শিথিল লকডাউনে পথে পথে দুর্ভোগ

সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে: রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন নাজমা আক্তার। মিরপুর-১১ নম্বর সেকশন থেকে তিনি হেঁটে কাজীপাড়া পর্যন্ত এসেছেন।

এরপর আড়াইশ’ টাকা ভাড়ায় একটি রিক্সায় ফার্মগেইট এসে বাকি পথ আবারও হেঁটে অফিসে এসেছেন। সরকারি নির্দেশে গণপরিবহন বন্ধ করা হয়েছে সোমবার থেকে।

ডয়চে ভেলেকে নিজের অফিসে আসার বর্ণণা করতে গিয়ে নাজমা বলেন, “খুবই অল্প বেতনে চাকরি করি পরিবারকে সাহায়তা করার জন্য। তিন মাস বেতন হয় না। এর মধ্যে অফিসে আসতে আর যেতে যদি ৫০০ টাকা রিক্সা ভাড়া দিতে হয় তাহলে বেতনই তো আর থাকে না। অফিস যদি যানবাহনের ব্যবস্থা না করে তাহলে চাকরি করায় কঠিন হয়ে যাবে। সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের খুবই কষ্ট দিচ্ছে। যাদের গাড়ি আছে তারা তো নির্বিঘ্নেই চলে যাচ্ছেন। অফিসে আবার একটু দেরি হলেই জবাবদিহি করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে আমরা অনেক কষ্টে আছি, সেটা বলে বোঝাতে পারব না।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই ধরনের শিথিল লকডাউনে কোন উপকারই হয় না। এর ভাইরোলজিক্যাল কোন ভেল্যু নেই। এতে শুধু মানুষের দুর্ভোগই বাড়ে। আপনি লকডাউন দিলে সবকিছু বন্ধ করতে হবে। যাতে কোন কাজে কাউকে বাইরে যেতে না হয়। এখন অফিস খোলা রেখে, গণপরিবহন বন্ধ করে লাভ কী? যারা অফিসে যাচ্ছে তারা তো গায়ে গা লাগিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেখানেও তো সংক্রমণ হতে পারে?”

সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। সোমবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় ইনু বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। লকডাউন নিয়ে বারবার প্রজ্ঞাপন ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সেই অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। আবার প্রজ্ঞাপনে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে এটা বাঞ্ছনীয় নয়। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ নয়টি মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত। এই নয়টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতাও লক্ষণীয়।

সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও খোলা আছে সরকারি-বেসরকারি অফিস। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় অফিসগুলোকে তাদের কর্মী আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেটা করেনি। ফলে অফিসগামীদের মধ্যে ভোগান্তি ছিল চরমে।

দুপুর ১টার দিকে বিজয়নগর মোড়ে কথা হয় একটি বেসরকারি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তা শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে তার বাসা। সকালে কিছুদূর হেঁটে, কিছুটা রিক্সায় চড়ে তিনি ১০টায় মতিঝিল অফিসে পৌঁছেছেন। তাতেও খরচ হয়েছে ২২০ টাকা। অফিসে আসার পর ইস্কাটনে এক ক্লাইন্ডের অফিসে যেতে বলা হয়। কারণ দু’দিন পর সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে তাই এখন সেখানে যেতে হবে। কিন্তু অফিস থেকে কোন গাড়ি দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে রিক্সায় করে আবার ইস্কাটনে যান। ভাড়া দিতে হয়েছে ২৬০ টাকা। কাজ থেকে আবার আড়াইশ’ টাকা ভাড়ায় অফিসে ফিরছেন। এরপর আবার বাসায় ফেরার জন্য রিক্সা ভাড়া দিতে হবে। সবমিলিয়ে একদিনে যদি এক হাজার টাকা রিক্সাভাড়া দিতে হয় তাহলে বেতনের পুরো টাকাই তো পথে চলে গেল। সংসার চলবে কীভাবে? সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বন্ধ করলে সব বন্ধ করে দিক, আর খোলা রাখলে সব খুলে রাখুক। অযথা মানুষকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে?

শুধু নাজমা বা শহীদুল নয়, এমন অংখ্য মানুষকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সকালে দেখা যায়, অফিসগামীদের অনেকেই পিকআপ, ট্রাকে উঠে অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই গন্তব্যে হওয়ায় দু’জন কিংবা তিনজন মিলে একটি রিকশায় যাচ্ছেন। মটরসাইকেলগুলোতেও ভাড়া নিয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ।

মানুষের এই দুর্ভোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা তো অফিস বন্ধ রাখতে বলেছি। জরুরি সেবা হিসেবে কোন অফিস খোলা থাকলে তাদের কর্মীদের আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তো তাদের। সবাইকে তো সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এখন করোনার যে পরিস্থিতি তাতে লকডাউন দেওয়া ছাড়া তো আর কোন পথ নেই।” আর দুই দিন পর কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তখন আর কাউকে দুর্ভোগে পড়তে হবে না। সবকিছুই তখন বন্ধ থাকবে। কঠোরভাবে সেটা মনিটরিংও করা হবে। আমি বলব, সবার সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চলুন।”

পহেলা জুলাই থেকে নামছে সেনাবাহিনী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার ঠেকাতে কঠোর বিধিনিষেধসহ ১ জুলাই থেকে যে লকডাউন শুরু হচ্ছে, তখন জনসাধারণের জরুরি চলাচলের জন্য বিশেষ ‘মুভমেন্ট পাস’ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ থাকবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবেন না। টহলে থাকবে সেনাবাহিনী। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “লকডাউনে আর্মি, বিজিবি, ব্যাটেলিয়ান পুলিশ টহলে থাকবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাদের ‘অথরিটি’ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে কোনোভাবেই বের হতে না পারে তারা তা ‘মনিটর’ করবে। আমরা সশস্ত্র বাহিনীকে বলছি, টহল দেবে। কেউ কথা না শুনলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া তাদের কাজের মধ্যে থাকবে।” তিনি বলেন, আমাদের মূল কথা কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না।

লকডাউনে বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। সোমবার সকালেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটের ফেরিতে পার হয়েছেন। তবে গত কয়েকদিনের চেয়ে সোমবার সকাল থেকে যাত্রীদের উপস্থিতি কিছুটা কমেছে। এদিকে পণ্যবাহী গাড়ির চাপ বেড়েছে ফেরিঘাটে। ঘাটে দীর্ঘসারি দেখা যায় পণ্যবাহী গাড়ির।

বিআইডাব্লিউটিসির শিমুলিয়াঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে বহরের ১৬টির মধ্যে বর্তমানে ১৪টি ফেরি সচল রয়েছে। ঘাট এলাকায় পদ্মা নদী পারাপারের লকডাউনেও শিমুলিয়ায় জনস্রোত চলছেইঅপেক্ষায় রয়েছে পাঁচশতাধিক গাড়ি। সিরিয়াল অনুযায়ী সব গাড়ি পার হয়ে যাবে।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল। তবে সেটা গত দু’দিনের তুলনায় যাত্রী সংখ্যা কম। তিন দিনের সীমিত লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও পিকআপের মাধ্যমে গন্তব্যে রওনা হচ্ছেন অনেক। এতে গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। যাত্রীদের অভিযোগ, আগে যেখানে যেতে ৫০০ টাকা লাগত, এখন সেখানে দুই হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।

অবশ্য কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, সড়কে গাড়ির চাপ কম। জরুরি কারণ ছাড়া প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস সড়কে চলাচল করলে মামলা দেয়া হচ্ছে। ভাড়ায় যাত্রী নেওয়ার কোন খবর তার কাছে নেই।