ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : একটা সংগৃহীত লেখা প্রায় সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। বোধহয়, মানুষ লেখাটা পড়ে না, কারণ লেখাটা পড়লে মানুষের বদলে যাওয়ার কথা। কিন্তু মানুষকে বদলে যেতে দেখছি না।
যদি ধরে নেই, মানুষ লেখাটা হয়তো পড়ে, কিন্তু সেখান থেকে যে শিক্ষাটা নেওয়া দরকার সেটা নেয় না। কারণ, মানুষের ভেতরে বিবেক বলে কিছু একটা থাকার কথা, হয়তো সেটা এখন আর নেই। প্রতিদিন রাতে বদলে যাওয়া মানুষের স্বপ্ন দেখলেও সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, স্বপ্নগুলো স্বপ্নই ছিল, সেটা আর বাস্তব হয়ে ওঠেনি।
সংগৃহীত লেখাটি নিম্নরূপে হবহু তুলে ধরছি ইনভাইটেড কমার মধ্যে, ‘একটি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত এমডি অবসরের ৫ বছর পর তার শহরের একটি শাখায় এসেছিলেন টাকা তুলতে। কেউ তাকে সালাম দিলো না, এগিয়ে এলো না, কারণ কেউ তাকে চিনতে পারেনি। ব্যাংকটিতে যারা কাজ করছেন সবাই নতুন।
তিনি নিজেকে ওই ব্যাংকের সাবেক এমডি হিসেবে পরিচয় দেন। পরিচয় পাওয়ার পর একজন অফিসার তাকে চা অফার করেন এবং কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেন, ‘অবসরের পর আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
সাবেক এমডি বলেন, প্রথম ২/১ বছর খুব খারাপ লেগেছে। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, দাবা খেলা শেষ হওয়ার পরে রাজা এবং সৈনিকদের একই বাক্সে রাখা হয়। পদ, পদবি, উপাধি, শান-শওকত সবই অস্থায়ী। মানুষের ভালোবাসাটা স্থায়ী, বিনয় ও সদাচরণ দিয়ে যা অর্জন করতে হয়।
সময় যার যার জীবনের হিসেব বুঝিয়ে দেয়! এই সত্যটা সময় থাকতে আমরা বুঝতে চাই না!’
শেক্সপিয়র একটা মূল্যবান কথা বলেছেন, পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ, আমরা সবাই সেই মঞ্চের অভিনেতা। কথাটা মিথ্যে নয়, এ রঙ্গমঞ্চে সময় মানুষকে একেক সময় একেকটা চরিত্র দেয়, মানুষকে পরীক্ষা করে। মানুষ ভাবে, সময়কে সে ঘড়ির কাঁটায় আটকে ফেলেছে, অথচ মানুষ বুঝতে চায় না, ইচ্ছা করলেই সে সময়কে আটকে রাখতে পারে না, সময় তাকে টানতে টানতে জীবনের শেষপ্রান্তে নিয়ে আসে। সময়ের কাছে জীবন অসহায় হয়ে পড়ে, চেনা মানুষ, চেনা শহর, চেনা জনপদ, সবকিছুই একদিন বিলীন হয়ে যায়। সময় চলতে থাকে, কলকব্জার ঘড়ি সময়ের সঙ্গে দৌড়ে না পেরে একদিন অকেজো হয়ে পড়ে থাকে অযত্নে।
একটা আয়নার কথা লেখা আছে জার্মানদের রূপকথায়। সে আয়না সবসময় সত্য কথা বলত। তেমন একটা আয়না সবাইকে নিজের কাছে রাখতে হবে, যেটা মানুষকে নিজের মুখটা দেখাবে না, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে যেসব পরিণতি ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা দেখাবে।
একটা মিডিয়া বলছিল, সাকিব আল হাসানের মতো সেলিব্রেটির এখন এতটুকু সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই, প্রতিটা সময় তার কাছে মূল্যবান। যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরছেন, অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। বড় বড় ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলো তাদের মার্কেটিং প্রমোশন যেমন ইচ্ছে তেমন করে করিয়ে নিচ্ছেন। এর পেছনে অনেক টাকাও তারা ঢালছেন। সাকিব আল হাসান জানেন, যতক্ষণ তিনি দিতে পারবেন, ততক্ষণ তিনি মূল্যবান থাকবেন, যখন আর পারবেন না, তখন আজ যারা তার পেছনে ছুটছেন, তাদের কাছে তিনি মূল্যহীন হয়ে পড়বেন।
সবকিছুই ঠিক আছে। সাকিব আল হাসানদের মতো প্রতিভাধর মানুষের কাছে আমজনতার একটাই চাওয়া, মানুষের স্বার্থপর চরিত্র বুঝে বাণিজ্যিক দুনিয়ার পেছনে যেমন আপনারা অবিরাম ছুটছেন, তেমনি দেশের সাধারণ মানুষ মন থেকে চায় এসবকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় আপনারা যাতে পিছিয়ে না পড়েন। জানি ইমোশন একটা ফালতু বিষয়, তবে টাকা-পয়সার চেয়ে মানুষের হৃদয়ের ভেতরে জায়গা করে নেওয়ার বিষয়টি তার থেকে অনেক বড়। দেশ আপনাকে কী দিল সেটা বড় কথা নয়, দেশকে আপনি কী দিলেন সেটাই বড় কথা, সময় থাকতে সেটাকে বিশ্বাস করবেন প্লিজ। কারণ, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
তারপরও কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে ব্যতিক্রম থাকে, যদিও ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি কালজয়ী আবিষ্কারগুলোর পেটেন্ট করেননি। ১৯০১ সালে এর উত্তরে লেখা চিঠিতে তিনি কবিগুরুকে উদ্দেশ করে বিনীতভাবে লেখেন, ‘আমি যদি একবার টাকার মোহে পরে যাই, তাহলে আর কোনোদিন এখান থেকে বের হতে পারব না।’ তিনি টাকার চেয়ে সৃষ্টিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, এর প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। আবার জগদীশচন্দ্র বসু রেডিও প্রথম আবিষ্কার করলেও পেটেন্ট না করায় মার্কনি হয়ে যান রেডিওর আবিষ্কারক।
সময় ইতিহাস হয়, সময় বর্তমান হয়, সময় ভবিষ্যৎ হয়, সময়কে চিনেই মানুষকে পা ফেলা উচিত, যাতে মানুষ নিজের গল্প না লিখে সময়ের গল্প লিখে।
২. পৃথিবীটা খুব অদ্ভুত, যেখানে জীবনের গল্পগুলো কেমন করে যেন বদলে যায়। যে জীবনকে মানুষ ঠেলাগাড়ির মতো টানছে, সে জীবনকে মানুষ লুকিয়ে রেখে পৃথিবী যেভাবে মানুষকে দেখতে চায় সেভাবেই নিজেকে দেখায়। হয়তো নিজের সঙ্গে নিজের মুখ-মুখোশের লুকোচুরির খেলা সেটা, কিন্তু কী আর করার আছে, সবকিছুই যে নিজের মতো করে বলা যায় না, করা যায় না। নিজের মতো করে কাঁদা যায় না, নিজের মতো হাসা যায় না, হাসতে চাইলে কাঁদতে হয়, কাঁদতে চাইলে হাসতে হয়, একটা নিজের মুখ, আরেকটা আয়নার ভেতরের মুখের মতো। যেখানে পৃথিবী মানুষের মুখের চেয়ে আয়নার মুখটাকে দেখতে বেশি ভালোবাসে।
যে মানুষটার জীবন দুঃখের মধ্যে ডুবে আছে, সে মানুষটা খুব গর্ব করে হাসিমুখে সারা পৃথিবীকে বলছে, তার মতো সুখী এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। অথচ সে মানুষটা সারাজীবন পৃথিবীর শক্ত চামড়ার বুটের লাথি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, তারপরও শরীরের ধুলোবালিগুলো সরিয়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, কখনো কাঁদেনি বরং লাথি খেয়ে হেসেছে। নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে মানুষের জীবন গড়ে দিলেও নিজের জীবন গড়তে পারেনি। লোকটা এখন বুঝে, পৃথিবীর কাছে সে একটা টিস্যু পেপার ছাড়া আর কিছুই নয়, তবুও লোকটা খুব খুশি এই ভেবে যে, অন্তত মানুষের কাছে টিস্যু পেপারের মর্যাদাটুকু তো পেয়েছে সে, অনেকে তো সেটাও পায় না। লোকটাকে খুব বোকা মনে হতে পারে, লোকটা বোকা না, হয়তো লোকটা মানুষের বিবেক, যে বিবেক এখন ঘুম থেকে জেগে উঠতে ভয় পায়।
যে মানুষটা সংসারের বোঝা টানতে টানতে নিজেই একদিন সংসারের বোঝা হয়ে যায়, সে মানুষটা জানে, সন্তানদের কাছে গাড়ি-বাড়ির মূল্য থাকলেও তার কোনো মূল্য নেই। যে সংসারটা একদিন তার ছিল, সে সংসারটাও এখন আর তার নেই। সবাই সংসারের একদিন রাজা থাকে, সময় সেই রাজাকে রাজ্যহীন বানায়, তার ফেলে আসা স্বাধীন জীবন এখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে পরাধীনতার কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ। সময় যে জীবনের গল্পগুলো এমন করেই বদলে দেয়, সময় এত দ্রুত বয়ে যায় যে, সেই সময়ের গর্ভে কে ডুবল, কে ভাসল, তার হিসাব সময় কখনো রাখে না। অথচ এ মানুষটা নিজের সস্তা হয়ে যাওয়া জীবনটা লুকিয়ে রেখে সারা পৃথিবীকে চিৎকার করে বলে, আহা, আমার মতো সন্তান যাদের আছে, তাদের চেয়ে ভাগ্যবান পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
বাংলা সিনেমার গানটা ভেসে আসছে কানে, ‘আমার মত এত সুখী নয়তো কারো জীবন, কি আদর স্নেহ ভালোবাসায় ঝরালো মায়ার বাঁধন।…বুকে ধরে যত ফুল ফোটালাম, সেই ফুলের কাঁটা ছাড়া কী পেলাম, ভাগ্যের পরিহাস এরই নাম।’
বুঝতে পারছি না, গানটা কমেডি, নাকি ট্র্যাজেডি। না বোঝাটাই হয়তো ভালো।
৩. পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ স্রোতের অনুকূলেই গা ভাসায়, সেই স্রোতে ভাসার বিষয়টিকে মানুষ সত্য বলে মানুক আর নাইবা মানুক, বিশ্বাস করুক আর নাইবা করুক। অন্তত সাধারণ মানুষ এটুকু বিশ্বাস করে স্বস্তি অনুভব করে যে, স্রোতের অনুকূলে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে নিরাপদ থাকা যাবে, বাড়তি ঝামেলায় পড়ার মতো বিপত্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে। উচ্চাভিলাষী মানুষ এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের থেকে একটু ভিন্ন হয়। এই শ্রেণির মানুষ ইচ্ছা করেই স্রোতের অনুকূলে গা ভাসায়, কারণ, এর পেছনে তাদের অনেক ধরনের লোভ কাজ করে। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো, তাদের এ সুবিধাবাদী চরিত্র প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়, তাদের লোভগুলো পূরণ হয়। একটু লক্ষ করলে দেখবেন, স্রোতের অনুকূলে চলা মানুষই প্রায় সব জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করে আছে, স্রোতের প্রতিকূলে চলা মানুষ অনেক জ্ঞানী-গুণী হওয়া সত্ত্বেও ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, অনেক ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। সময় যত এগোচ্ছে, স্রোতের অনুকূলে চলা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, প্রতিকূলে চলা মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কমছে।
মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষাগুলোতেও এর প্রমাণ মিলছে। মনোবিজ্ঞান বলছে, স্রোতের অনুকূলে বেশিরভাগ মানুষ থাকে বলে স্রোতের প্রতিকূলে চলা মানুষ একদিন তাদের বিশ্বাস হারিয়ে স্রোতের অনুকূলে অবস্থান নিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা আর কী এমন, এমনটা তো হতেই পারে! অথচ এটি এক ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা, যা সমাজ থেকে ক্রমাগত ভিন্ন চিন্তার মানুষের সংখ্যাকে খেয়ে ফেলছে, চিন্তার বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে, অনেক ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার ওপর আরোপিত চিন্তাধারা প্রভাব বিস্তার করছে। এ ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যেখান থেকে পদলেহনকারী, লোভী, মেধাহীন ও ভীতু প্রজন্ম তৈরি হতে পারে, যা সমাজের কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে।
একটু লক্ষ করলে দেখবেন, একসময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের মতো মানুষ স্রোতের প্রতিকূলে চলে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিল। স্রোতের প্রতিকূলে থাকা এ মানুষ স্রোতের অনুকূলে থাকা বিশাল সংখ্যার মানুষের সঙ্গে প্রায় একাই দাঁড়িয়ে লড়েছিল। জয়টা শেষ পর্যন্ত স্রোতের প্রতিকূলে চলা মানুষেরই হয়েছিল। স্রোতের অনুকূলে চলা মানুষ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, স্রোতের প্রতিকূলে চলা মানুষ তাদের কর্মের মাধ্যমে আজও বেঁচে আছেন।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।