তানহা তাসনিম, বিবিসি নিউজ বাংলা : নিউক্লিয়াস পার্টি, জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আমজনতার দল, আ-আম জনতা পার্টি… গত আট মাসে এমন অন্তত ২৬টি নাম যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
গত বছরের পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে এসব রাজনৈতিক দল বা প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের দল এনসিপি ছাড়াও গত আটমাসে গণমাধ্যমে আসা রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা দুই ডজনেরও বেশি।
এরইমধ্যে নতুন দল আনার ঘোষণা দিয়েছেন চিত্রনায়ক ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নিয়ে কাজ করা ইলিয়াস কাঞ্চন।
আজ ২৫ এপ্রিল ‘জনতার পার্টি বাংলাদেশ’ নামের দলটি ঘোষণা করার কথা রয়েছে। তবে এত কম সময়ে এতগুলো দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দল গঠনের এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এমন নতুন নতুন দল গঠন করতে দেখা গেছে।
আর নির্বাচনকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। বলছেন, নির্বাচনের সময় এগোলে “ব্যাঙের ছাতার মতো এমন অনেক দল গজিয়ে ওঠে”।
তবে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশকে আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চার সাথে যুক্ত করা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেকক্ষেত্রেই তা স্বার্থ ও ক্ষমতাচর্চার একটি রূপ বলেই মত বিশ্লেষকদের।
একইসঙ্গে ভোটের সময় জোট-রাজনীতিও এই প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে বলেও মনে করেন অনেকে।
গত ১৭ই এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি, যার প্রধান ডেসটিনির মোহাম্মদ রফিকুল আমীন।
অর্থ পাচার ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের মামলায় ১২ বছর কারাভোগের পর গত ১৫ই জানুয়ারি জেল থেকে বের হওয়ার তিন মাসের মাথায় নতুন এই দল নিয়ে হাজির হন তিনি।
কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত মি. আমীনের হঠাৎ রাজনীতিতে নাম লেখানোর কারণ কী?
প্রশ্নের জবাবে বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকার কারণে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর অন্য অনেকে জেল থেকে ছাড়া পেলেও তিনি তা পাননি।
“যেদিন হাসিনা পালিয়ে গেল, পাঁচ তারিখ, ছয় তারিখ, সাত তারিখ, আট তারিখ, নয় তারিখ – এই কয়দিনে ঢাকা জেল খালি হয়ে গেছে। মানুষকে দিনরাত ছেড়ে দিছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত লোকের জামিন কীভাবে হলো? বলে, না জামিন হয়নিতো। এদের রাজনৈতিক বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে”, বলেন মি. আমীন।
“আমি তখন সুপার সাহেবের (জেল সুপার) কাছে দৌড়ায় গেলাম। আমিতো এত বছর আটকে আছি, আমাকে ছাড়েন। বললো, আপনিতো কোনো রাজনৈতিক দল করেন না। আপনি যদি অন্তত হরাকাতুল জিহাদও করতেন বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমও করতেন তাও আপনাকে আমি ছেড়ে দিতাম। মানে ওনারা রাজনৈতিক লেবেল থাকলে ছেড়ে দেবে”, বলেন তিনি।
মি. আমীন জানান, এই রাজনৈতিক মঞ্চকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তিনি তার “জুলুমের কথা তখন যে প্রশাসক থাকবে, যে রাষ্ট্রশাসন করবে তার কাছে” পৌঁছাবেন।
শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে ২০২৫’র ২৪শে এপ্রিল পর্যন্ত গত আটমাসে অন্তত ২২টি রাজনৈতিক দল ও ও চারটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশের খবর এসেছে গণমাধ্যমে।
যার মধ্যে গত বছর ১১টি আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আরও ১১টি দল গঠিত হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হয়েছে।
আত্মপ্রকাশ করা দলগুলোর মধ্যে আছে, নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি)।
রাজনীতিতে আসা নতুন দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনায় রয়েছে এনসিপি। দলটি এখনও নিবন্ধন পায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নামক যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে দলটি তৈরি হয়েছে, সেগুলোও বর্তমানে সচল আছে।
রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও এনসিপি’র গঠন থেকে বেরিয়ে আসা শিবিরের সাবেক নেতাদের নতুন সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ এরও এই মাসের মধ্যেই আত্মপ্রকাশের কথা রয়েছে।
ইনস্টাগ্রামে বিবিসি বাংলা ফলো করতে ক্লিক/ট্যাপ করুন এখানে
প্রায় নিয়মিতই নতুন নতুন এসব দল আর প্ল্যাটফর্ম গঠনের খবর শোনা গেলেও, এগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটা জানে?
এনিয়ে ঢাকার রাস্তায় কথা হয় ভ্যানচালক মোঃ হারুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে মনে করেন ১০ জনেও দল করন যায়। যার যার মতো খালি দল বানাইতাছে আর করতাছে। এগিলির কোনো ইস্টিমেট আছে? এগিলা দল আমরা ভ্যান গাড়িয়ালারাও বানাইতে পারি”।
“স্টুডেন্টদের সংগঠন বাদে ওইভাবে কোনো কিছু দেখা হয়নি”, বলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আসমা উল হুসনা সুপ্তি।
নতুন দলগুলোর নাম শোনা হয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে চাকুরীজীবী সালমা আক্তার বলেন, “আমি আমজনতা বলে বাংলাদেশের সবাইকেই বুঝি। কিন্তু এটা আবার দল? জানি না”।
চা বিক্রেতা জোছনা জানান, প্রায়ই সেখানে মিছিল দেখলেও কারা তা করছে সে বিষয়ে তার কিছু জানা নেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থাকলেও এগুলোর বেশিরভাগের নামই কেউ জানে না। তার ওপর অভ্যুত্থানের পর হিড়িক লেগেছে নতুন দল গঠনের।
মূলত ভোটের সময় জোট-রাজনীতির সঙ্গে এই প্রবণতার সংযোগ রয়েছে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে নির্বাচন এগিয়ে এলে এই ধরনের দল গঠনের তোড়জোড় দেখা যায়।
এনিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “এর আগেও আমরা দেখেছি যখন নির্বাচনের গন্ধ এসে নাকে লাগে, তখন হঠাৎ করেই এমন অনেক দল গজিয়ে ওঠে ব্যাঙের ছাতার মতো”।
এ ধরনের দল তৈরির প্রবণতা দেখা গিয়েছিল এরশাদের আমলেও।
“এরশাদের আমলে বড় দলগুলো এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনে সহযোগিতা করেনি বা করতে চায়নি, তখন এরশাদ দেখাতে চেয়েছিল যে দেশে প্রচুর রাজনৈতিক দল আছে। সুতরাং তারা নির্বাচনে এলেতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে”, বলেন তিনি।
সেসময় ১২০টার বেশি দল গঠন হয়েছিল বলে জানান মি. আহমদ। পরবর্তী সময়ে ৯০টা দল নিয়ে জোট করার নজির আছে উল্লেখ করে “এরা জাস্ট সংখ্যা” বলে মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।
একইসঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেও এসব দল তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এনিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে সবার মধ্যে যে রাজনীতি করলে খুব দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। রাজনীতি করলে খুব দ্রুত টাকাপয়সা কামানো যায়, আর ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানো যায়- এটা ভেতরের উদ্দেশ্য আর কি”।
এর বাইরে এসব দলের রাজনীতিতে কতটুকু আদর্শ থাকে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, “মূল যেটা সেটা হচ্ছে এটার পেছনে একটা রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় জড়িত আছে”।
তবে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস বলছে, অনেক দল এলেও তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই দিনশেষে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।