি সক্রিয়
- সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার: বাউল সাধনা থেকে লালন গীতি— বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য নিজেই ইন্টারফেইথ সংলাপের মডেল
ইন্টারফেইথ সম্প্রীতির গাইডলাইন: বাস্তব জীবনের রূপকার্থ
পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভাষা রচনা
ঢাকার ধানমণ্ডিতে একত্রে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলিম পরিবারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তারা তিনটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলেন:
১. একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নয়, সম্মান জানানো (উদা: ঈদে মিষ্টি পাঠানো, পূজায় ফুল দেওয়া)
২. ধর্মীয় আলোচনায় প্রচার নয়, বোঝার মানসিকতা রাখা
৩. সন্তানদের মধ্যে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া
“আমার মুসলিম বন্ধু রমজানে আমার জন্য আলাদা বাসনে পানি রাখে, আমি পূজার প্রসাদে তার জন্য ফল রাখি। এই ছোট্ট রীতিই আমাদের ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ‘ তৈরি করেছে,” – সুমনা দেব, শিক্ষিকা, ঢাকা।
ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ
বাংলাদেশ ধর্মীয় পরিষদ নামক সংগঠন ২০২০ সালে চার ধর্মের ৫০০ নেতাকে নিয়ে তৈরি করে “ইন্টারফেইথ কোড অফ কন্ডাক্ট”। এর কয়েকটি মূলনীতি:
- কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক ভাষণ নিষিদ্ধ
- ধর্মীয় স্থানগুলোর মধ্যে সুপারভাইজরি কমিটি গঠন
- জরুরি পরিস্থিতিতে যৌথ বিবৃতি
চট্টগ্রামের হিলট্রাক্ট এলাকায় বৌদ্ধ ভিক্ষু সঙ্ঘরক্ষিত ও স্থানীয় ইমাম ফরিদুল ইসলামের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে “ধর্মের আলো” স্কুল, যেখানে শিশুরা শেখে সব ধর্মের মূল বাণী: মানবতা।
ইন্টারফেইথ ডায়ালগ: শান্তি নির্মাণের কারিগরি
সম্প্রীতি বিনির্মাণের তিন ধাপ
১. পরিচয়ের স্তর: ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন (উদা: বসন্ত উৎসব, নবান্ন)
২. বোঝাপড়ার স্তর: ধর্মগ্রন্থের সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ নিয়ে আলোচনা (যেমন: সকল ধর্মেই দানশীলতার শিক্ষা)
৩. সম্পর্ক স্থাপনের স্তর: যৌথ সমাজসেবা (রক্তদান, বন্যা ত্রাণ)
সফল মডেল: রাজশাহীর তানোর উপজেলায় “আলোর মিছিল” নামক ইন্টারফেইথ ফোরাম গত পাঁচ বছরে সমাধান করেছে ১২০টি জমি বিরোধ, যার ৬০% ছিল ধর্মীয় উত্তেজনাজনিত। তাদের কার্যপদ্ধতি:
- মাসিক “সম্প্রীতি চা চক্র”
- যুবকদের জন্য ধর্মীয় স্টাডি সার্কেল
- জরুরি হটলাইন নম্বর
সরকার ও আইনি কাঠামো: শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রক্ষাকবচ
জাতীয় নীতিমালার অগ্রগতি
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের “ইন্টারফেইথ হারমনি গাইডলাইনস”-এ উল্লেখ আছে:
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে “সম্প্রীতি শিক্ষা” কারিকুলাম অন্তর্ভুক্তি
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে ইন্টারফেইথ কমিটির সুপারিশ বাধ্যতামূলক
- সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল
চ্যালেঞ্জ ও অর্জন:
“ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২৫ ধারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেও ২০২৩ সালে এ ধরনের ১২০টি মামলার মধ্যে মাত্র ২০%র চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে,” – মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন।
স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়তা
কুমিল্লার মডেল: প্রতিটি ইউনিয়নে “ধর্মীয় সম্প্রীতি টাস্কফোর্স” গঠন, যার সদস্যরা হলেন:
- স্থানীয় ধর্মীয় নেতা
- স্কুল শিক্ষক
- পুলিশ প্রতিনিধি
- সিভিল সোসাইটি সদস্য
ব্যক্তিগত উদ্যোগ: আপনার হাতের নাগালেই শান্তি
দৈনন্দিন জীবনের সহাবস্থান
পরিস্থিতি | করণীয় | বর্জনীয় |
---|---|---|
কর্মক্ষেত্রে | ধর্মীয় ছুটির দিনে সম্মান জানানো | ধর্মভিত্তিক রসিকতা |
সামাজিক যোগাযোগে | ধর্মীয় পোস্টে ইতিবাচক মন্তব্য | বিভাজনমূলক শেয়ার |
প্রতিবেশীর সাথে | উৎসবে শুভেচ্ছা বিনিময় | জোরপূর্বক অংশগ্রহণ চাওয়া |
রিয়েল লাইফ টুলকিট:
- “ধর্ম পরিচিতি” মোবাইল অ্যাপ: বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের তৈরি এই অ্যাপে আছে চার ধর্মের মৌলিক তথ্য (ডাউনলোড লিঙ্ক)
- ইন্টারফেইথ উইকেন্ড স্কুল: সাভারে অবস্থিত এই কেন্দ্রে বিনামূল্যে শেখানো হয় ধর্মীয় সাদৃশ্য
“আমার খ্রিস্টান বন্ধুটি যখন প্রথমবার আমার সাথে ঈদের নামাজে এল, আমরা নামাজ শেষে তাকে চায়ের দাওয়াত দিলাম। সে পরে বলল— ‘আজ বুঝলাম, ইবাদতের ভাষা আলাদা হলেও ভক্তি একই’।” – রফিকুল ইসলাম, ব্যবসায়ী, সিলেট।
উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত: বাংলাদেশ মাটিতে ফোটা শান্তির ফুল
মৌলভীবাজানের “ভাই চারা” গ্রাম:
এই গ্রামে ৩২০টি পরিবারের মধ্যে ৪ ধর্মের মানুষ একসাথে বাস করেন। তাদের সম্প্রীতির রহস্য?
- যৌথ “শান্তি কমিটি” দ্বারা সব সিদ্ধান্ত
- কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সামগ্রিক অংশগ্রহণ
- জমি বিরোধে স্থানীয় মসজিদ-মন্দিরের যৌথ ফতোয়া
চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টের আদিবাসী-বাঙালি মডেল:
খাগড়াছড়ির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মৃণালিনী ত্রিপুরা আর মুসলিম ধর্মাবলম্বী আয়েশা আক্তার। তাদের যৌথ উদ্যোগ “আলোর পাঠশালা”:
- আদিবাসী ও বাঙালি শিশুদের জন্য যুগল শিক্ষা পদ্ধতি
- একে অপরের উৎসব উদযাপন
- মাতৃভাষায় ধর্মীয় শিক্ষা
গবেষণায় প্রমাণ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সমীক্ষায় দেখা গেছে, এমন মিশ্র সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে দারিদ্র্যের হার ২২% কম এবং নারীর ক্ষমতায়ন সূচক ৪০% বেশি।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ কোনো গন্তব্য নয়, চলমান যাত্রা। প্রতিটি হাত মেলানো, প্রতিটি কৃতজ্ঞ দৃষ্টি, প্রতিবেশীর প্রার্থনায় বলার “আমিন” আমাদের যৌথ মানবতার স্বাক্ষর। বাংলাদেশের মাটি রক্তে ভেজা, কিন্তু এই মাটিতেই জন্ম নিয়েছে লালন, রবীন্দ্রনাথ, হাসন রাজার মত সমন্বয়ের দূতেরা। আজ যখন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে চায় অন্ধ শক্তি, তখন আপনার সোচ্চারতাই হতে পারে পরম ধর্ম। শুরু করুন ছোট্ট করে: আগামীকালই প্রতিবেশীর ধর্মীয় উৎসবে এক টুকরো শুভেচ্ছা পাঠান। কারণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ তৈরি হয় না রাষ্ট্রীয় ঘোষণায়, তৈরি হয় আমার-আপনার রান্নাঘরের আড্ডায়, স্কুলের খেলার মাঠে, ব্যবসায়িক সততায়। এগিয়ে আসুন, এই ইতিহাস আমরা রচনা করবো— ধর্মের নামে নয়, মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবেসে।
জেনে রাখুন
ইন্টারফেইথ ডায়ালগ বলতে কী বোঝায়?
ইন্টারফেইথ ডায়ালগ হল ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার আলোচনা। এটি ধর্ম প্রচার বা তর্ক নয়, বরং মানবিক সংযোগ স্থাপন। বাংলাদেশে এর সফল রূপ দেখা যায় যৌথ সমাজসেবা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, যেখানে ধর্মীয় পরিচয় গৌণ হয়ে ওঠে।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রধান বাধা কী?
মূল বাধা অজ্ঞতা ও রাজনৈতিক অপব্যবহার। ধর্ম সম্পর্কে ভুল তথ্য এবং ধর্মকে ভোটের হাতিয়ারে পরিণত করার প্রবণতা সম্প্রীতি নষ্ট করে। এছাড়া ব্যক্তিগত স্তরে পক্ষপাতিত্বও বাধা সৃষ্টি করে।
ইন্টারফেইথ সম্প্রীতি রক্ষায় তরুণদের ভূমিকা কী?
তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক কন্টেন্ট তৈরি করে, ইন্টারফেইথ ক্লাব গঠন করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ধর্মের জন্য যুবা” ফোরাম এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ইন্টারফেইথ বিয়ে কি বাংলাদেশে বৈধ?
বাংলাদেশে ইন্টারফেইথ বিয়ে বৈধ, তবে এ জন্য বিশেষ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইন অনুযায়ী, ধর্মনিরপেক্ষ বিবাহ রেজিস্ট্রি সম্ভব। তবে সামাজিক স্বীকৃতি পেতে পরিবার ও সমাজের সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ।
কোন প্রতিষ্ঠান ইন্টারফেইথ ইস্যুতে সহায়তা করে?
বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট কাউন্সিল (bhd.org.bd) ইন্টারফেইথ সংক্রান্ত আইনি ও সামাজিক পরামর্শ দেয়। এছাড়া স্থানীয় থানায় ধর্মীয় সম্প্রীতি কমিটি এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ জানানো যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।