ঢাকার ধানমন্ডিতে বসে রিমা আক্তার তার চোদ্দো বছরের মেয়ে তানজিমার দিকে তাকিয়ে হতবাক। কয়েক মাস আগেও যে মেয়েটি স্কুলের গল্পে মুখর থাকত, এখন সে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে ডুবে থাকে। একবার জিজ্ঞেস করতেই ফুটে উঠল তীব্র রাগ – “আমাকে একটু স্পেস দাও না!” রিমার বুকটা ধক করে উঠল। এ কী করে হল? কোথায় হারিয়ে গেল সেই কচি মেয়েটি? রিমার মতো লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী অভিভাবকের হৃদয়ে আজ একটাই প্রশ্ন – বয়ঃসন্ধির এই ঘূর্ণাবর্তে সন্তানকে বুঝবো কিভাবে? উত্তরটা অবাক করার মতো সরল, অথচ অবহেলিত: সন্তানদের সঙ্গে কথোপকথন। শুধু কথা বলা নয়, এক শুনে নেওয়া, বোঝার প্রয়াস, আস্থার সেতুবন্ধন। বাংলাদেশে ইউনিসেফের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন বলছে, ১০-১৯ বছর বয়সী ৭৮% কিশোর-কিশোরী মনে করে তাদের কথা পরিবারে গুরুত্ব পায় না। এই নীরবতা ভাঙাটাই প্রথম পদক্ষেপ।
বয়ঃসন্ধি কেন এত জটিল? মনোবিদের চোখে সমস্যার শিকড়
বয়ঃসন্ধি শুধু শারীরিক পরিবর্তনের কাল নয়, এ এক মানসিক ভূমিকম্পের সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মেহেরুন নাহারের মতে, “কৈশোরে মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (যা যুক্তি ও সিদ্ধান্ত নেয়) পুরোপুরি বিকশিত হয় না, অন্যদিকে আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অ্যামিগডালা অতিসক্রিয় থাকে। ফলে ছোট ঘটনাও তাদের কাছে বিপর্যয় মনে হয়।”
বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীদের মুখ্য চ্যালেঞ্জগুলো:
- ডিজিটাল বিশ্বের দ্বন্দ্ব: সোশ্যাল মিডিয়ার অস্বাস্থ্যকর তুলনা, সাইবার বুলিং। PPD-এর সমীক্ষা (২০২৪) বলছে, ৬৫% কিশোরী নিজের দেহ নিয়ে অসন্তুষ্ট।
- পড়াশোনার চাপ: পাবলিক পরীক্ষা, কোচিং, প্রতিযোগিতার চাপে মানসিক অবসাদ বাড়ছে।
- অভিভাবক-সন্তান দূরত্ব: “বড় হয়ে নিজে বুঝবে” – এই পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি আস্থার সম্পর্ক তৈরিতে বাধা।
- সাংস্কৃতিক বাধা: অনেক পরিবারে আবেগ, ভালোবাসা বা যৌন শিক্ষা নিয়ে খোলামেলা কথোপকথন ‘লজ্জার’ বিষয়।
“বয়ঃসন্ধির সংকটে ওষুধ নয়, প্রথম চিকিৎসা হলো অভিভাবকের কান ও মন খোলা রাখা,” – ডা. ফারহানা মোহসিন, কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সন্তানদের সঙ্গে কথোপকথন গড়ে তোলার বিজ্ঞানসম্মত ৭ কৌশল
১. ‘ফিক্সড টাইম’ নয়, ‘ফ্লেক্সিবল মুহূর্ত’ খুঁজুন:
- স্কুল থেকে ফেরার পথে গাড়িতে, রাতের খাবারের টেবিলে, চায়ের পেয়ালা হাতে – আনুষ্ঠানিক আলোচনার চেয়ে প্রাকৃতিক মুহূর্তে কথা বলা বেশি কার্যকর।
- বাস্তব উদাহরণ: রাজশাহীর রিয়াজ সাহেব সপ্তাহে তিন দিন মেয়ের সাথে বিকেলে হাঁটতে যান। সেই হাঁটার পথেই তার মেয়ে স্কুলের গল্প, বন্ধুদের সমস্যা শেয়ার করে।
২. বক্তা নয়, শ্রোতা হোন:
- “শোনার সময়” সত্যিই শুনুন। ফোন দেখবেন না, বিরক্ত ভাব দেখাবেন না।
- ব্যবহার করুন: “ওহ!” “তারপর কি হল?” “বলো, শুনছি।” – এমন স্বীকৃতিমূলক শব্দ।
- নিজের অভিজ্ঞতা: “আমার কৈশোরে একবার এমন হয়েছিল…” বলে নিজের ভুলের কথা শেয়ার করলে সন্তানও নিজের কথা বলতে উৎসাহিত হয়।
৩. সমস্যার সমাধান নয়, অনুভূতির স্বীকৃতি দিন:
- ভুল পদ্ধতি: “এত ছোট বিষয়ে এত রাগ কেন? মন খারাপ করলে পড়াশোনা হবে না!”
- সঠিক পদ্ধতি: “বুঝতে পারছি, বন্ধুটা এমন বলায় তোমার খুব খারাপ লেগেছে। কেউ এমন বললে আমারও খুব রাগ হতো।”
- মনস্তত্ত্ব: অনুভূতি যাচাই (Validation) করলে সন্তান নিজেই সমাধানের পথ খুঁজে পায়।
৪. জিজ্ঞাসাবাদ নয়, কৌতূহলী প্রশ্ন:
- এড়িয়ে চলুন: “কেন তুমি এমন করলে?” “কে তোমাকে উসকানি দিল?” (দোষারোপের সুর)
- ব্যবহার করুন: “কি কারণে তুমি এই সিদ্ধান্তটি নিলে বলো তো?” “এ বিষয়ে তোমার নিজের মতামত কি?” (গবেষণামূলক সুর)
৫. সীমা নির্ধারণে আলোচনা:
- কৈশোরকালে স্বাধীনতার চাহিদা স্বাভাবিক। কথোপকথনের মাধ্যমেই বোঝান: “স্বাধীনতা মানে দায়িত্বহীনতা নয়।”
- কৌশল: সন্তানের সাথে আলোচনা করে মোবাইল ব্যবহারের সময়, বাইরে বেরোনোর নিয়ম ঠিক করুন। চুক্তিতে লিখে সই করানো যায়।
৬. আপনার ভুল স্বীকারে পিছপা হবেন না:
- রাগের মাথায় কটু কথা বলে ফেললে, পরে শান্ত হয়ে বলুন: “আমি রেগে গিয়ে যা বলেছি, সেজন্য আমি দুঃখিত। তুমি কেমন অনুভব করছ?”
৭. ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে যোগাযোগের নতুন পথ:
- সন্তান যদি মুখে মুখে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে, মেসেজে বা নোটের মাধ্যমে শুরু করুন। লিখতে লিখতে ধীরে ধীরে খোলামেলা হবে।
বাস্তব সমস্যা, বাস্তব সমাধান: কথোপকথনে কিভাবে মোকাবিলা করবেন
সমস্যা: সন্তান সব কথা গোপন করে
- কারণ: ভয় (শাস্তি, অপমান), বিশ্বাসের অভাব।
- সমাধান: ছোটবেলা থেকেই তার ছোট ছোট গল্প গুরুত্ব দিয়ে শুনুন। গোপন কথা ফাঁস করবেন না।
সমস্যা: সহজেই রেগে যায়, কথা শোনে না
- কারণ: হরমোনের ওঠানামা, নিজেকে বুঝতে না পারা।
- সমাধান: রাগের মুহূর্তে তর্ক না করে বলুন: “তোমার এখন একটু সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আমরা পরে কথা বলব।” শান্ত হলে আলোচনা করুন।
সমস্যা: পড়াশোনায় অমনোযোগ, মোবাইলে আসক্তি
- কারণ: অ্যাটেনশন স্প্যান কমে যাওয়া, ডোপামিনের তাড়না।
- সমাধান: জবরদস্তি নয়, কথোপকথন। জিজ্ঞাসা করুন: “কি কারণে মনোযোগ দিতে কষ্ট হচ্ছে?” “মোবাইল ছাড়া সময় কাটাতে কি কি উপায় ভাবছ?”
সমস্যা: দৈহিক পরিবর্তন নিয়ে সংকোচ বা ভীতি
- কারণ: অপর্যাপ্ত জ্ঞান, ভুল তথ্য।
- সমাধান: প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে খোলামেলা আলোচনা করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) বাংলা রিসোর্স দেখতে পারেন।
কখন পেশাদার সাহায্য নেবেন? এই লক্ষণগুলো সতর্ক করবে
সন্তানদের সঙ্গে কথোপকথন সর্বদা যথেষ্ট নাও হতে পারে। মনোবিদের শরণাপন্ন হোন যদি দেখেন:
- খাওয়া-ঘুমের অভ্যাসে আকস্মিক বড় পরিবর্তন (খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া বা অতিরিক্ত খাওয়া)।
- স্কুল বা বন্ধুদের থেকে একেবারে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া।
- আত্মঘাতী কথা বলা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেওয়া (“বাঁচতে ভালো লাগে না”)।
- একেবারে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, পড়াশোনায় মারাত্মক অবনতি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (NIMH), ঢাকা এবং সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সেন্টার (PCC) -এ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ পাওয়া যায়।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. সন্তান আমার কথা শুনতে চায় না, কিভাবে শুরু করব কথা?
প্রচণ্ড জেদ বা রাগের মুহূর্তে জোর করবেন না। শান্ত পরিবেশে, তার পছন্দের বিষয় (খেলা, গান, সিনেমা) দিয়ে আলাপ শুরু করুন। নিজের সাধারণ দিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে সে-ও উৎসাহিত হতে পারে।
২. আমার সন্তান মোবাইলে বেশি সময় দেয়, কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করব?
জবরদস্তি নয়, আলোচনায় বসুন। মোবাইলের নেতিবাচক দিকগুলো যুক্তি দিয়ে বোঝান। পরিবারের সবার জন্য “ডিজিটাল ডিটক্স” সময় ঠিক করুন (যেমন রাতের খাবার বা সন্ধ্যায় ১ ঘণ্টা)। বিকল্প হিসাবে বাইরে ঘুরতে যাওয়া, গেম খেলা বা রান্না করা যায়।
৩. বয়ঃসন্ধিকালীন সন্তানের সাথে কতটা গোপনীয়তা জরুরি?
গোপনীয়তা মানে উদাসীনতা নয়। তার ব্যক্তিগত জিনিস (ডায়েরি, ফোন) নাড়াচাড়া করবেন না। তবে স্পষ্ট বলুন: “আমি তোমার স্পেস রেসপেক্ট করব, কিন্তু যদি কোনো বিপদ বা ভয়ের ব্যাপার থাকে, অবশ্যই জানাবে। আমরা একসাথে সমাধান করব।”
৪. সন্তান ভুল পথে যাচ্ছে মনে হলে কিভাবে কথা বলব?
ভর্ৎসনা বা ভয় দেখানো বিপদ বাড়াবে। শান্তভাবে আপনার চিন্তার কথা জানান। জিজ্ঞাসা করুন: “এই সিদ্ধান্তের ফলে কি কি হতে পারে বলে তুমি ভাবছ?” “আমার কি কোন সাহায্য দরকার?” তার যুক্তি শুনুন, তারপর নিজের মত দিন।
৫. ছেলে ও মেয়ে সন্তানের সাথে আলাপের পদ্ধতিতে পার্থক্য আছে কি?
মৌলিক নীতিগুলো এক (শোনা, সম্মান করা)। তবে মেয়েরা অনেক সময় আবেগপ্রবণ বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ছেলেরা প্রায়শই কার্যকলাপ-ভিত্তিক কথোপকথনে (খেলাধুলা, প্রজেক্ট) আরাম পায়। সন্তানের ব্যক্তিত্বকেই অগ্রাধিকার দিন।
কথোপকথন শুধু শব্দের আদান-প্রদান নয়, এ এক জীবন্ত সেতু – যে সেতু পার হয়ে কৈশোরের ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া সন্তান আবার ফিরে পায় আপনাকে, আর আপনি খুঁজে পান সেই কচি হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটিকে। বয়ঃসন্ধির এই সংকটময় পথে সন্তানদের সঙ্গে কথোপকথনই আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। আজই একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করুন: “আজকে তোমার দিনটা কেমন কাটল?” শুনুন। সত্যিই শুনুন। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে এই শোনার সংস্কৃতি গড়ে উঠুক – যেখানে কৈশোরের কণ্ঠস্বর কখনোই নিঃসঙ্গ বোধ করবে না।
> আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন নিচে! কোন কৌশল আপনার জন্য কাজ করেছে? অন্য অভিভাবকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।