সেই প্রথম রাতগুলো… অন্ধকার ঘরে শুধু শিশুর কান্না আর এক তরুণী মায়ের নিরাশ চোখে জমানো অশ্রু। রেহানা আক্তার, গাজীপুরের বাসিন্দা, সদ্য মা হয়েছেন। কিন্তু তার নবজাতক মেয়েটি ঠিকমতো বুকের দুধ টানছে না। বারবার চেষ্টা, বারবার ব্যর্থতা। ক্লান্তি, হতাশা আর অপরাধবোধে তার মনে হচ্ছিল, সব মায়েরা যেন সহজেই এই কাজটি করতে পারছে, শুধু তিনিই পারছেন না। এই দৃশ্য, এই অনুভূতি – বাংলাদেশের কত হাজার মায়ের প্রতিদিনের লড়াই। শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু জানেন কি? এই সমস্যা একেবারেই সাধারণ, এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই সমাধানযোগ্য! শুধু দরকার সঠিক জ্ঞান, একটু ধৈর্য এবং কয়েকটি সহজ কৌশল। এই লেখাটি আপনাকে সেই যাত্রায় পথ দেখাবে, আপনার সেই অমূল্য মুহূর্তগুলোকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে তুলবে।
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান: কেন হয় এবং কীভাবে চিনবেন?
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান খোঁজার আগে জরুরি সমস্যাটা বোঝা। কেন আপনার আদরের সন্তানটি বুকের দুধ ঠিকমতো খেতে পারছে না? এর পেছনে থাকতে পারে নানান কারণ, শিশু বা মা – যেকোনো একপক্ষ বা উভয়পক্ষের থেকেই আসতে পারে।
শিশুর দিক থেকে সমস্যা:
- জন্মগত বা শারীরিক সমস্যা: জিভের নিচের ছোট থলে (Tongue-tie বা Ankyloglossia) থাকলে শিশুর জিভ স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করতে পারে না, দুধ টানতে সমস্যা হয়। তালুর গঠনগত সমস্যা (Cleft palate) বা নাক বন্ধ থাকাও বড় কারণ। বাংলাদেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, টাং-টাই একটি কমন কিন্তু প্রায়শই অনিচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষিত সমস্যা।
- দুর্বল বা অপরিণত শিশু: প্রি-ম্যাচিউর বেবি বা জন্মের সময় ওজন কম থাকলে শিশুর চুষার শক্তি কম থাকতে পারে। তারা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায় বা ঘুমিয়ে পড়ে।
- জন্ডিস বা অসুস্থতা: জন্ডিসে আক্রান্ত শিশুরা খুব বেশি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, খাওয়ার আগ্রহ হারায়। সর্দি-কাশি, কানে ইনফেকশন বা অন্য কোনো অসুখও খাওয়ানো কঠিন করে তোলে।
- নবজাতকের প্রাকৃতিক আচরণ: জন্মের পর প্রথম ২৪-৪৮ ঘন্টা অনেক শিশু খুব বেশি ঘুমায় বা খাওয়ার আগ্রহ কম দেখায়, যা স্বাভাবিক। আবার কিছু শিশুর ‘ক্লাস্টার ফিডিং’ (ঘনঘন খাওয়া) এর প্যাটার্ন থাকতে পারে, যা মায়েরা প্রায়ই সমস্যা ভেবে ভুল করেন।
- মায়ের দিক থেকে সমস্যা:
- দুধের প্রবাহ বা পরিমাণ নিয়ে সমস্যা: দুধের প্রবাহ খুব ধীর (Slow let-down) হলে শিশু ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। আবার প্রবাহ খুব তাড়াতাড়ি ও জোরে (Overactive let-down) হলে শিশু захлёбываться পারে বা চোকাতে পারে। অনেক মা মনে করেন তার পর্যাপ্ত দুধ নেই, যদিও বাস্তবে তা নাও হতে পারে (Perceived low milk supply)। সত্যিকারের দুধের অভাব (True low milk supply) তুলনামূলক কম ঘটে।
- বুকে ব্যথা বা সমস্যা: খুব টাইট বা ফ্ল্যাট নিপল (Flat or inverted nipples), ফাটা নিপল (Cracked nipples), মাস্টাইটিস (বুকে ইনফেকশন ও ব্যথা) বা ইঞ্জর্জমেন্ট (বুকে অতিরিক্ত দুধ জমে ফুলে যাওয়া ও শক্ত হয়ে যাওয়া) শিশুর খাওয়ানোকে যন্ত্রণাদায়ক ও কঠিন করে তোলে। ঢাকার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের ল্যাক্টেশন কনসালটেন্ট ডা. ফারহানা হক বলেন, “ফাটা নিপল প্রায়ই ভুল ল্যাচ-অনের (শিশুর মুখে স্তন ধরা) লক্ষণ। সঠিক পজিশন ও ল্যাচ শিখলে এ সমস্যা সহজেই কাটানো যায়।”
- মায়ের স্বাস্থ্য বা মানসিক অবস্থা: অতিরিক্ত ক্লান্তি, মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন দুধের প্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট ওষুধও প্রভাব ফেলতে পারে। থাইরয়েডের সমস্যা, গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা (Anemia) বা PCOD ইতিহাসও দুধ উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে।
- খাওয়ানোর পদ্ধতিগত ভুল: শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক পজিশন (Position) এবং ল্যাচ (Latch – শিশু কীভাবে স্তনবৃন্ত ও এর চারপাশের কালো অংশ মুখে নেয়) না জানা সবচেয়ে বড় বাধা। ভুল পজিশনে শিশু ঠিকমতো দুধ টানতে পারে না, আর মায়ের ব্যথা হয়।
কীভাবে বুঝবেন সমস্যা আছে?
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান প্রয়োজন কিনা তা বুঝতে এই লক্ষণগুলো খেয়াল করুন:
- শিশুর দিকে: বারবার খাওয়া শুরু করেও ছেড়ে দেওয়া, খাওয়ার সময় কান্না বা বিরক্তি, খাওয়ার পরেও তৃপ্ত না হওয়া, ওজন না বাড়া বা কমে যাওয়া (জন্মের পর প্রথম কয়েক দিন সামান্য ওজন কমা স্বাভাবিক, তারপর ধীরে ধীরে বাড়া উচিত), ২৪ ঘন্টায় ৬টির কম ভেজা ডায়াপার (প্রথম কয়েক দিন কম হতে পারে), গাঢ় হলুদ বা কমলা রঙের প্রস্রাব (স্বাভাবিক ফ্যাকাশে হলুদ হওয়া উচিত), ঘন ঘন কান্না ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা।
- মায়ের দিকে: বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় তীব্র ব্যথা অনুভব করা, নিপল ফাটা বা রক্ত পড়া, বারবার বুকে ব্যথা বা ইনফেকশন, শিশু খাওয়ানোর পরেও বুক ভারী বা শক্ত লাগা, শিশুকে খাওয়ানোর পরও হাত দিয়ে চাপ দিলে দুধ বের না হওয়া (এটি দুধের অভাবের নির্ভরযোগ্য লক্ষণ নয়)।
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান: প্রাকৃতিক ও কার্যকরী কৌশল
এবার আসুন সেই সমাধানগুলোর দিকে, যেগুলো অভিজ্ঞতা ও গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান এর মূল চাবিকাঠি ধৈর্য, অনুশীলন এবং সঠিক তথ্য।
সঠিক পজিশনিং ও ল্যাচিং: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ
এটিই সমস্যার ৮০% সমাধান করতে পারে! লক্ষ্য করুন:- মায়ের আরাম: মা আরামদায়ক ভাবে বসুন বা শুয়ে পড়ুন। পিঠ ও হাত সাপোর্ট দিন। কুশন ব্যবহার করুন (বিশেষ করে ক্রেডল হোল্ড বা ফুটবল হোল্ডে)।
- শিশুর অবস্থান: শিশুর পুরো শরীর মায়ের দিকে ফেরানো, পেট মায়ের পেটের সাথে লেগে থাকা। শিশুর মাথা, কাঁধ ও কোমর এক সরলরেখায় থাকা। শিশুর নাক স্তনের সমান্তরালে বা সামান্য নিচে থাকা।
- সঠিক ল্যাচ: শিশুকে তার নাক স্তনবৃন্তের সমান্তরালে এনে, তার নিচের ঠোঁট স্তনবৃন্তের নিচের দিক স্পর্শ করালে সে নিজ থেকেই মুখ হা করবে। দ্রুত সেই মুহূর্তে তাকে পুরো স্তনবৃন্ত এবং সম্ভব হলে এর চারপাশের গাঢ় অংশ (Arcola) যতটা সম্ভব মুখে নিতে সাহায্য করুন। লক্ষণীয়: শিশুর নিচের ঠোঁট বাইরের দিকে উল্টানো, মুখ পুরোপুরি খোলা, চোয়াল নড়াচড়া করা (কানের কাছে দেখুন), গিলতে শোনা যাওয়া (ছোট ‘ক’ শব্দ)। যদি শুধু স্তনবৃন্ত মুখে থাকে, তা হলে ব্যথা হবে এবং শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এই বুক ফিডিং পজিশনিং গাইড অত্যন্ত সহায়ক।
দুধের প্রবাহ ও সরবরাহ বৃদ্ধি
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান এর জন্য দুধের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা জরুরি।- ঘন ঘন ও কার্যকর ফিডিং: শিশুকে চাহিদামতো (On demand) খাওয়ান। প্রথম কয়েক সপ্তাহে সাধারণত ৮-১২ বার বা তারও বেশি প্রয়োজন হয়। দিনে ২-৩ ঘন্টা পর পর বা শিশু ক্ষুধার লক্ষণ দেখালেই খাওয়ান (মুখ খোলা, জিভ বের করা, হাত মুখে দেওয়া, কান্না – ক্ষুধার শেষ লক্ষণ)। প্রতিবার এক স্তন ভালোভাবে খালি করতে দিন (১৫-২০ মিনিট বা তার বেশি) তারপর অপরটি দিন। এতে ‘হিন্ডমিল্ক’ (পরবর্তীতে আসা চর্বি সমৃদ্ধ দুধ) পায় শিশু।
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও প্রচুর পানি: পুষ্টিকর, সুষম খাবার খান। প্রোটিন (ডাল, মাছ, মাংস, ডিম), শাকসবজি, ফল, গোটা শস্য রাখুন। প্রচুর পরিষ্কার পানি ও তরল (দুধ, স্যুপ, ঘরে বানানো ফলের রস) পান করুন। জিরা, মেথি, ওটস, পালং শাক, রসুন দুধ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বলে ধারণা করা হয়, তবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সীমিত। অতিরিক্ত চা-কফি ও কোমল পানীয় এড়িয়ে চলুন।
- রিল্যাক্সেশন ও বিশ্রাম: মানসিক চাপ দুধের প্রবাহ কমায়। যথাসম্ভব বিশ্রাম নিন। শিশু যখন ঘুমায়, আপনিও ঘুমানোর চেষ্টা করুন। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, হালকা গান শোনা বা ধ্যান চাপ কমাতে পারে।
- স্কিন টু স্কিন কন্ট্যাক্ট: শিশুকে শুধু ডায়াপার পরে আপনার খোলা বুকে শুইয়ে দিন। এই নিবিড় সংস্পর্শ অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ বাড়ায়, যা দুধের প্রবাহকে উদ্দীপিত করে এবং মা-শিশুর বন্ধন শক্তিশালী করে। ইউনিসেফের এই ভিডিওটি এর উপকারিতা বোঝায়।
- উভয় স্তন থেকে খাওয়ানো ও স্তন ম্যাসাজ: প্রতিবার খাওয়ানোর সময় উভয় স্তন থেকে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। খাওয়ানোর আগে ও খাওয়ানোর সময় হালকা হাতে স্তন ম্যাসাজ করলে (বুকে হাত রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাপ দিন, নিপলের দিকে) দুধের প্রবাহ সহজ হয়।
- পাম্পিং: যদি শিশু সরাসরি খেতে না পারে বা দুধের সরবরাহ বাড়াতে চান, একটি মানসম্মত ব্রেস্ট পাম্প ব্যবহার করুন। শিশু খাওয়ানোর পর বা খাওয়ানোর মধ্যবর্তী সময়ে পাম্প করুন। নিয়মিত পাম্পিং (প্রতিবার খাওয়ানোর পর ৫-১০ মিনিট) দুধ উৎপাদন সংকেত দেয়। ঢাকার অ্যাপোলো হসপিটালের পেডিয়াট্রিশিয়ান ডা. তাহমিদা আহমেদ পরামর্শ দেন, “যদি শিশুর ওজন বাড়াতে সমস্যা হয় বা মায়ের বুক খুব শক্ত হয়ে ব্যথা করে, তবে একজন ল্যাক্টেশন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। তারা পাম্পিং পদ্ধতি ও সময়সূচী ঠিক করতে সাহায্য করবেন।”
নির্দিষ্ট সমস্যার জন্য নির্দিষ্ট সমাধান
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান এর ক্ষেত্রে সমস্যা ভেদে কৌশল ভিন্ন হতে পারে।- টাং-টাই সন্দেহ হলে: শিশুর জিভের নিচে যদি টাইট থলে দেখা যায় বা জিভ বের করতে/উঁচু করতে সমস্যা হলে শিশু বিশেষজ্ঞ বা ল্যাক্টেশন কনসালটেন্ট দেখান। একটি সহজ ছোট সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া (Frenotomy) সমস্যার সমাধান করতে পারে।
- ব্যথা বা ফাটা নিপল: ল্যাচ ঠিক করুন! খাওয়ানোর পর সামান্য বুকের দুধ নিপলে লাগিয়ে শুকাতে দিন (প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক)। ল্যানোলিন ক্রিম (Lanolin cream) ব্যবহার করতে পারেন। নিপল শিল্ড (Nipple shield) ব্যবহার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ও সাময়িক সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়।
- ইঞ্জর্জমেন্ট (বুকে অতিরিক্ত দুধ জমে ফুলে যাওয়া): গরম সেঁক দিয়ে কিছু দুধ হাত দিয়ে বা পাম্প করে বের করুন যাতে শিশু সহজে ল্যাচ করতে পারে। খাওয়ানোর পর ঠান্ডা সেঁক দিন ব্যথা ও ফোলা কমাতে।
- মাস্টাইটিস (বুকে ইনফেকশন): জ্বর, ব্যথা, লালভাব ও কাঁপুনি হলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। অ্যান্টিবায়োটিক লাগতে পারে। বিশ্রাম নিন, প্রচুর পানি পান করুন, এবং নিয়মিত স্তন খালি করতে থাকুন (শিশু দিয়ে বা পাম্প করে)। বন্ধ করা যাবে না।
- ধীরে বা জোরে দুধের প্রবাহ: ধীর প্রবাহের জন্য: খাওয়ানোর আগে হালকা গরম সেঁক ও ম্যাসাজ। শান্ত পরিবেশে খাওয়ান। জোরালো প্রবাহের জন্য: খাওয়ানোর আগে কিছুক্ষণ পাম্প করে ‘ফোর মিল্ক’ বের করে নিন। শিশুকে আধাআধা বা শুইয়ে খাওয়ান যাতে অভিকর্ষের টান কম থাকে। শিশু захлёбываться শুরু করলে খালি করুন, শান্ত করুন, আবার খাওয়ান।
- অপরিণত বা দুর্বল শিশু: স্কিন টু স্কিন কন্ট্যাক্ট বেশি করে করুন। ঘন ঘন ছোট ছোট ফিড দেবার চেষ্টা করুন। বিশেষজ্ঞের সাহায্যে ‘সাপ্লিমেন্টারি নার্সিং সিস্টেম’ (SNS) বা কাপ ফিডিং শিখে নিতে পারেন যাতে শিশু শক্তি পায় এবং মায়ের দুধের সরবরাহও বাড়ে।
- কখন এবং কোথায় সাহায্য চাইবেন?
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান এর অনেক কিছুই ঘরে বসেই করা যায়। কিন্তু কিছু লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই সাহায্য নিন:- শিশুর ওজন জন্মের ২ সপ্তাহ পরেও জন্মকালীন ওজনে ফিরে না আসা বা তারপরও নিয়মিত ওজন না বাড়া।
- ২৪ ঘন্টায় ৬টির কম ভেজা ডায়াপার (৫-৬ দিন বয়সের পর)।
- শিশু সব সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন, জাগাতে খুব কষ্ট হয়।
- শিশুর প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বা কমলা এবং ঘন।
- শিশুর জ্বর বা অসুস্থতার লক্ষণ।
- মায়ের বুকে তীব্র ব্যথা, জ্বর, লাল দাগ, যা মাস্টাইটিসের লক্ষণ।
- নিপলে ফাটা দাগ খুব গভীর বা রক্ত পড়ছে।
- নিজের প্রচেষ্টায় ২-৩ দিনের মধ্যে উন্নতি না দেখা দিলে।
- মানসিকভাবে খুব ক্লান্ত, হতাশ বা উদ্বিগ্ন বোধ করলে।
সাহায্যের উৎস:
- প্রশিক্ষিত ল্যাক্টেশন কনসালটেন্ট (IBCLC – International Board Certified Lactation Consultant): বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ে সবচেয়ে যোগ্য বিশেষজ্ঞ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীর বড় হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে এঁদের সেবা পাওয়া যায়।
- শিশু বিশেষজ্ঞ (পেডিয়াট্রিশিয়ান): শিশুর স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি মূল্যায়ন করবেন এবং প্রয়োজনে ল্যাক্টেশন কনসালটেন্টের কাছে রেফার করবেন।
- গাইনি বিশেষজ্ঞ বা ধাত্রী: মায়ের শারীরিক সমস্যা মূল্যায়ন করবেন।
- বিআরএস (ব্রেস্টফিডিং সাপোর্ট) গ্রুপ: অনলাইন বা অফলাইনে অন্যান্য মায়েদের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, যেমন ফেসবুকের ‘ব্রেস্টফিডিং সাপোর্ট ফর বাংলাদেশি মামস’ এর মতো গ্রুপগুলো সহায়ক হতে পারে।
- জাতীয় ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ: তারা পরামর্শ ও রিসোর্স দিতে পারে।
- স্থানীয় কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র: অনেক সময় প্রাথমিক পরামর্শ দিতে পারেন।
সহায়ক পণ্য ও যত্ন
শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান এর পথে কিছু সহায়ক পণ্য কাজে লাগতে পারে:
- ব্রেস্ট পাম্প: ম্যানুয়াল বা ইলেকট্রিক। ভালো ব্র্যান্ড বেছে নিন (যেমন Medela, Spectra, Philips Avent)। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সাইজ ঠিক করুন।
- নার্সিং পিলো: সঠিক পজিশনে বসতে বা শুতে সাহায্য করে।
- ল্যানোলিন ক্রিম: ফাটা নিপলের যত্নে।
- নিপল শিল্ড: বিশেষজ্ঞের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং সাময়িকভাবে ব্যবহার করুন।
- ব্রেস্ট প্যাড: দুধ চুইয়ে পড়া রোধ করে।
- আরামদায়ক নার্সিং ব্রা ও পোশাক।
জেনে রাখুন (FAQs)
শিশু কতবার বুকের দুধ খাবে?
সাধারণত জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ৮-১২ বার বা তারও বেশি (প্রতি ১.৫-৩ ঘন্টা পর পর)। শিশুর নিজস্ব চাহিদা (ক্ষুধার লক্ষণ দেখানো) অনুযায়ী খাওয়ানোই ভালো, ঘড়ি ধরে নয়। শিশু বড় হলে ফিডিংয়ের ব্যবধান বাড়বে।আমার পর্যাপ্ত দুধ আছে কিনা কীভাবে বুঝব?
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লক্ষণ শিশুর ওজন বাড়া ও পর্যাপ্ত ভেজা/নোংরা ডায়াপার। জন্মের ৫-৬ দিন পর থেকে দিনে কমপক্ষে ৬টি ভেজা ডায়াপার (সাদা বা হালকা হলুদ প্রস্রাব) এবং ৩-৪টি হলুদ, নরম মল হওয়া উচিত। শিশু খাওয়ার পর শান্ত ও তৃপ্ত দেখালে এবং নিয়মিত ওজন বাড়লে দুধ যথেষ্ট আছে ধরে নেওয়া যায়।ফর্মুলা দুধ দিলে কি আমার বুকের দুধ কমে যাবে?
হ্যাঁ, সম্ভাবনা আছে। বুকের দুধ সরবরাহ চাহিদা ও সরবরাজের নীতিতে চলে। শিশু যত বেশি সরাসরি স্তন চুষবে বা মা যত নিয়মিত পাম্প করবেন, তত বেশি দুধ তৈরি হবে। ফর্মুলা দিলে শিশুর চাহিদা কমে, ফলে মায়ের শরীর কম দুধ তৈরি করবে। তাই বিশেষ প্রয়োজনে ফর্মুলা দিলেও নিয়মিত পাম্প করে দুধের সরবরাহ বজায় রাখার চেষ্টা করুন এবং শিশুকে যতটা সম্ভব বুকেই খাওয়ান।বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?
সাধারণত সব খাবারই পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যায়। তবে কিছু শিশু মায়ের খাওয়া নির্দিষ্ট খাবারে (যেমন: গরুর দুধ, ডিম, বাদাম, গম, ঝাল মসলা, কিছু শাকসবজি – বাঁধাকপি, ফুলকপি) সংবেদনশীলতা দেখাতে পারে (গ্যাস, পেট ব্যথা, র্যাশ, অতিরিক্ত কান্না)। সন্দেহ হলে সেই খাবার কয়েক সপ্তাহ বাদ দিন, লক্ষণ কমলে আবার চেষ্টা করে দেখুন। প্রচুর পানি পান ও সুষম খাবার খাওয়াই মূল কথা।কাজে ফিরে গেলে কীভাবে বুকের দুধ চালিয়ে যাব?
পরিকল্পনা করে নিন। কাজে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে দুধ জমা (Express and store) শুরু করুন। বাড়িতে যিনি শিশুর দেখাশোনা করবেন, তাকে কাপ বা চামচে করে দুধ খাওয়ানোর প্রশিক্ষণ দিন। অফিসে নিয়মিত বিরতিতে (প্রতি ৩-৪ ঘন্টা) পাম্প করুন। সংরক্ষিত দুধ ফ্রিজে (৪° সে.) ৪ দিন, ফ্রিজের ফ্রিজারে (-১৮° সে.) ৬ মাস পর্যন্ত রাখা যায়। ঘরের তাপমাত্রায় (২৫° সে.) ৪ ঘন্টা পর্যন্ত নিরাপদ।- শিশু কতদিন বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বাংলাদেশ সরকারের সুপারিশ হলো জন্মের ১ ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ শুরু করা, প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ (এমনকি পানিও নয়), এবং তারপর বুকের দুধের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিপূরক খাবার নিয়ে অন্তত ২ বছর বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়া।
মনে রাখবেন, আপনি একা নন। শিশুর বাচ্চার দুধ খাওয়ার সমস্যা সমাধান নিয়ে হাজার হাজার মা-ই সংগ্রাম করেন। এটি শেখার একটি প্রক্রিয়া, যার জন্য সময়, অনুশীলন এবং কখনও কখনও সাহায্যের প্রয়োজন হয়। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করুন। সঠিক তথ্য, সহায়ক পরিবেশ এবং প্রয়োজনমতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনি অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারবেন। আপনার এই লড়াই শুধু আপনার শিশুর জন্য সর্বোত্তম পুষ্টিই নিশ্চিত করবে না, বরং তার সাথে আপনার একটি অনন্য, অমূল্য বন্ধন গড়ে তুলবে। আজই একজন অভিজ্ঞ মা, স্বাস্থ্যকর্মী বা ল্যাক্টেশন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন – আপনার সুন্দর দুধ খাওয়ানোর যাত্রা শুরু হোক আত্মবিশ্বাসের সাথে!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।