জুমবাংলা ডেস্ক : অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর ধীরে ধীরে কার্যক্রম শুরু হয় দেশের সব থানায়। আর থানার কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই একের পর এক মামলা হতে থাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে হত্যা, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার মামলা হয়েছে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, শেখ হাসিনাকে কি ভারত থেকে দেশে আনা যাবে? এ সংক্রান্ত প্রত্যর্পণ চুক্তিতেই বা কী আছে?
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠাতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ করা হতে পারে।
এ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত ১৫ আগস্ট বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অনেক মামলা হচ্ছে। এখন স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাঁকে দেশে ফেরত দিতে আমাদের পক্ষ থেকে ভারতকে অনুরোধ করা হবে।’
এটি ভারত সরকারের জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করবে বলেও মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ভারত এটি জানে এবং আমি নিশ্চিত, তারা এ বিষয়ের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবে।’
রয়টার্স জানিয়েছে, এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য চাওয়া হলে তারা তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী অনেক গোষ্ঠীর নেতা ও সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে রয়েছেন। এদিকে, বাংলাদেশের জেমএমবির অনেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে পালিয়ে থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এদেরকে নিজ দেশের সরকারের কাছে ফেরত পাঠানোর তাগিদেই বাংলাদেশ ও ভারত ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। দুই দেশের মধ্যে পলাতক বন্দিবিনিময় সহজ ও দ্রুত করতে ২০১৬ সালে এটি সংশোধনও করা হয়।
এই চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত সরকারের কাছে প্রত্যর্পণ করা হয় উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজনকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ সরকার। এমনকি ভারতও এমন কয়েকজন পলাতককে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।
কী আছে চুক্তিতে?
চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালত কর্তৃক ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ’ করার জন্য তাঁকে ফেরত চাওয়া হয়, তাহলে তাঁকে ফেরত দেওয়া হবে। ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ’ বলতে সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড হয়–এমন অপরাধকে বলা হয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক অপরাধও রয়েছে। তবে, কোনো অপরাধ ‘প্রত্যর্পণযোগ্য’ হওয়ার জন্য দ্বৈত অপরাধের নীতি অবশ্যই প্রযোজ্য হবে। এর মানে হলো, অপরাধটি অবশ্যই দুই দেশে শাস্তিযোগ্য হতে হবে।
এ ছাড়া প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের চেষ্টা, সহায়তা, প্ররোচনা বা অংশগ্রহণ করলেও এই অপরাধের সহযোগী হিসেবে ওই ব্যক্তিকে ফেরত দেওয়া যাবে।
প্রত্যর্পণ চুক্তিতে কি কোনো ছাড় আছে?
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, এই প্রত্যর্পণ চুক্তিতে ছাড় রয়েছে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তিকে ফেরত চাওয়া হবে তাঁর অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। তবে, এর মধ্যেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
কোন কোন অপরাধকে ‘রাজনৈতিক’ বলা যাবে না, সে তালিকাও বেশ দীর্ঘ। যেমন হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখা, গ্রেপ্তার এড়াতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার, জীবন বিপন্ন করার অভিপ্রায়ে সম্পত্তির ক্ষতি, অপহরণ বা জিম্মি, হত্যার প্ররোচনা এবং সন্ত্রাস সম্পর্কিত অন্য কোনো অপরাধ।
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ চুক্তি কী বলছে?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। তবে, যেসব অপরাধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এর কয়েকটি এই প্রত্যর্পণ চুক্তির ‘রাজনৈতিক অপরাধের’ সংজ্ঞায় নেই। এর মধ্যে হত্যা, গুম ও নির্যাতনের মামলা রয়েছে।
গত ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একজন মুদি দোকানিকে হত্যার মামলা করা হয়। ২০১৫ সালে একজন আইনজীবীকে অপহরণের অভিযোগে পরদিন তাঁর বিরুদ্ধে গুমের মামলা হয়। এরপর ১৫ আগস্ট তৃতীয় মামলায় হত্যা, নির্যাতন ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রত্যর্পণ চুক্তিতে ২০১৬ সালে যে সংশোধনী আনা হয় তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। ওই সংশোধনীতে বলা হয়, যে ব্যক্তিকে ফেরত চাওয়া হবে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রমাণাদিও লাগবে। এ জন্যই এই চুক্তিতে এখন আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার দরকার হয়।
ভারতকে কি শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতেই হবে?
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, এই প্রত্যর্পণ হবেই—চুক্তি অনুযায়ী এমন বলা যাচ্ছে না। ভারত চাইলে শেখ হাসিনাকে ফেরত নাও দিতে পারবে। কেননা চুক্তির আর্টিকেল ৮ বলছে, যার প্রত্যর্পণ চাওয়া হবে তাঁকে ‘বিচারের আওতায় নেওয়ার উদ্দেশ্য বিশ্বাসযোগ্য’ মনে না হলে এই প্রত্যর্পণ নাও করা যেতে পারে। তবে, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এমন করলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপোড়েনের আশঙ্কা রয়েছে।
শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইলে কী করবে ভারত?
বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করবে ভারত। বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কথা মাথায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেবে নয়াদিল্লি। একইসঙ্গে নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের বন্ধু ও মিত্র শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টিও মাথায় রাখবে তারা।
এ ব্যাপারে এই চুক্তির সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) সাবেক এক কর্মকর্তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যেই কি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ নিহিত? না, বিষয়টি এমন নয়। কেবল চুক্তির বৈধতা কোনো ব্যাপার না। উভয় পক্ষের আইনজীবী রয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে অনেক মানুষ রয়েছে যারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে যায়নি। তাদের শিকড় গভীরে। এরা আবার উঠে দাঁড়াবে। সেখানে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী রয়েছে যারা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে মূল্য দেয়। তাই আমাদের একটি শক্তিশালী পক্ষ রয়েছে যারা সুসম্পর্কের পক্ষে। তাছাড়া ভৌগোলিক বাস্তবতা রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতবেষ্টিত। দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট কাঠামোগত সংযোগ রয়েছে। এই সম্পর্কের দিকনির্দেশনা নিয়ে এখনো উপসংহারে আসা হয়নি।’
এ বিষয়ে আরও কয়েকজন ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তারা বলেন, কোনো দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে বন্দি বিনিময় করে না। এটা চুক্তি থাক বা না থাক। তবে যা কিছু হবে, তা রাজনৈতিকভাবে হবে।
‘গুলি করলে মরে একটা, বাকিডি যায় না’ বলা সেই ইকবাল ডিবি হেফাজতে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।