শিক্ষা কথাটির সঙ্গে আমরা সুপরিচিত। এ বিষয়ে সবারই কম-বেশি ধারণা আছে। অনেকের ধারণা জীবনের নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক ও বইপত্র থেকে জ্ঞান অর্জন করাই শিক্ষা। এটা শিক্ষার সংকীর্ণ অর্থ। আবার অনেকে মনে করেন শিক্ষার সময়কাল জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, পরিবেশ এসবই শিক্ষার ক্ষেত্র। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলতে বুঝায় অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে আচরণের বাঞ্চিত পরিবর্তন। বিভিন্নভাবে মানুষ শেখে যেমন দেখে, শুনে, করে, চিন্তা করে, ঠকে, জিতে, পড়ে। শেখার ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য নেই, অথচ যত্রতত্র জীবনভর দেখেশুনে ঠেকে নানাভাবে মানুষ শিখছে। এ শিক্ষা ধারার নাম অনানুষ্ঠনিক শিক্ষা। একজন লোক প্রায়ই নৌকা দিয়ে নদী পার হয়। স্রোতের অনুকূলে ও প্রতিকূলে মাঝি কীভাবে বৈঠা চালায় তা অনেক সময় লক্ষ্য করে। এক দিন মাঝির অনুপস্থিতিতে সে নিজেই নৌকা চালিয়ে নদী পার হলো। সে অনানুষ্ঠানিক ধারায় নৌকা চালানো শিখল।
এ ধারায় আমরা সবাই কম-বেশি শিখছি। একজন মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যত বড় ডিগ্রিই নিক না কেন তার জীবনে অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্জিত শিক্ষার পরিমাণ সর্বাধিক। এ ধারায় সচেতন মানুষ সবাই শেখে, তাই সবাই শিক্ষিত, কেউই অশিক্ষিত নয়। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত বলে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় না। যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই তারা নিরক্ষর। স্বাক্ষর ও নিরক্ষর এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়। নিরক্ষর মানুষও শিক্ষিত। একজন যুবক কৃষক। সে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সে তার অবসর সময়ে নিকটস্থ বাজারে একটি দর্জির দোকানে গিয়ে মাঝেমধ্যে দর্জির কাজ শেখে। কাজের চাপ বেশি থাকলে শিখতে যায় না। অকৃষি মৌসুমে বেশি সময় ধরে শেখে, কৃষি মৌসুমে কম যায় বা যায় না। এভাবে সে দর্জি কাজ শেখল। শিক্ষার এ ধারার নাম উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। এ ধারায় সময় ও নিয়ম কানুনের কঠোরতা নেই। শিক্ষানবিশ হিসেবে ওস্তাদের কাছে রাজমিস্ত্রির কাজ, কাঠের কাজ, দর্জির কাজ ইত্যাদি শিক্ষা অনানুষ্ঠানিক ধারায় হয়। এ ধারায় যে শেখে বা যে শেখায় এর যে কোনো এক পক্ষের শেখার উদ্দেশ্য থাকতে হয়। জীবনের নির্ধারিত সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত শিক্ষাক্রম অনুসারে শিক্ষকের সহায়তায় পাঠ্যপুস্তক, সহায়ক পুস্তক ও অন্যান্য শিখন সামগ্রীর সাহায্যে শিক্ষা অর্জন করার ধারার নাম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এ ধারার শিক্ষা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত, মূল্যায়ন ও সনদমুখী। আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ধারাভুক্ত। নির্দিষ্ট রুটিনমাফিক শিক্ষা কার্যক্রম চলে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তু ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত। এ শিক্ষা উদ্দেশ্যমুখী। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রারম্ভিক স্তর মৌলিক শিক্ষা। মৌলিক শিক্ষা সাধারণত একমুখী হয়ে থাকে। সাধারণ শিক্ষা স্তর মূলত তিনটি : প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের শিক্ষা প্রচলিত : সাধারণ শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষা। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রধানত ত্রিমুখী : মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা। উচ্চশিক্ষা বহুমুখী, মনের উদারতা বৃদ্ধিকারী বিদ্যা যেমন সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ফার্মেসি, ভূতত্ত্ব, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি; পেশাগত শিক্ষা যেমন আইন, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা, কৃষি, ব্যবসায় শিক্ষা ইত্যাদি। সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষার আরও একটি ধরন আছে- বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা। বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণের আগে অবশ্যই মৌলিক শিক্ষা সুসম্পন্ন করা প্রয়োজন। কায়িক শ্রমযুক্ত কাজ করার জন্য যে দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন ওই দক্ষতা শিক্ষাকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলে। এ দক্ষতাকে মনোপেষিজ দক্ষতা বলে। মনোপেষিজ দক্ষতার দুটি অংশ- মানসিক দক্ষতা ও হাতেকলমে কাজ সম্পন্ন করার দক্ষতা। বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয় বহুবিধ যেমন- পশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ, কচুরিপানা প্রক্রিয়াজাতকরণ, শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাঁশ-বেতের শিল্প, মৃত্তিকা শিল্প, আর হাজারো বিষয়। কাঁচামাল প্রাপ্তি এবং কর্মের সুযোগের কথা বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন স্থানে বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা হলো- বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রকৌশল শিক্ষার মধ্যবর্তী স্তর। এ স্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রকৌশল শিক্ষার ধারণা দেওয়া হয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করে, সিভিল ও আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ভবনের প্ল্যান তৈরি করে। মাঝ পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্ল্যান বুঝে, প্ল্যান অনুসারে রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে ভবন তৈরির কাজ করিয়ে নেয়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ব্লুম শিক্ষাকে তিনটি ক্ষেত্রে বিভাজন করেছেন। ক্ষেত্রগুলো হলো- (ক) অবধারণমূলক (খ) অনুভূতিমূলক এবং (গ) মনোপেষিজ। অবধারণমূলক বা জ্ঞানমূলককে আবার ছয়টি ক্রমভিত্তিক স্তরে বিভক্ত করেছেন, অর্থাৎ কাঠিন্য বা সমৃদ্ধি অনুসারে ছয় স্তরে বিন্যস্ত করেছেন। স্তরগুলো হলো- (ক) স্মরণে রাখা (খ) অনুধাবন করা বা বোঝা (গ) প্রয়োগ করা (ঘ) বিশ্লেষণ করা (ঙ) মূল্যায়ন করা (চ) সৃজন বা সৃষ্টি করা। আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তনই শিক্ষা। এখন যা জানলাম, শুনলাম, পারলাম কিছুক্ষণের মধ্যে সব ভুলে গেলাম একে শিক্ষা বলা যাবে না। অর্জিত নতুন আচরণ অপেক্ষাকৃত স্থায়ী হলে শিক্ষা বলা যাবে। প্রথম স্তর স্মরণে রাখা বলতে অপেক্ষাকৃত স্থায়ী হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। অবধারণমূলকের দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে- আমরা যা দেখি, শুনি, পড়ি বা অনুভব করি তার অর্থ যেন বুঝি। না বুঝে মুখস্থ করাকে শিখন বলা যাবে না। তৃতীয় স্তর হলো- অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রয়োগ করতে পারা। অর্জিত শিক্ষাকে সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করতে পারা হলো স্বার্থক শিক্ষা। বিশ্লেষণ করার দক্ষতা হলো- কোনোকিছু সম্পর্কে জেনে, বুঝে, তথ্য বা ঘটনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে পারা। ঘটনা সম্পর্কে জেনে ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করে সত্য-মিথ্যা চিহ্নিত করে আসল বিষয় উদঘাটন করাকে বিশ্লেষণ বলা হয়। পরবর্তী পর্যায় হলো- মূল্যায়ন, সবকিছু বিশ্লেষণ করে মূল্য নির্ধারণ করা অর্থাৎ দোষগুণ, ভালো-মন্দ বিচার করা। শিখনের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে- সৃজন করা বা সৃষ্টি করা, যে জ্ঞান, দক্ষতা মূল্যবোধ অর্জন করা হলো তার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থী নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা দ্বারা নতুন কিছু সৃষ্টি করা, নতুন সমস্যার সমাধান করতে পারাই হলো সৃজনশীলতা। মাধ্যমিক স্তরের একটি উপমা দিয়ে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করি। শ্রেণিকক্ষে কাচের মধ্যে আলোর বিশ্লিষ্টতা খটিয়ে আলোক রশ্মি সাত রঙে বিভাজিত হওয়া শেখানো হলো। রংধনু কখন কীভাবে সৃষ্টি হয় তা সরাসরি শেখানো হলো না। এরপর শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করা হলো- উত্তর বা দক্ষিণ আকাশে রংধনু দেখা যায় না কেন? শিক্ষার্থী তার অর্জিত জ্ঞান ও নিজের মেধাশক্তি প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান বের করা হলো ওই পর্যায়ে সৃজনশীল দক্ষতার প্রয়োগ।
শিক্ষার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো- অনুভূতিমূলক শিক্ষা। যাবতীয় মানবিক গুণাবলি অর্জন এ ক্ষেত্রভুক্ত। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, পছন্দ, অপছন্দ, দেশাত্মবোধ, সততা, সত্যবাদিতা, সহমর্মিতা, ভদ্রতা, নম্রতা, শ্রদ্ধাবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, পরোপকার ইত্যাদি অর্থাৎ যাবতীয় মানবিক গুণাবলি এ ক্ষেত্রভুক্ত। এ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, আবেগ, অনুরাগ, উপলব্ধি, মানসিক চেতনাবোধ ইত্যাদিকে প্রভাবিত করা হয়। শিক্ষার আরও একটি ক্ষেত্র হচ্ছে- মনোপেষিজ দক্ষতা। সোজা কথায় নিজের জ্ঞান বুদ্ধি প্রয়োগ করে হাতে-কলমে কাজ করার দক্ষতা অর্জন। সাধারণ শিক্ষায় এ দক্ষতা অর্জন গুরুত্বপূর্ণ, তবে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি। বৃক্ষরোপণ ও যত্ন নেওয়া, সাঁতার শেখা, হাঁস-মুরগি পালন, পানি থেকে ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করার দক্ষতা অর্জন মনোপেষিজ দক্ষতার উদাহরণ।
আজকের লেখার সার কথা হচ্ছে- শিক্ষাকে শুধু অবধারণমূলক বা জ্ঞানের বিকাশ সাধনে সীমাবদ্ধ রাখা চলবে না। একজন মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মহা পণ্ডিত কিন্তু অনুভূতিমূলক ক্ষেত্র বিকশিত হয়নি অর্থাৎ নৈতিক বিকাশ ঘটেনি। এ ধরনের মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য খুবই ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। নৈতিকতা বর্জিত এ ধরনের উচ্চশিক্ষিত লোকদের হাতে মানুষের জান ও মাল নিরাপদ নয়। অন্যদিকে একজন লোক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পণ্ডিত, তার নৈতিক বিকাশও সন্তোষজনক কিন্তু তিনি হাতেকলমে কাজ করার ক্ষেত্রে একেবারেই দুর্বল, এমনকি নদীমাতৃক দেশে সাঁতারও জানেন না। এক দিন তিনি গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রাস্তার পাশে পুকুরে একটি শিশু ডুবে যাচ্ছিল। শিশুটি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। ভদ্রলোক শিশুটিকে বাঁচাতে উৎগ্রীব; কিন্তু কিছুই করতে পারছিলেন না, কারণ তিনি সাঁতার জানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য একজন এসে শিশুটিকে বাঁচাল। মনোপেষিজ দক্ষতার উন্নয়নও শিক্ষার কাজ। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ। ভারসাম্য বিকাশের জন্য চাই জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নৈতিক ও মনোপেষিজ দক্ষতার বিকাশ। শুধু তত্ত্ব-তথ্য জানলেই হবে না, জ্ঞানেরও সবকয়টি স্তরের বিকাশ হতে হবে। জানা থেকে সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ পর্যন্ত। শুধু পরীক্ষায় এক ধরনের প্রশ্ন দ্বারা সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। শিখন শেখানো প্রক্রিয়ায় সৃজনশীল কর্মকাণ্ড দ্বারা সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে।
গত ১৩ এবং ২২ মে প্রকাশিত দুটি লেখার ধারাবাহিকতায় আজকের লেখাটি প্রকাশিত হলো। শিক্ষার অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে পরবর্তীতে আলোকপাত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
লেখক : প্রাক্তন পরিচালক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।