নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে চারটি তেঁতুল গাছের চারা কিনে বনসাই গাছ বানিয়ে এখন সাফল্যের শীর্ষে সবুজ। ২৯ বছরে বহু ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি তার নার্সারিতে ৪৫০টি প্রজাতির প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় বনসাই প্রক্রিয়াধীন রেখেছেন। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে বনসাইয়ের জন্য বাজার তৈরিসহ নানা বিষয়ে কাজ করছেন।
গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ি থানার আমবাগ এলাকায় গাছপ্রেমী সবুজের বনসাইয়ের নার্সারি দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। ছাদ জুড়েই তার বনসাইয়ের ছড়াছড়ি।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চর পাথালিয়া গ্রামের সরকারি চাকরিজীবী কেএম সবুজের পুরো নাম খান মুহাম্মদ সবুজ। গাজীপুর মহানগরীর আমবাগ পশ্চিমপাড়া এলাকায় তার বসবাস। সেখানেই আড়াই বিঘা জমি ও দুটি বাসার ছাদে তার স্বপ্নের বনসাই বাগান। ২৯ বছর ধরে বনসাই তৈরি করছেন তিনি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী যুবকরা বনসাই সংগ্রহের পাশাপাশি বেকারত্ব ঘোচাতে নিচ্ছেন নানা প্রশিক্ষণ। এ বনসাই শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে বলে জানান সবুজ। সবুজের বনসাই নার্সারিতে পরিবারের সদস্যসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন।
অথচ এক সময় এ নার্সারি করার কারণে তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। চল্লিশ হাজার টাকায় একটি বনসাই বিক্রি করা হলে পরিবারে তার ঠাঁই মেলে। পান পরিবারের উৎসাহ অনুপ্রেরণা।
সবুজের বনসাই নার্সারি ঘুরে দেখা গেছে, শত শত বনসাই গাছ সারি সারি করে সাজানো। কয়েকজন কর্মচারী সেগুলোর পরিচর্যা করছেন। সবুজ নিজেও হাত লাগাচ্ছেন বিভিন্ন গাছে। কর্মচারীদের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।
সবুজ বলেন, ১৯৯৬ সালে সিলেটে ঘুরতে গিয়ে এক নার্সারিতে একটি বনসাই দেখেন তিনি। শখের বশে ১০০ টাকা দিয়ে ৪টি তেঁতুল গাছের চারা কিনে শুরু করেন বনসাই চাষ। এখন তার সংগ্রহে প্রায় ২০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির বনসাই রয়েছে। যেখানে এক হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা দামের গাছও রয়েছে। সব মিলিয়ে ১ কোটি টাকারও বেশি বনসাই আছে তার সংগ্রহে। তার নার্সারিতে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় বনসাই প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এখানে ৪৫০ প্রজাতির বেশি গাছ রয়েছে।
২০০৭ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রখ্যাত বনসাই শিল্পী নাজমুল হাসানের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে চীনে এবং ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বনসাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন।
যখন তিনি বনসাই নার্সারি শুরু করেন, তখন কোনো বনসাই প্রশিক্ষণ ছিল না। এরপর ১২-১৪ বছর বনসাই নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যান। ২০১৭ সালে প্রথম বনসাইয়ের ওপর একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপর বনসাই শিল্প নিয়ে বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
সবুজ বলেন, যারা বনসাই শিল্প নিয়ে কাজ করতে চান তারা প্রাথমিকভাবে শুরু করতে পারেন। যদি বনসাইয়ের ওপর একাডেমিক প্রশিক্ষণ থাকে তাহলে এ দৃষ্টিনন্দন বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এজন্য গাছকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরিচর্যা করা, পানি দেওয়া, নিড়ানি দেওয়া, কীটনাশক স্প্রে করা, সার দেওয়া এ বাহ্যিক কাজগুলো যখন তখন করা যাবে। আর এজন্য একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। চাইলেই এ শিল্পটাকে নিয়ে কাজ করা যাবে।
বনসাই শিল্পের ওপর যখন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হবে তখন অবশ্যই বনসাই শিল্পের মান আরও বেশি উন্নত হবে। আমরা চাচ্ছি প্রত্যেকটি মানুষের বাসায় একটি করে বনসাই গাছ থাকুক। এ শিল্পকে মানুষ ভালো করে চিনুক। আমরা গত কয়েক বছরে কয়েকটি দেশে বনসাই রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছি। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভারত ও মালয়েশিয়ায় এ বনসাই রপ্তানি করেছি।
অনটেস্ট হিসেবে কানাডায় পাঁচটি ও আমেরিকায় ২টি বনসাই পাঠানো হয়েছে। শীত প্রধান দেশে এ বনসাই গাছগুলো কীভাবে টিকে থাকে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। আর যদি ওই পরিবেশে এগুলো টিকে যায় তাহলে আমাদের বনসাই শিল্পের জন্য সুখবর হবে। তখন আমাদের দেশের বনসাই আমরা আমেরিকা ও ইউরোপেও রপ্তানি করতে পারবো। এটা আমাদের জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয়। বনসাই শিল্পের মাধ্যমে আয়ের একটি উৎস সৃষ্টি হবে।
বনসাই শিল্পের জন্য দেশে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে যুব উন্নয়ন একাডেমি চারটি জেলায় অস্থায়ীভাবে বনসাইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থাও করেছিল। বিসিক শিল্পনগরীও এ শিল্পটাকে এগিয়ে নিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, এছাড়া পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ও এ শিল্পের ওপর নজর দিয়েছে। ঢাকায় যতগুলো হটিকালচার সেন্টার আছে সেগুলোতে আলাদা করে বনসাইয়ের আলাদা পার্ট আছে। পরিবারের যেসব সদস্য বাড়িতে থাকেন বিশেষ করে গৃহিণী বা ছাত্র তারা ইচ্ছা করলে দু-চারটি বনসাই বাড়ির ছাদে বা বেলকনিতে লাগিয়ে আয় করতে পারেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যারা বনসাই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তারা প্রথমে গাছ সংগ্রহ করবেন। গাছ দুইভাবে সংগ্রহ করা যায়। একটি হচ্ছে প্রথমে যেকোনো নার্সারি থেকে বনসাই গাছ সংগ্রহ করতে পারেন, অপরটি হচ্ছে যারা বনসাই নিয়ে কাজ করেন তাদের কাছ থেকে গাছ সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া রাস্তার আশপাশে বিভিন্ন ভবনে বট প্রজাতির যেসব গাছ রয়েছে, অবহেলায় পড়ে আছে সেগুলোকে সংগ্রহ করে বনসাই যাত্রা শুরু করা যাবে।
এজন্য জানতে হবে বনসাই গাছের পরিচর্যা কীভাবে করতে হবে। কী পরিমাণ মাটি দিতে হবে, তাদের খাদ্য কী, কতটুকু পানি, জৈব সার, রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। আর এগুলো জানতে বনসাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। আর যাদের ছাদ বাগান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা ইচ্ছে করলেই বনসাই করতে পারেন।
তিনি জানান, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফাইকাস প্রজাতির বট রয়েছে। এরমধ্যে তার নার্সারিতে ২৫০টির বেশি ফাইকাজ প্রজাতির বট রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের দুর্লভ প্রজাতির নাগ লিঙ্গ গাছও বনসাই করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দেশে বিলুপ্তপ্রায় গাছের মধ্যে হিজল তমাল গাছের বনসাই করে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। এক হিসেবে বনসাই শিল্পটি একটি বনসাই যাদুঘরে রূপান্তরিত হতে পারে। কারণ এখানে বিলুপ্ত প্রায় সব ধরনের গাছ সংরক্ষণ করা আছে।
সাধারণ গাছ ও বনসাই গাছের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে সবুজ বলেন, সাধারণ গাছ ও বনসাই গাছের মধ্যে পার্থক্য হলো, নার্সারিতে যেসব গাছ উৎপন্ন হয় সেগুলো পর্যায়ক্রমে ছোট পাত্র থেকে বড় পাত্রে স্থানান্তর করা হয়। আর বনসাই হচ্ছে বড় পাত্র থেকে আস্তে আস্তে অগভীর ছোট পাত্রে চলে আসে।
তিনি জানান, ড্রামে একটি বড় আমগাছ লাগানো হলে এটিতে দীর্ঘদিন ফলন দেওয়ার পর এক পর্যায়ে এটি যখন ফল দিবে না তখন সে গাছটিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বনসাই গাছে রূপান্তর করা যাবে। এটাকে ছোট পাত্রে এনে পরিমিত খাবার দিয়ে বনসাইয়ে রূপান্তর করা সম্ভব। একটি গাছের জন্য ১৬ প্রকার খাদ্যের প্রয়োজন হয়ে থাকে। একটি ছোট্ট পাত্রে কী পরিমাণ পানি, সার ও খাবার দেওয়া হবে তা জানতে হবে। বনসাই গাছগুলোতে জৈব সারের পাশাপাশি পরিমিতভাবে রাসায়নিক সারও প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া গাছকে ছত্রাকনাশক, ভিটামিন ও মিনারেল স্প্রে করতে হবে।
যেকোনো বনসাই গাছেই ফল আনা সক্ষম। এজন্য ফলজাতীয় গাছকে পাতলা ট্রে’র পরিবর্তে একটু গভীর টবে দেওয়া উচিত। কারণ তার যখন ফুল ও ফল আসে তখন তাকে বাড়তি খাদ্যের জোগান দিতে হবে। সাধারণ গাছে যখন ফুল ও ফল আসে বনসাই গাছেও ঠিক একই সময়ে ফুল ও ফল আসে। বনসাই গাছ ছোট হলেও ফল ছোট হবে না। ফল হবে স্বাভাবিক বড়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।