মো. মিজানুর রহমান: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবরণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি থমকে যায়। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্যাস-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ও বিপ্লব ঘটিয়েছেন, তা ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে কানেক্টিভিটি তৈরি যোগাযোগব্যবস্থায় অন্যমাত্রা সৃষ্টি করেছেন। দেশের সক্ষমতায় পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে। স্বপ্নের মেট্রোরেল তৈরি হচ্ছে। তাই তো ২০৩০ সালের মধ্যে শিল্পবিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে নতুন সংযোজন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিলেন।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০ অধ্যাদেশ দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর বিধান অনুসারে ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হয়। বেজা প্রধানমন্ত্রীর আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, লাইসেন্স প্রদান, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। বেজা প্রতিষ্ঠার পর বিনিয়োগ ও রপ্তানিকে আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বেজাকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে :(ক) সরকারি পর্যায় (খ) বেসরকারি পর্যায় (গ) সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারী (পিপিপি) (ঘ) বিদেশি পর্যায়।
বাংলাদেশের এলাকাভিত্তিক বৈচিত্র্য আছে। বিশেষ করে কৃষি ও শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে। কিন্তু যেভাবে এলাকাভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও পরিকল্পিত শিল্পায়নের পথে হাঁটতে পারেনি দেশ। ঢাকা, খুলনা চট্টগ্রাম, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে অপরিকল্পিত কিছু শিল্প গড়ে উঠলেও মূলত কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভর করেই চার দশক পার করে ফেলেছে। কিন্তু সব নাগরিকের জন্য উত্পাদন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারিনি দেশের কোনো সরকারই। ফলে শহর থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা এমনকি ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত ধনী ও দরিদ্র বৈষম্য বেড়েই চলেছে। বর্তমান সরকার কৃষি আর প্রাচীন অর্থনীতির পুরোনো ধ্যানধারণা বৃত্ত ভেঙে ভারতের মতো পরিকল্পিত শিল্পায়নের পথে হাঁটতে চাইছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করার পরিকল্পনা। সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে ১৫ বছরের মধ্যে ব্যাপক লোকের কর্মসংস্থানের টার্গেট নিয়ে কাজ করছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। তাছাড়া জমি লিজ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, লিজ প্রদানকারীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে লিজের অর্থ এই নয়—বিনিয়োগকারী লিজ করা জমি যেন গ্রাস করে ফেলা না হয়। তাহলে জমি লিজ পেতে সহজতর হবে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে না পারলে বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হবে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের ক্ষেত্র সহজীকরণ করতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের অগ্রগতি: ইতিমধ্যেই ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান নির্ধারণ জমির পরিমাণ অনুমোদন করেছে। বর্তমানে ২৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ চলছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা মিরসরাইয়ে অবস্থিত নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে গঠিত। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল ৩০ হাজার একর জায়গায় গড়ে উঠেছে এই শিল্পনগর। দেশের সবচেয়ে বড় দেশি-বিদেশি ১৫৯টি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার কোটি ডলার, যা বাংলা টাকায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি। সেখানে ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস, সিঙ্গাপুরের উইলমারসহ আরো অনেক দেশি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন পিএইসপি, বসুন্ধরা, টিকে গ্রুপের মতো অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। সেখানে ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ চলছে ১৫ প্রাথমিক কাজ শুরু করছে। আগস্ট নাগাদ দুটি শিল্প উত্পাদনে যাবে। উক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিশাল কর্মযজ্ঞ এলাকা। ১০.৩৫৯৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ১১টি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে ব্যক্তিমালিকাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে ছোট-বড় ৭০০টি শিল্প নির্মাণে কাজ চলছে। এ বছরই ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে ৫ লাখ লোকে কর্মসংস্থান হবে। তাছাড়া মহেশখালী, শ্রীহট্ট, জামালপুর মৌলভীবাজার, সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৭০টির মতো বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে তিনটি শিল্পের কারখানা স্থাপনের কাজ চলছে। শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি ইজারা শেষ হয়েছে। শিগিগরই শিল্প স্থাপনের কাজ শুরু হবে। সাবরাং ট্যুরিজম তিনটি হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে, পরিবেশ ছাড়পত্রের বিলম্বের কারণে অন্য শিল্প স্থাপনের বিলম্ব হচ্ছে। মৌলভীবাজারে কোনো শিল্পকারখানা ছিল না, সেখানেও হচ্ছে, নরসিংদীর কাজ চলছে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি উন্নয়নের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ২৪ শতাংশ বাংলদেশি ৭৬ শতাংশ জাপানি বিনিয়োগে অংশীদারিত্বে স্থাপন করা হয়েছে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের কাজ চলছে। আগামী বছরের শেষে শিল্প স্থাপনের কাজ শুরু হবে। মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিদেশিরা বিনিয়োগ করেছেন।
এরই মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপন করা কারখানায় জাম্বু ব্যাগ, কোমল পানীয়, নুডলস, ভোজ্য তেল, টিস্যু পেপার, কাগজ, হ্যাংগারসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পণ্য ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ভুটান, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, ভারত-নেপাল, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, চীন, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া ব্রিকেটেড, স্টিল, মোটরসাইকেলসহ অনেক পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করতে পারলে তাতে ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। রপ্তানি আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। বেজা বেকার সমস্যা সমাধান করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তার জন্য বেজা কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন সদিচ্ছার এবং নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত রাখা। নিজেদের এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাহলে জনগণ পাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।
লেখক: ব্যাংকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।