ওমর ফারুক হিমেল: দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমবাজার সুরক্ষায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস।
শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম দেশটির শ্রম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে।
করোনা পরিস্থিতিতে দেশটিতে প্রবেশে বাংলাদেশিদের ওপর দ্বিতীয়বারের মতো ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ২৩ এপ্রিল কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে রাষ্ট্রদূত অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ১১০০ জন বাংলাদেশির সিসিভিআই ইস্যু হয়েছে তাদেরকে যেন কোরিয়া প্রবেশে সুযোগ দেয়া হয়। একই সাথে ছুটিতে এসে যে ১৩২ জন স্পেশাল কর্মী কোরিয়া প্রবেশ করতে পারেনি তাদেরকেও যেন কোরিয়া প্রবেশে সুযোগ দেয়া হয়।
বৈঠকে দ্রুততম সময়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান আবিদা ইসলাম।
ইপিএস কর্মী মাসুদ রানা বলেন, সম্প্রতি কোরিয়ায় এসে যে সব বাংলাদেশি করোনা শনাক্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী এবং অন্য ক্যাটাগরির ভিসার লোক। কিন্তু ভিসা নিষেধাজ্ঞার পুরো প্রভাব পড়ছে ইপিএসের ওপর।
তিনি সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে বাংলাদেশের ইপিএসকে ধ্বংশের হাত থেকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান।
দক্ষিণ কোরিয়া নানা শিল্প কলকারখানায় কর্মরত আছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি।।
করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর ২৩ জুন প্রথমবার বাংলাদেশিদের ওপর কোরিয়ার ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস তা প্রত্যাহারের বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের সাথে যোগাযোগ শুরু করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ফোনালাপকালে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর আরোপিত এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বিশেষ অনুরোধ জানান।
এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জেন কিউনের সাথে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের তাগিদ দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পুনরাবৃত্তি এড়াতে দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্য যেকোনো দেশে ভ্রমণেচ্ছু বাংলাদেশি নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট সকলকে স্বাস্থ্য ও ভ্রমনবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার মাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণ করার অনুরোধ জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কোরিয়ায় যখন করোনার প্রভাব বাড়তে থাকে তখন নানা সমস্যার কারণে অনেকেই ছুটিতে করোনার ভয়ে পালিয়ে গিয়ে নিজ দেশে আটকে পড়েন। তাদের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সে সময় দেশে আটকেপড়াদের ফেরাতে কোরিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ও বাংলাদেশ দূতাবাস ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালান।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাস থেকে দ্বিতীয় নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন ইপিএস কর্মী কোরিয়ায় ফিরতে সমর্থ হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বোয়েসেল ও সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় ইপিএস কর্মীরা কোরিয়ায় আসতে সমর্থ হয়। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত রি-এন্ট্রির সুযোগ প্রাপ্ত কমিটেড কর্মীদের দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূত কোরিয়ার সংশ্লিষ্ট দফতরে বার বার বৈঠক করেন। একই সাথে কূটনৈতিক চিঠি দিয়ে সর্বাত্মক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন ।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, প্রথম নিষেধাজ্ঞার পর কোরিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি ঢাকাকে অবহিত করেন রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলে ঢাকাকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সেসময় রাষ্ট্রদূতের সুপারিশের সাথে সবাই একমত হয়েছিলেন।
কোরিয়ার শ্রমবাজার ধরে রাখতে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামের প্রচেষ্টার সারাংশ উঠে এসেছে গত ১২ এপ্রিলের আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দফতর বা সংস্থা রাষ্ট্রদূতের সুপারিশ আমলে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে দ্বিতীয়বার ভিসা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হতো না।
১২ এপ্রিলের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সংক্রান্ত কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সেটা তাৎক্ষনিকভাবে জানানোর তাগিদ অনুভব করেনি মন্ত্রণালয় কিংবা বোয়েসেল।
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চারদিন পর ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি যাত্রীদের জন্য করোনা প্রতিরোধে তাদের কিছু ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে-
(ক) প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ও বোয়েসেল-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়াগামী যাত্রীকে কোভিড টেস্ট সম্পন্ন করে ৭ দিনের বাধ্যতামূলক সঙ্গনিরোধ সম্পন্ন করতে হবে।
(খ) সাতদিনের সঙ্গনিরোধ থাকা অবস্থায় কোভিড টেস্ট শতভাগ নিশ্চয়তার স্বার্থে কোরিয়ান কিট দ্বারা সরকার অনুমোদিত একটি সুনির্দিষ্ট কোভিড সেন্টার থেকে টেস্ট শেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় গমন নিশ্চিত করতে হবে।
(গ) সকল যাত্রীদের ট্রাভেল বিমার ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
(ঘ) এইচআরডি কোরিয়ার চাহিদা মোতাবেক বিশেষ ফ্লাইটে ইপিএস কর্মী প্রেরণ নিশ্চিত করতে হবে।
(ঙ) ইপিএস কর্মী ছাড়া যারা দক্ষিণ কোরিয়া গমন করবে তাদের তথ্য কোরিয়ান দূতাবাস ঢাকা কর্তৃক বোয়েসেলকে সরবরাহ করতে হবে।
(চ) সঙ্গনিরোধ-এর পূর্বে কোভিড টেস্ট, সঙ্গনিরোধ এবং সঙ্গনিরোধ পরবর্তী কোভিড টেস্ট এর যাবতীয় ব্যয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বহন করবে। এ বিষয়ে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও দেশে কোয়ারেন্টাইনে রেখে কর্মীদের পাঠানো উচিত। একই সঙ্গে কোরিয়া সরকারের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট থাকা জরুরি। আগে থেকে সংশ্লিষ্ট দফতর ও সংস্থা সতর্ক হলে দ্বিতীয় নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যেত।
সিউলের একটি বিশ্বস্থ সূত্র থেকে জানা যায়, গত ১৬ এপ্রিল দ্বিতীয় নিষেধাজ্ঞার পরে কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিতে ২৩ এপ্রিল অনুরোধ জানান রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম।
সূত্রটি জানান, বিশ্ব কোভিড পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে কোরিয়ার সংশ্লিষ্ট দফতর। বাংলাদেশের কোভিড পরিস্থিতি উন্নতি হলে নিষেধাজ্ঞা উঠানো হবে।
কোরিয়ার আরেকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া নিষেধাজ্ঞা উঠানোর বিষয়টি কোরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শের উপর নির্ভর করছে।
উল্লেখ্য, ভিসা নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বিশেষ ফ্লাইটে গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ থেকে কোরিয়ায় আগত যাত্রীদের মধ্যে প্রতিদিন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে। দূর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে- বাংলাদেশ থেকে এইভাবে করোনা রোগী শনাক্ত হলে সহসা ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাতিল করবে না দেশটির সরকার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।