আমাদের দেশে কৃষির জন্য শীতকাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। ধান, গম বা ভূট্টার মতো শর্করাকেন্দ্রিক প্রধান খাদ্যশস্যের পাশাপাশি হরেকরকম শাকসবজি জন্মে বছরের এ সময়ে। বাজার ভরে ওঠে সে সবে। বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, মুলা, শালগম, টমেটো, লাউ, শিম—কী নেই! শীতকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ে একসঙ্গে এত সবজি জন্মাতে দেখা যায় না। এ থেকেই প্রশ্ন আসে, শীতকালে এমন কী জাদু আছে? কেন শীতকালে এত বেশি সবজি জন্মায়?
মোটা দাগে এমন হওয়ার কারণ আবহাওয়ার প্রভাব, মাটির উর্বরতা এবং এসব উদ্ভিদের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য। বেশির ভাগ সবজিজাতীয় উদ্ভিদ চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ায় ঠিকভাবে জন্মাতে পারে না। গরমের সময় অতিরিক্ত তাপ বা অতিরিক্ত বৃষ্টি সবজিগাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ করে। প্রায় ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এসব উদ্ভিদ সবচেয়ে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের শীতকালের দিকে খেয়াল করলে দেখবেন, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে এখানে গড় তাপমাত্রা প্রায় সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ২৪ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। দিনের আলো পাওয়া যায় গড়ে সাড়ে ১০ থেকে ১২ ঘন্টার মতো। সবজিজাতীয় উদ্ভিদের জন্য এই তাপমাত্রা ও দিনের আলোর পরিমাণ গড়পড়তা হিসেবে একেবারে আশীর্বাদের মতো। এ ছাড়া শীতকালের দীর্ঘস্থায়ী কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাস উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া স্থিতিশীল রাখে, যা ফলন বাড়ায়।
শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য কিছুটা কমে যায়। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্যের আলো প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে এসে পড়ে। ফলে তীব্র আলোর পরিবর্তে আমরা মিষ্টি ও তুলনামূলক মৃদু একধরনের আলো পাই। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সহজ করে তোলে এই নরম আলো।
বলে রাখি, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সূর্যের আলো, পরিবেশের কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) ও মূলের মাধ্যমে গৃহীত পানির সমন্বয়ে খাদ্য উৎপাদন করে। সূর্যের তীব্র আলো অনেক সময় সবজির পাতা পুড়িয়ে ফেলে। এমনকি অতিরিক্ত রোদে মারা পড়ে সবজিগাছ। শীতকালে সেই আশংকা থাকে না। সব মিলে সালোকসংশ্লেষণ স্থিতিশীল থাকায় ফসলের বৃদ্ধিও হয় ভালো।
সবজিগাছের বেড়ে ওঠার জন্য কেবল আলো ঠিক থাকলেই হয় না। চাই পুষ্টিসমৃদ্ধ, সুনিয়ন্ত্রিত আর্দ্রতাযুক্ত মাটি। গ্রীষ্ম বা বছরের অন্যান্য সময় বৃষ্টিতে অনেক সময় মাটির উপরিভাগের পুষ্টিগুণ ধুয়ে যায়। মাটির গঠন নষ্ট হয়। আর্দ্রতাও ঠিক থাকে না। অন্যদিকে শীতকালে শিশির ও কুয়াশার কারণে মাটিতে আর্দ্রতার ভারসাম্য বজায় থাকে। ফলে উদ্ভিদের শেকড় খুব সহজেই মাটির গভীরে পৌঁছাতে পারে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে উদ্ভিদ ও ফসল ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
এসব ছাড়াও শীতকালে পোকামাকড়ের উপদ্রব কিছুটা কম থাকে। বেশির ভাগ কীটপতঙ্গ শীতল রক্তের প্রাণী। এরা নিজেদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই পরিবেশ ঠান্ডা থাকলে এরা খুব একটা বের হয় না। এ সুবিধাটা ভালোভাবেই কাজে লাগায় শীতের সবজি। ঠান্ডা পরিবেশে কৃষকও জমিতে কাজ করতে পারেন দীর্ঘক্ষণ। ফলে সবজির জন্য প্রয়োজনীয় বাড়তি যত্ন নেওয়া সম্ভব হয়। সব মিলে ফলন স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।
পুরো আলোচনার সারকথা দুটি। এক, বিভিন্ন সবজির জীবনচক্রের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন। শীতকালে প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশে এসব শর্ত পূরণ হয়। ফলে শাক-সবজি বেশি জন্মে। আর দুই, পোকামাকড়ের আক্রমণ কম ও কৃষকের যত্ন বেশি থাকায় ফলন অনেক ভালো হয়।
এবারে একটু ভিন্ন কথা বলে শেষ করা যাক। ২০২২ সালে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। বলাবাহুল্য, এ জন্য শীতকালীন পরিবেশের ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি কৃষকের পরিশ্রম ও সবজি চাষে আগ্রহের কথাও ভুললে চলবে না। আমাদের জন্য ভালো খবর হলো, কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে।
বাংলাদেশে শীতকালীন সবজির প্রাচুর্য শুধু দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, স্থানীয় কৃষকদের আয়েরও অন্যতম প্রধান উৎস। অনেকসময় বাজারজাতকরণে ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন না। এদিকটা ঠিক করা গেলে শীতের পরিবেশ কাজে লাগিয়ে আরও সবজি উৎপাদন করে রপ্তানিও করা সম্ভব বলে মনে করেন এ খাতের বিশেজ্ঞরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।