(বাক্যটি শুরুতেই বলা দরকার: আজকের শিশুরা জন্মেছে স্ক্রিনের আলোয়, খেলছে ভার্চুয়াল জগতে। এই বাস্তবতায় ‘নিরাপদ গেমিং’ শুধু অপশন নয়, তাদের সুস্থ শারীরিক-মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য শর্ত।)
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু শোনা যায় কীবোর্ডের দ্রুত টকটক শব্দ আর মাউসের ক্লিক। বারো বছরের আরাফাত গভীর মনোযোগে বসে আছে তার গেমিং সেটআপের সামনে। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা, কিন্তু পাশের ঘরে তার মা-বাবার চিন্তার ভাঁজ ক্রমেই গভীর হচ্ছে। ‘কী খেলছে সে? কাদের সঙ্গে কথা বলছে অনলাইনে? রাত জেগে খেলার ফলে পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, সামাজিকতা— সবই কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?’ ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাসরত সাদিয়া আক্তারের এই উদ্বেগ আজকের অসংখ্য বাংলাদেশি অভিভাবকের প্রতিনিধিত্ব করে। ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য গেমিং শুধু বিনোদন নয়, সামাজিকতা ও শেখার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ডিজিটাল খেলার মাঠটিকে শিশুদের জন্য নিরাপদ করে তোলার দায়িত্ব কার? উত্তরটা পরিষ্কার: অভিভাবক, শিক্ষক, গেম ডেভেলপার, নীতিনির্ধারক— সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই তৈরি হতে পারে সুস্থ বিকাশের চাবিকাঠি।
শিশুদের জন্য নিরাপদ গেম কেন অপরিহার্য? – শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক প্রভাবের গভীর বিশ্লেষণ
গেমিংকে শুধু ‘সময় নষ্টের কাজ’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার দিন শেষ। ইউনিসেফের সর্বশেষ রিপোর্ট (২০২৩) স্পষ্ট করেছে: উপযুক্ত ও নিরাপদ গেম শিশুদের জ্ঞানীয় দক্ষতা (Cognitive Skills), সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এমনকি সৃজনশীলতায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। কিন্তু বিপদটা লুকিয়ে আছে অনিরাপদ, অপ্রযোজ্য বা অতিমাত্রায় গেমিংয়ে।
- মস্তিষ্কের বিকাশে সরাসরি প্রভাব: হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণা (২০২২) ইঙ্গিত দেয় যে, সহিংস বা অতি উত্তেজনাপূর্ণ গেমের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি শিশুদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যকারিতায় পরিবর্তন আনতে পারে, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও যৌক্তিক চিন্তায় প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, শিক্ষামূলক পাজল গেম (যেমন: Minecraft Education Edition), সিমুলেশন গেম বা কৌশলগত গেম (Strategy Games) মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি ও ফোকাস উন্নত করে।
- মানসিক সুস্থতার সূক্ষ্ম ভারসাম্য: বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (NIMH) মনোবিদ ড. মেখলা সরকারের মতে, “নিরাপদ গেমিং অভ্যাস শিশুদের চাপ কমাতে, সামাজিক সংযোগ স্থাপনে (অনলাইন ফ্রেন্ডলি গেমের মাধ্যমে) সহায়তা করে। কিন্তু ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’-কে WHO স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আমরা দেখছি, অনিয়ন্ত্রিত গেমিং উদ্বেগ, বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে।
- সাইবার বুলিং ও অনলাইন শোষণের ভয়ংকর ঝুঁকি: চট্টগ্রামের এক অভিভাবক রেজাউল করিমের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা: তার দশ বছরের ছেলে একটি জনপ্রিয় অনলাইন গেমে ‘বন্ধু’ সাজা একজনের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য ও পারিবারিক ছবি শেয়ার করে, যা পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইলের কাজে লাগানো হয়। ওপেন সোর্স গেমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে চ্যাট ফিচার শিশুদের অপরিচিত, সম্ভাব্য বিপজ্জনক ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আনতে পারে।
বাস্তব উদাহরণ: রাজশাহীর ‘ডিজিটাল লিটারেসি ফর টিনস’ কর্মশালায় অংশ নেওয়া চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ফাইয়ারা। সে এখন শুধু PEGI (Pan-European Game Information) বা ESRB (Entertainment Software Rating Board) রেটিং দেখেই গেম ডাউনলোড করে। সে বুঝতে শিখেছে কেন তার বয়সের জন্য ‘E for Everyone’ বা ‘E10+’ ট্যাগযুক্ত গেমগুলো নিরাপদ, আর ‘M for Mature’ গেমগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
কীভাবে বেছে নেবেন শিশুর জন্য নিরাপদ গেম? – বয়স, রেটিং ও উদ্দেশ্য বুঝে বাছাইয়ের বিজ্ঞান
‘নিরাপদ গেম’ মানে শুধু সহিংসতামুক্ত গেম নয়। এর অর্থ হলো বয়স, বিকাশের স্তর, ব্যক্তিত্ব এবং শেখার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গেম।
১. গেম রেটিং সিস্টেমকে আপনার সহায়ক করুন:
- PEGI (Pan-European Game Information): ইউরোপে বহুল ব্যবহৃত এই রেটিং সিস্টেম গেমের প্যাকেটে বয়স লেবেল (3, 7, 12, 16, 18) এবং বিষয়বস্তুর আইকন (হিংসা, ভয়, অশ্লীল ভাষা, জুয়া ইত্যাদি) প্রদর্শন করে। PEGI অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে বিস্তারিত জানুন।
- ESRB (Entertainment Software Rating Board): প্রধানত উত্তর আমেরিকায় ব্যবহৃত, কিন্তু বহু আন্তর্জাতিক গেমে এই রেটিংও দেখা যায় (Everyone (E), Everyone 10+ (E10+), Teen (T), Mature (M), Adults Only (AO))।
- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: অভিভাবকদের সরাসরি গেম ডাউনলোড বা কিনার আগে PEGI/ESRB রেটিং চেক করার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে গেমের ডেসক্রিপশনে এই রেটিং থাকে।
২. গেমের ধরন বুঝুন (Genre Matters):
- এডুকেশনাল ও পাজল গেমস: Khan Academy Kids, Duolingo ABC, Monument Valley, Thinkrolls। (জ্ঞান বৃদ্ধি, সমস্যা সমাধান)।
- ক্রিয়েটিভিটি ও বিল্ডিং গেমস: Minecraft (ক্রিয়েটিভ মোড), Roblox (সঠিকভাবে কার্যকর করলে), Toca Boca সিরিজ। (কল্পনাশক্তি, ডিজাইন স্কিল)।
- সিমুলেশন গেমস: Animal Crossing, Stardew Valley (দায়িত্ববোধ, রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট)।
- স্পোর্টস ও রিদম গেমস: FIFA (নির্বাচিত মোড), Just Dance (শারীরিক কার্যকলাপ)।
- যে গেমগুলো এড়িয়ে চলা উচিত: অতিরিক্ত হিংসাত্মক (গ্র্যান্ড থেফট অটো সিরিজ, কল অফ ডিউটি – ছোটদের জন্য), জুয়া মেকানিক্সযুক্ত, বা অতি প্রতিযোগিতামূলক (যা হতাশা বাড়ায়) গেম।
৩. অনলাইন ইন্টারঅ্যাকশনের নিরাপত্তা:
- গেমের চ্যাট সেটিংস: চাইল্ড অ্যাকাউন্টে চ্যাট ডিজেবল করুন বা শুধু ‘প্রি-অ্যাপ্রুভড ফ্রেন্ডস’-এর সাথেই চ্যাটের সুযোগ দিন।
- ভয়েস চ্যাট সতর্কতা: অপরিচিতদের সাথে ভয়েস চ্যাট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ারিং: শিশুকে শেখান কখনোই নাম, ঠিকানা, স্কুলের নাম, ফোন নম্বর, ছবি বা পাসওয়ার্ড অনলাইনে শেয়ার করা যাবে না।
পারিবারিক অভিজ্ঞতা: খুলনার ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ হাসান তার দুই সন্তানের জন্য গেমিং টাইমে ‘ফ্যামিলি শিল্ড’ বা গুগলের ‘ফ্যামিলি লিংক’ অ্যাপ ব্যবহার করেন। এতে তিনি দেখতে পান তারা কোন গেম খেলছে, কতক্ষণ খেলছে এবং অ্যাপ ইন্সটলের আগে তার অনুমতি নিতে হয়।
নিরাপদ গেমিং অভ্যাস গড়ে তোলার রোডম্যাপ: সময়, টুলস ও টক
গেম নির্বাচনের পর আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ: সুস্থ অভ্যাস প্রতিষ্ঠা করা। এখানে শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, শিক্ষা ও সংলাপ চাবিকাঠি।
১. স্ক্রিন টাইম ম্যানেজমেন্ট – বাস্তবসম্মত নিয়ম:
- বয়সভিত্তিক গাইডলাইন: আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (AAP) পরামর্শ দেয়:
- ১৮-২৪ মাস: শুধু উচ্চ-গুণগত এডুকেশনাল কনটেন্ট, প্যারেন্টের সাথে দেখা।
- ২-৫ বছর: প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা, উচ্চ-গুণগত প্রোগ্রাম/গেম।
- ৬ বছর+: সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমা নির্ধারণ, নন-স্ক্রিন কার্যকলাপ (শারীরিক খেলা, বই পড়া, পারিবারিক সময়) অগ্রাধিকার দেওয়া।
- পরিকল্পিত রুটিন: সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে নির্দিষ্ট ব্লক টাইম দেওয়া ভালো, স্কুলের রাতের আগে গেমিং নয়। ‘স্ক্রিন-ফ্রি জোন’ তৈরি করুন (যেমন: খাবার টেবিল, শোবার ঘর)।
- গেমিং ছাড়া সময়ের মূল্য: শিশুকে বাইরে খেলতে, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতে, হবি চর্চা করতে উৎসাহিত করুন।
২. প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলসের কার্যকর ব্যবহার:
- অপারেটিং সিস্টেম লেভেল: উইন্ডোজের ‘ফ্যামিলি অপশনস’, অ্যাপলের ‘স্ক্রিন টাইম’, অ্যান্ড্রয়েডের ‘ফ্যামিলি লিংক’। (সীমা নির্ধারণ, কনটেন্ট ফিল্টারিং, ক্রয় নিয়ন্ত্রণ)।
- কনসোল ও গেমিং ডিভাইস: প্লেস্টেশনের ‘ফ্যামিলি ম্যানেজমেন্ট’, এক্সবক্সের ‘মাইক্রোসফট ফ্যামিলি ফিচার্স’, নিন্টেন্ডো স্যুইচের ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ’।
- তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ: Net Nanny, Qustodio (অ্যাডভান্সড মনিটরিং ও ফিল্টারিং, তবে সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক)।
গুরুত্বপূর্ণ: টুলস ব্যবহার করুন, কিন্তু বিশ্বাস ও আলোচনার বিকল্প হিসেবে নয়। শিশুকে বুঝিয়ে বলুন কেন এই নিয়মগুলো জরুরি।
৩. সক্রিয় প্যারেন্টাল ইনভলভমেন্ট – খেলুন, শিখুন, আলোচনা করুন:
- গেমের জগতে ঢুকে পড়ুন: মাঝে মাঝে শিশুর সাথে বসে তার পছন্দের গেমটি খেলুন। এতে আপনি গেমের প্রকৃতি বুঝবেন, তার দক্ষতা দেখবেন এবং সম্পর্ক গড়ার সুযোগ পাবেন।
- ডিজিটাল সিটিজেনশিপ শেখান: অনলাইনে কীভাবে ভদ্র আচরণ করতে হয় (Good Gaming Etiquette), কীভাবে ট্রোলিং বা বুলিং রিপোর্ট করতে হয়, কীভাবে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে হয় – তা নিয়মিত আলোচনার বিষয় করুন।
- লক্ষণ চিনুন: অতিরিক্ত গেমিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাবের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন হোন (আচরণগত পরিবর্তন, পড়াশোনায় অবনতি, বাস্তব বন্ধুদের থেকে দূরে সরে যাওয়া, গেম নিয়ে মিথ্যা বলা, গেম না খেললে বিরক্তি বা উদ্বেগ)।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা: সম্মিলিত দায়িত্ববোধের আহ্বান
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যাপক প্রসার শিশুদের জন্য নিরাপদ গেমিংকে জাতীয় অগ্রাধিকারের তালিকায় নিয়ে এসেছে। চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্ট:
- সচেতনতার অভাব: অনেক অভিভাবক গেম রেটিং, প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের অস্তিত্বই জানেন না।
- সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য নিরাপদ গেমের অভাব: আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষামূলক গেমগুলো দামি হওয়ায় বা বাংলা ভাষার সমর্থন না থাকায় অনেকের নাগালের বাইরে।
- লোকালাইজড কনটেন্টের ঘাটতি: বাংলাদেশি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত শিক্ষামূলক গেমের বড়ই অভাব।
তবুও সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছে:
- সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (ICT Division) ডিজিটাল সাক্ষরতা কার্যক্রমে শিশুদের অনলাইন সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো (Shikho, 10 Minute School) শিক্ষামূলক গেমিফাইড অ্যাপ তৈরি করছে।
- স্কুলের ভূমিকা: স্কুলগুলোতে ডিজিটাল লিটারেসি কারিকুলামে ‘নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার’ ও ‘গেমিং সচেতনতা’ অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
- গেম ডেভেলপারদের দায়িত্ব: বাংলাদেশি গেম স্টুডিওগুলোর উচিত বয়স উপযোগী, বাংলা ভাষায় শিক্ষামূলক গেম তৈরি করা এবং সেগুলোতে শক্তিশালী প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ও গোপনীয়তা সেটিংস রাখা।
শিশুদের জন্য নিরাপদ গেমিং কেবল প্রযুক্তির ব্যবহার নয়; এটি একটি সামাজিক দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। গেমের জগতকে যখন আমরা সচেতনভাবে, নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে শিখব, তখনই তা পরিণত হবে শিশুর মেধা, সৃজনশীলতা ও সামাজিক দক্ষতা বিকাশের সুস্থ বিকাশের চাবিকাঠিতে। প্রতিটি ক্লিক, প্রতিটি লেভেল, প্রতিটি অনলাইন ইন্টারঅ্যাকশনই হোক তাদের ভবিষ্যতের পথকে আরও উজ্জ্বল, দক্ষ ও দায়িত্বশীল করে তোলার হাতিয়ার। আপনার শিশু আজ কী খেলছে, তা নিয়ে কথা বলুন। তাদের ডিজিটাল জগতে পথপ্রদর্শক হয়ে উঠুন।
জেনে রাখুন (FAQs): শিশুদের গেমিং সংক্রান্ত সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
১. আমার শিশু দিনে কতক্ষণ গেম খেলতে পারবে?
- বয়স ও দৈনন্দিন রুটিন বিবেচনায় রেখে স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত সময়সীমা (যেমন: স্কুলের দিনে ৩০ মিনিট – ১ ঘণ্টা, ছুটির দিনে ১-২ ঘণ্টা) ঠিক করুন। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের গাইডলাইন (বয়স ২-৫ বছর: দিনে ১ ঘণ্টার কম, ৬+ বয়স: সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমা) দরকারি রেফারেন্স। স্ক্রিন টাইমের চেয়ে নন-স্ক্রিন এক্টিভিটিকে (শারীরিক খেলা, পড়া) অগ্রাধিকার দিন।
২. কোন ধরনের গেম শিশুদের জন্য উপকারী হতে পারে?
- শিক্ষামূলক পাজল গেম (যেমন: Khan Academy Kids, Duolingo), সৃজনশীল বিল্ডিং গেম (Minecraft – ক্রিয়েটিভ মোড), সিমুলেশন গেম (Animal Crossing), রিদম বা স্পোর্টস গেম (Just Dance) ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গেমটি যেন বয়স উপযোগী (PEGI/ESRB রেটিং চেক করুন), সহিংসতা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টমুক্ত হয় এবং খোলামেলা চিন্তা বা সমস্যা সমাধানকে উৎসাহিত করে – তা নিশ্চিত করুন।
৩. অনলাইন গেমে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করব কীভাবে?
- গেমের সেটিংসে চাইল্ড সেফটি/প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অপশন অন করুন। চ্যাট ফিচার ডিজেবল করুন বা শুধু রিয়েল-লাইফ পরিচিত বন্ধুদের সাথে চ্যাটের অনুমতি দিন। শিশুকে শেখান কখনোই নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, স্কুলের নাম বা ছবি অনলাইনে শেয়ার করা যাবে না। অপরিচিতদের পাঠানো লিংক বা ফাইল ক্লিক করা বিপজ্জনক হতে পারে। পাসওয়ার্ড শক্তিশালী ও গোপন রাখতে বলুন।
৪. গেমিং আসক্তি নিয়ে চিন্তিত হলে কী করব?
- লক্ষণগুলো চিনুন: স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ হারানো, গেম না খেলে অস্থিরতা/মেজাজ খিটখিটে হওয়া, পড়াশোনা/বাস্তব সম্পর্কে অবহেলা, গেম নিয়ে মিথ্যা বলা, ঘুম ও খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম। প্রথমে শান্তভাবে কথা বলুন, উদ্বেগের কারণ বুঝতে চেষ্টা করুন। গেমিং টাইম কমিয়ে ধীরে ধীরে বিকল্প শখ (খেলাধুলা, আঁকা, বাইরে খেলা) গড়ে তুলতে সাহায্য করুন। যদি সমস্যা গুরুতর মনে হয়, বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (NIMH) বা কোনও শিশু মনোবিদের পরামর্শ নিন।
৫. প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ কী? কোনগুলো ব্যবহার করা যায়?
- প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ হলো এমন সফটওয়্যার যা অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানের ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার (গেম খেলা, অ্যাপ ব্যবহার, ওয়েব ব্রাউজিং) মনিটর ও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। জনপ্রিয় কিছু অ্যাপের মধ্যে রয়েছে গুগলের ফ্যামিলি লিংক (অ্যান্ড্রয়েড), অ্যাপলের স্ক্রিন টাইম (আইওএস/ম্যাক), মাইক্রোসফট ফ্যামিলি সেফটি (উইন্ডোজ/এক্সবক্স), এবং তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ যেমন Qustodio, Net Nanny। এগুলো দিয়ে স্ক্রিন টাইম সীমা বাঁধা, অনুপযুক্ত কনটেন্ট ব্লক করা, অ্যাপ ব্যবহার দেখা, লোকেশন ট্র্যাক করা ইত্যাদি যায়।
৬. বাংলাদেশি শিশুদের জন্য ভালো বাংলা বা স্থানীয় শিক্ষামূলক গেমের উদাহরণ দিতে পারবেন?
- স্থানীয়ভাবে তৈরি মানসম্মত শিক্ষামূলক গেমের সংখ্যা এখনও বাড়ানোর সুযোগ আছে। তবে কিছু উদ্যোগ লক্ষণীয়:
- Shikho: অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, গেমিফাইড কোয়িজ ও ইন্টারঅ্যাক্টিভ কনটেন্ট আছে।
- ১০ Minute School: বিভিন্ন একাডেমিক বিষয়ে ইন্টারঅ্যাক্টিভ ভিডিও ও কোয়িজ।
- Chhota Shikshok: ছোটদের জন্য বাংলা বর্ণ, সংখ্যা শেখার অ্যাপ।
- Grameenphone’s “টেন মিনিট স্কুল” এর কিছু মডিউল।
আন্তর্জাতিক অ্যাপের মধ্যে Khan Academy Kids (বহু ভাষায়, বাংলার সমর্থন বাড়ানো দরকার) এবং Duolingo ABC (ইংরেজি পড়া-লেখা শেখায়) শিশুদের জন্য ভালো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।