বৃষ্টিস্নাত কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। মাটির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো টিনের ঘর। ভাঙা চৌকিতে বসে এক কিশোরী, সামনে মোমবাতির আলোয় জ্বলজ্বল করছে NCERT-র পদার্থবিজ্ঞানের বই। রাতের নিস্তব্ধতায় শোনা যায় মায়ের কাশির শব্দ আর বাবার উদ্বেগভরা দীর্ঘশ্বাস। এই পরিবেশে যেকোনো স্বপ্নই যেন অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু নজরানা আক্তার জানতেন—বিজয়ের পথে বাধাই তো প্রথম ধাপ। আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেই মেধাবী শিক্ষার্থীর অসাধারণ সাফল্যের গল্প শুধু পরিসংখ্যান নয়, লাখো শিক্ষার্থীর হৃদয়ে জ্বলন্ত মশাল।
অসাধারণ সাফল্যের গল্প: ধুলোমাটি আর স্বপ্নের মিশেলে এক জীবনসংগ্রাম
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাচারীডাঙ্গা গ্রাম। এখানে বিদ্যুতের লাইন পৌঁছেছে মাত্র পাঁচ বছর আগে। নজরানার বাবা রিকশা চালাতেন, মা বর্গাচাষে কাজ করতেন। পরিবারের আয় দিনে ২০০ টাকার বেশি নয়। স্কুলের ফি জোগাড় করতে গিয়ে বাবাকে প্রায়ই ধার-কর্জ করতে হতো। ২০১৫ সালের বন্যায় যখন তাদের মাটির ঘর ভেসে যায়, নজরানা বই-খাতা বাঁচাতে ছুটেছিলেন পানির স্রোতের বিরুদ্ধে। সেই মুহূর্তেই তিনি শপথ নিয়েছিলেন: “আমি ডাক্তার হবই—এ গ্রামের প্রথম মেয়ে ডাক্তার”।
গ্রামের লোকজন বলত, “মেয়ে মানুষ এত পড়াশোনা করে কী হবে?” নজরানা প্রতিদিন সাইকেলে চেপে পাড়ি দিতেন ১২ কিলোমিটার পথ। বর্ষায় যখন রাস্তা ডুবে যেত, নাকের ওপর বই রেখে সাঁতরে পার হতেন বন্যার পানি। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে স্থানীয় এক যুবক তাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, “তোর মতো মেয়েরা ডাক্তারি পড়বে? চুলার ধোঁয়ায় চোখ লাল করে রাখ!” নজরানা সে দিন রাতে ডায়েরিতে লিখেছিলেন: “তারা আমার স্বপ্ন দেখতে পায় না, কারণ তাদের চোখে আঁধার”।
সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল তার কাছে স্পষ্ট:
- ভোর ৪টায় উঠে পড়া—কারণ দিনের বেলা ঘরের কাজ করতে হতো
- বর্জ্য কাগজে নোট তৈরি—নতুন খাতা কেনার সামর্থ্য ছিল না
- গাছের ডাল দিয়ে মাটিতে ডায়াগ্রাম আঁকা—জ্যামিতি শেখার উপায়
- স্থানীয় লাইব্রেরির সদস্য হওয়া—মাসিক ১০ টাকার বিনিময়ে
২০১৮ সালে যখন জেএসসি পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হন, তখন জেলা প্রশাসক তাকে নিজ হাতে ২০ হাজার টাকার চেক দেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি কিনেছিলেন প্রথম সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর। স্থানীয় পত্রিকা “কুড়িগ্রামের আলো” লিখেছিল: “মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে যে মেয়ে আকাশ ছুঁতে চায়”।
দারিদ্র্যের অন্ধকারে জ্ঞানের আলো খুঁজে নেওয়ার অদম্য যাত্রা
এসএসসি পরীক্ষার আগের রাত। নজরানার বাবা হাসপাতালে—ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। মায়ের কোলজ্বরা জ্বর। ফার্মেসি থেকে ঔষধ আনতে গিয়ে দেখলেন, দোকানদার বাকি দিতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব ৫০০ টাকা ধার দিলেন। সে রাতে মায়ের পায়ে পানি ঢালতে ঢালতে বই পড়েছিলেন নজরানা। পরদিন পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার সময় পকেটে ছিল শুধু দুইটা বিস্কুট। ফলাফল আসার দিন যখন শোনলেন তিনি গোল্ডেন A+ পেয়েছেন, চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি পুরো গ্রামবাসী।
এইচএসসিতে বায়োলজি নেওয়ার পর সমস্যা বেড়ে গেল। গ্রামে কোচিং সেন্টার নেই, অনলাইন ক্লাস করার মতো স্মার্টফোনও নেই। সমাধান খুঁজে পেলেন স্থানীয় একটি এনজিওর মাধ্যমে। “শিক্ষার আলো” প্রকল্পের আওতায় তিনি পেলেন একটি ট্যাবলেট আর সিম কার্ড, যার মাধ্যমে ঢাকার নামকরা শিক্ষকের ভিডিও লেকচার দেখতেন। রাত ১০টার পর ইন্টারনেট স্পিড ভালো পাওয়া যেত বলে তিনিই গ্রামের একমাত্র মানুষ যিনি নিশাচর পেঁচার মতো জেগে থাকতেন।
মেডিকেল ভর্তিযুদ্ধে তার কৌশল ছিল অনন্য:
- প্রতিদিন ১৬টি MCQ সলভ—এবং প্রতিটির জন্য হাতে লিখতেন ব্যাখ্যা
- বিছানার পাশের দেয়ালে অ্যানাটমি চার্ট—ঘুম থেকে উঠেই দৃষ্টিগোচর হতো
- স্থানীয় ক্লিনিকে স্বেচ্ছাসেবক—প্রায়টিক্যাল জ্ঞান অর্জনের জন্য
- মেডিকেল টেস্ট পেপারের ডিজিটাল আর্কাইভ—বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা
২০২২ সালের ভর্তি পরীক্ষার দিন। বাস ভাড়া নেই—গ্রামের তিন যুবক তাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে ৪০ কিলোমিটার পথ পেডেল চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষাকেন্দ্রে। ফলের দিন যখন দেখা গেল তিনি ৫৬তম স্থান পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেলে, সমস্ত উপজেলা মিছিল বের করেছিল। পত্রিকায় লেখা হয়েছিল: “নদীভাঙা জনপদের কন্যা জয় করল জাতীয় শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখর”।
মেডিকেল কলেজের কঠিন পথে অদম্য অগ্রযাত্রা
মেডিকেলে ভর্তির পর চ্যালেঞ্জ কমেনি। প্রথম সেমিস্টারে ইংরেজির দুর্বলতার কারণে যখন ফেল করার আশঙ্কা দেখা দিল, নজরানা প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ইংলিশ নিউজপেপার পড়তেন। স্যারদের লেকচার রেকর্ড করে শুনতেন হোস্টেলে ফিরে। ছয় মাসের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন সেরা ডিবেটারদের একজন।
আর্থিক সংকট তাকে পিছু ছাড়েনি। টিউশনি করে এবং ব্লাড ডোনেশন করেই চলতেন। একবার এনাটমি ল্যাবে ক্যাডাভার দেখে মূর্ছা গিয়েছিলেন—দুই দিন অভুক্ত ছিলেন বলে। সেই ঘটনা তাকে আরও দৃঢ় করল। এখন তিনি গবেষণা করছেন গ্রামীণ মহিলাদের রক্তশূন্যতা নিয়ে। তার প্রজেক্ট “আনিমিয়া ফ্রি ভিলেজ” এর জন্য পেয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গ্র্যান্ট।
তিনি প্রমাণ করেছেন:
- প্রতিবন্ধকতাই সাফল্যের কষ্টিপাথর—তার GPA 3.92 মেডিকেলের ইতিহাসে সর্বোচ্চের কাছাকাছি
- গবেষণাপত্র প্রকাশ—ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ কমিউনিটি মেডিসিন-এ তার প্রথম পেপার
- শিক্ষার্থীদের মেন্টর—ফ্রি কোচিং করেন ঢাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের
কুড়িগ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা: স্বপ্ন যেখানে সমাজ বদলের হাতিয়ার
“যখন আমি MBBS পাশ করব, প্রথম পোস্টিং চাইব কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে,” বলছিলেন নজরানা গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। তার ইচ্ছা—গ্রামে建立一个 মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্র যেখানে গর্ভবতী মহিলারা পাবেন বিনামূল্যে চেকআপ। ইতিমধ্যেই তিনি শুরু করেছেন “বুকের আলো” নামে একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি, যেখানে দান করেছেন তার পুরোনো বই ও নোট। গ্রামের মেয়েরা এখন তাকে দেখে বলে: “আপা, আমরাও একদিন তোমার মতো ডাক্তার হব!”
তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
- মোবাইল মেডিকেল ইউনিট—নৌকায় করে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া চরাঞ্চলে
- ডিজিটাল লার্নিং হাব—যেখানে গ্রামের শিশুরা শিখবে অনলাইন কোর্স
- কৃষকদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা—স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন নজরানা। গত বছর তিনি জিতেছেন “গ্লোবাল স্টুডেন্ট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড”। পুরস্কারের ১০ হাজার ডলার দিয়ে তিনি কিনেছেন সোলার প্যানেল, যা দিয়ে এখন তার গ্রামের ২০টি বাড়িতে জ্বলে আলো।
জেনে রাখুন
১. নজরানার মতো সাফল্য অর্জনে মূলমন্ত্র কী?
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, পরিকল্পিত পড়াশোনা এবং সামাজিক বাধা উপেক্ষা করার মানসিকতা। প্রতিদিন ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। অসাধারণ সাফল্যের গল্প রচনা করতে চাইলে নিজের দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করুন। প্রতিকূলতাকে দেখুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে, বাধা হিসেবে নয়।
২. দরিদ্র শিক্ষার্থীরা কীভাবে উচ্চশিক্ষার খরচ মেটাতে পারে?
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের স্কলারশিপ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ড আছে। অনলাইনে Freelancing করে আয়, বা NGO-র শিক্ষা প্রকল্পের সাথে যুক্ত হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের ওয়েবসাইটে আবেদন করা যায়।
৩. গ্রামে থেকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব?
সম্পূর্ণ সম্ভব! অনলাইন রিসোর্স (Khan Academy, Coursera), বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির ফ্রি কোর্স, এবং NCTB-র ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করুন। প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়লে সাফল্য আসবেই। গ্রামের পরিবেশ প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার সুবিধাও দেয়।
৪. সাফল্যের জন্য প্যারেন্টসের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
নজরানার বাবা-মা নিরক্ষর ছিলেন, কিন্তু কখনো তাকে পড়াশোনা থেকে বিরত করেননি। সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, ছোট সাফল্যে উৎসাহ দেওয়া এবং পরীক্ষার সময় মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করা—এই সহজ কাজগুলোই পরিবারকে করে তোলে সাফল্যের মূল ভিত্তি।
৫. মেডিকেল ভর্তিযুদ্ধে মেয়েদের বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে কি?
শারীরিক বা মানসিকভাবে কোনো পার্থক্য নেই। তবে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ, সময় ব্যবস্থাপনা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি। নারী শিক্ষার্থীদের নেটওয়ার্কিং গোষ্ঠী (মেডিকেল উইমেন অ্যাসোসিয়েশন) সহায়তা করে।
৬. ব্যর্থতা মোকাবিলা করবেন যেভাবে?
নজরানা প্রথমবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। তিনি ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করেছেন—কোন বিষয়ে দুর্বলতা ছিল, কোথায় সময় ব্যবস্থাপনার ভুল হয়েছে। এরপর সেসব দিক উন্নত করেছেন। মনে রাখবেন, প্রতিটি ব্যর্থতা সাফল্যের নতুন সিঁড়ি তৈরি করে।
নজরানা আক্তারের অসাধারণ সাফল্যের গল্প আমাদের শিখায়—জীবনে শ্রেষ্ঠ অস্ত্র হলো অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এই মাটির দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া এক কন্যা যখন তার স্বপ্নের স্পর্শে বদলে দিতে পারে সমাজের পুরনো ধারণা, তখন প্রতিটি তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে জেগে ওঠে নতুন প্রেরণা। তার ট্যাবলেটে লেখা কথাটি আজ লক্ষ শিক্ষার্থীর মন্ত্র: “পথ যদি অন্ধকার হয়, নিজেই হয়ে উঠো আলোকস্তম্ভ।” এই গল্প কেবল একটি ব্যক্তির জয়কাহিনী নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীর সম্ভাবনার উজ্জ্বল দলিল। আপনি যদি নিজের জীবনে অসাধারণ সাফল্যের গল্প লেখার স্বপ্ন দেখেন, আজই শুরু করুন—প্রতিটি ছোট প্রচেষ্টাই আপনাকে নিয়ে যাবে বড় স্বপ্নের দোরগোড়ায়। আপনার হাতের মুঠোয় আছে বিশ্বজয়ের শক্তি—বিশ্বাস রাখুন, পথ চলা শুরু করুন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।