জুমবাংলা ডেস্ক : যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দী কিশোরদের পেটানোর ব্যাপারে আগেই সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কর্মকর্তারা। শনিবার দুপুরে যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাংবাদিকের এ তথ্য জানান।
এদিকে তিন বন্দি কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা ও আরও ১৫ জনকে আহতের ঘটনায় কেন্দ্রের পাঁচ কর্মকর্তাকে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। শনিবার বিকেলে যশোরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মাহাদী হাসান তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যশোর চাঁচড়া ফাড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক রোকিবুজ্জামান জানান, আদালতে তিনি ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলেন। বিচারক এর মধ্যে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আব্দুল্লাহ্ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ্ ও ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর শাহানুরকে পাঁচদিনের এবং সাইকো সোস্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান ও ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটর ওমর ফারুককে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
তিনি আরও জানান, এদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদেরকে জিঙ্গাসাবাদ করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরবন্দি খুন ও আরও ১৫ বন্দিকে জখমের ঘটনার পর ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। প্রাথমিক তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শনিবার ভোরে এই পাঁচজনকে বন্দি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এদিকে এদেরকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর পর শনিবার দুপুরে সাংবাদিকের ব্রিফিংকালে যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের সাথে চুল কাটা নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে মারপিট করে কেন্দ্রের ৫ কর্মকর্তা। তাদের পৈশাচিক নির্যাতনের ফলে ৩ কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। মারপিটে অংশ নিয়েছিল কর্মকর্তাদের অনুুগত ৭/৮ জন কিশোর বন্দিও।
তিনি আরও জানান, ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ৩ আগস্ট। এদিন কিশোরবন্দি হৃদয়কে চুল কেটে দিতে বলেন কেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রধান (হেড গার্ড) নূর ইসলাম। ঈদের আগে হৃদয় প্রায় ২০০ বন্দির চুল কাটায় তার হাত ব্যথা উল্লেখ করে চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নূর ইসলাম কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহর কাছে অভিযোগ করেন, ‘ওরা ট্যাবলেট খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে।’ এছাড়াও তিনি হৃদয় ও তার বন্ধু পাভেলের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত করেন। সেখানে উপস্থিত কিশোর নাঈম অভিযোগ শুনে বিষয়টি পাভেলকে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেল তার কিছু অনুসারী কিশোরকে নিয়ে নূর ইসলামকে মারপিট করে। এতে তার হাত ভেঙ্গে যায়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
পুলিশ সুপার বলেন, ‘জাতীয় শোকদিবস পালন উপলক্ষে ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯ জন কর্মকর্তা কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় ‘নূর ইসলামের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি প্রদানের’ সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শনাক্ত হামলাকারী ১৩ জনসহ আরও কয়েকজনকে বের করে আনা হয়। ওই পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের আজ্ঞাবহ ৭/৮ জন কিশোর বন্দি ‘অভিযুক্তদের’ মারপিট শুরু করেন। এসময় তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। মুখে গামছা ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করে টেনে ধরে পেছনে বেধড়ক মারপিট করা হয়। লোহার রড, ক্রিকেট স্ট্যাম্প ইত্যাদি দিয়ে বেপরোয়া মারপিট করা হয়। অচেতন হয়ে গেলে বন্ধ করে ফের জ্ঞান ফিরলে মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর গুরুতর জখম অবস্থায় এদের একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। একজন ‘কম্পাউন্ডার’ দিয়ে সামান্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে এক অবর্ণনীয় পরিবেশ দেখতে পান। নির্যাতনের শিকারদের দুপুরে খাবার না দিয়ে, চিকিৎসা না দিয়ে গরমের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আরও দু’জনকে হাসপাতালে পাঠানো হলে তারাও মারা যায়। পরে অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের পিকআপে করে ১৪ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন আরও একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এনিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৫ জন আহত ছিল।’
নিহতরা হলো, বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্বপাড়ার নান্নু পরমানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)। নিহত নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যায় যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত পারভেজ হাসান রাব্বির (১৮) বাবা খুলনা দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়া। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়। তবে এজাহারে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে বন্দি হত্যার ঘটনায় শুক্রবারই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি গঠন করা হয় দু’টি তদন্ত কমিটি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শুক্রবার বিকেলে তিন সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করেন।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবুল লাইছকে। এ ছাড়া সদস্যসচিব সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা এবং সদস্য করা হয়েছে জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, যিনি এএসপি পদমর্যাদার নিচে নন। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তর দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করে। ওই কমিটির প্রধান করা হয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মোহাম্মাদ নুরুল বসিরকে। তার সাথে তদন্তকাজে সহায়তা করবেন উপ-পরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) এসএম মাহমুদুল্লাহ। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, ওই তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশও মামলার তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। ওই মিটিংয়ে থাকা ১৯ জনের সাক্ষাতকার গ্রহণ, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ায় ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জড়িত ৭/৮ কিশোর বন্দিকে এই মামলায় আইনের আওতায় আনতে আদালতে আবেদন করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রাব্বানী, যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান প্রমুখ।-সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।