প্রায় ৭৪ বছরের বন্ধুত্ব তাঁদের। নাম শেলডন গ্ল্যাশো ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বন্ধুর একজনেরও ভর্তির আবেদন গ্রাহ্য হলো না। আবার কর্নেল, প্রিন্সটন এবং এমআইটির মতো তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চান্স পেলেন দুজনে। এবার স্টিভের বাবা তাঁদের দুজনকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখালেন। সব দেখেশুনে দুজনে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।
প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ সেখানে। বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ কেনেথ গ্রেইসেন যে কোর্সটি পড়ান, তা বেশ শক্ত। এই শিক্ষা নিতে গিয়ে আবার পদার্থবিদ্যা ও গণিতের বেশ কিছু অ্যাডভান্স কোর্স করতে হলো। অবশ্য এ নিয়ে তাঁদের কোনো আপত্তি ছিল না। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা মানে গণিত ও বিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষা। শেলডন গ্ল্যাশো থাকতেন ক্যাম্পাসের বাইরে কলেজ টাউনে, অন্যদিকে স্টিভের আস্তানাটি ছিল অনেকটা কাছে ‘টেলুরাইড হাউস’ নামের এক হোস্টেলে।
যথাসময়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হলো, এবার গবেষণা করতে হবে। এখানেও দুজনের আগ্রহের ক্ষেত্র একই—‘ইউনিফিকেশন অব ফোর্সেস’। অর্থাৎ বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক বলের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। এই মহাবিজ্ঞানী জীবনের শেষ কয়েক দশক এই গবেষণাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
তবে এবার দুজনে আলাদা প্রতিষ্ঠানে—গবেষণা করতে শেলডন এলেন হার্ভার্ডে আর স্টিভ গেলেন প্রিন্সটনে। অধ্যাপক জুলিয়ান শুইঙ্গারের অধীনে গবেষণার কাজ শুরু করলেন শেলডন। অধ্যাপকের ধারণা অনুযায়ী তড়িৎচৌম্বকত্ব এবং দুর্বল বলের নেপথ্যে আছে ইয়াং-মিলস গাউস বোসনের একটি ত্রয়ী (ট্রিপলেট)।
ছাত্রকে উৎসাহ দিতে প্রায়ই তিনি বলতেন—‘Go forth, young man, and unify!’ শুইঙ্গারের চ্যালেঞ্জের সমাধানে পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও নিজের থিসিস লিখে ফেললেন শেলডন গ্ল্যাশো। আর ১৯৫৮ সাল নাগাদ পেলেন পিএইচডি। অন্যদিকে স্টিভেন ওয়াইনবার্গও তত দিনে পিএইচডি লাভ করেছেন। অধ্যাপক স্যাম ট্রিম্যানের তত্ত্বাবধানে তীব্র এবং দুর্বল বলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রিনরমালাইজেশন তত্ত্বের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি।
পঞ্চাশের দশকেও গবেষণাক্ষেত্র হিসেবে কোপেনহেগেনের ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিকসের খুব নামডাক। বিশেষত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে। স্বয়ং নীলস বোর আছেন সেখানে। তাঁর আকর্ষণেই দেশ-বিদেশের তরুণ পদার্থবিদেরা গবেষণার জন্য পাড়ি জমান ডেনমার্কে। কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করার পর এক বছর গবেষণার কাজে কোপেনহেগেনে কাটিয়ে এসেছেন ওয়াইনবার্গ।
এবার পিএইচডি করে একই প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের জন্য পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে গেলেন গ্ল্যাশো। ১৯৬০ সাল নাগাদ সেখানেই গবেষণায় বড় সাফল্য পেলেন তিনি। নিউট্রাল কারেন্ট বা প্রশম তড়িতের অস্তিত্বের অনুমান করে তিনি দুর্বল তড়িৎ সংশ্লেষণের (Electroweak synthesis) জন্য প্রয়োজনীয় বীজগাণিতিক গঠনকাঠামোর সন্ধান দিলেন। পিএইচডি সুপারভাইজার শুইঙ্গারের চ্যালেঞ্জ যেন এবার অনেকটা মেটাতে পারলেন গ্ল্যাশো। তবে শুইঙ্গারের ধারণা অনুযায়ী তিনটির পরিবর্তে এখানে চারটি মধ্যস্থতাকারী প্রয়োজন।
মডেলটি কিন্তু এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো না, বরং তিনটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেল। প্রশ্নগুলো হলো—দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীরা কীভাবে তাদের ভর অর্জন করে? লেপটনের মতো পারমাণবিক কণাগুলোকেও কি মডেলটির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়? তা ছাড়া তত্ত্বটি কি রিনরমালাইজেবল? (রিনরমালাইজেশন হলো কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব, পরিসংখ্যান বলবিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানের কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিশেষ গাণিতিক পদ্ধতি।) আর তাই গাণিতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ? তবে তখন পর্যন্ত কোন পদার্থবিদ (এমনকি গ্ল্যাশো নিজেও) মডেলটি সিরিয়াসলি নেননি।
এদিকে কলাম্বিয়া ও বার্কলিতে পোস্টডক্টরাল গবেষণার কাজ শেষ করে ওয়াইনবার্গ তত দিনে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছেন। আর গ্ল্যাশো গবেষণা করছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। এখানে তাঁর তৃতীয় পোস্টডক্টরাল গবেষণার কাজ চলছিল। এর ঠিক ছয় বছর পর দেখা গেল, বার্কলিতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন ওয়াইনবার্গ ও গ্ল্যাশো। আবার কর্মস্থল বদল হলো দুই বন্ধুর।
স্টিভ চলে গেলেন এমআইটিতে আর গ্ল্যাশো হার্ভার্ডে। ষাটের দশকে দুজন একসঙ্গে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ‘মডেল অব লেপটনস’ (Model of Leptons) শিরোনামে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধ। এতে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত পিটার হিগস এবং অন্য গবেষকদের আবিষ্কৃত গাউস তত্ত্বের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙনের সুন্দর প্রয়োগ করেন তিনি।
ভরহীন গাউস বোসন কী করে ভর লাভ করে, সেই ক্রিয়াকৌশল প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন হিগস, ফ্রাসোঁয়া অয়েংলার এবং অন্য সমসাময়িক গবেষকেরা। এই ক্রিয়াকৌশল গ্ল্যাশোর দুর্বল তড়িৎসংক্রান্ত মডেলে সফলভাবে প্রয়োগ করেন ওয়াইনবার্গ। হিগস বোসন সেখানে তিনটি মধ্যস্থতাকারী কণা এবং আধানযুক্ত লেপটনগুলোতে ভরের জোগান দিচ্ছে। অর্থাৎ গ্ল্যাশোর মডেলের নিরিখে উত্থাপিত প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন স্টিভেন ওয়াইনবার্গ।
আজ পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি গবেষক নিজেদের লেখায় প্রবন্ধটির উল্লেখ করেছেন। বিজ্ঞান লেখকেরা মনে করেন, কণাপদার্থবিজ্ঞানীদের সাধের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ধারণার বীজ নিহিত ছিল ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স জার্নাল-এ প্রকাশিত মাত্র তিন পৃষ্ঠার সেই গবেষণা প্রবন্ধে।
এ গবেষণার নিরিখে উচ্চশক্তি–সম্পর্কিত কণাপদার্থবিজ্ঞান গবেষণা নতুন মোড় নেয়। হ্যাড্রন–জাতীয় কণার (নিউট্রন ও প্রোটনের মতো নিউক্লীয় কণা এবং পায়ন বা কাউঅনের মতো তীব্র বলের জন্য কার্যকর অন্যান্য কণা) উপাদান হিসেবে কোয়ার্কের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় বিজ্ঞানী সমাজ।
১৯৬৯ সালের অন্তিমলগ্নে জন ইলিওপুলাস, লুসিয়ানো মিয়ানি, শেলডন গ্ল্যাশো—এ তিন গবেষক একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী আগে অনুমান করা চতুর্থ তথা চার্ম কোয়ার্কের অস্তিত্ব ইলেকট্রোউইক মডেলের সম্প্রসারণকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, যেখানে সব পরিচিত প্রাথমিক কণা অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এটি ‘গ্ল্যাশো-ইলিওপুলাস-মিয়ানি মেকানিজম’ নামে পরিচিতি পায়। ফলে গ্ল্যাশোর প্রস্তাবিত মডেলের দ্বিতীয় প্রশ্নটির সমাধানও পাওয়া গেল।
তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেল ১৯৭১ সালে জেরার্ড টি হুফ্টের গবেষণায়। তত দিনে ইলেকট্রোউইক মডেল (ওয়াইনবার্গ-সালাম মডেল) বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রশংসনীয় তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষায় এই তত্ত্বের সত্যতা যাচাই হয়ে গেল। ১৯৭৩ সালে নিউট্রাল কারেন্ট বা প্রশম তড়িতের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়, পরের বছরই চার্ম কোয়ার্ক আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৭৭ সালে ‘ন্যাচারাল কনজারভেশন লজ ফর নিউট্রাল কারেন্টস’ (Natural conservation laws for neutral currents) শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন দুই বন্ধু।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।